পিতৃত্ব নিয়ে সন্দেহ ও সংশয় দূর করার জন্য আদালত ডিএনএ টেস্টের নির্দেশ দিতে পারে কি? পারিবারিক আদালতের রায়ের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের রায় মেলেনি। তবে এই নিয়ে যুক্তি-তর্কের মাঝেই ভারতের বাজার দাপাচ্ছে পিতৃত্ব যাচাইয়ের কিট, সুলভে। লিখলেন দেবাশিস কর্মকার।
‘নেটফ্লিক্স’-এর একটি জনপ্রিয় সিরিজের মতোই খানিকটা– বিবাহবিচ্ছেদ মামলায় এক মহিলা তঁার ও সন্তানের ভরণপোষণ প্রক্রিয়ায় স্বামীর ডিএনএ পরীক্ষার নির্দেশ দেওয়ার আবেদন করলে মোহালির একটি পারিবারিক আদালত তাতে সায় দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে স্বামী পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা হাই কোর্টে আবেদন করেন। তাতে পারিবারিক আদালতের িনর্দেশ বহাল রেখে হাই কোর্ট বলেছিল, এই ধরনের পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার জন্য সুস্পষ্ট বিধান না-থাকলেও ভরণপোষণের ক্ষেত্রে পিতৃত্ব নিশ্চিত করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষার নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে, মহিলার স্বামী তঁার সঙ্গে বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা অস্বীকার করেছিলেন ও দাবি করেছিলেন যে, তঁাদের বিবাহ থেকে সন্তানের জন্ম হয়নি। তিনি মোহালি আদালতের নির্দেশের বিরুদ্ধে উচ্চ-আদালতে আবেদনের সময়, এই প্রসঙ্গে– ডিএনএ নমুনা বাধ্যতামূলক সংগ্রহের প্রয়োজনে– আইনে নির্দিষ্ট বিধানের অনুপস্থিতিকেও উল্লেখ করেছিলেন। চলতি বছরের আগস্টে, ওই মামলায় পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা হাই কোর্টের বিচারপতি হরপ্রীত সিং ব্রার অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলেন, ‘এই আদালতের বিবেচিত দৃষ্টিভঙ্গি হল– এখানে অবৈধ বা অশুচি বলে চিহ্নিত করা উদ্বেগের বিষয় নয়, তাই সত্যে পৌঁছনোর জন্য আদালতের নির্ভরযোগ্য এবং নির্ভুল বিজ্ঞানের উপর নির্ভর না-করার কোনও কারণ নেই। অনুমানের আশ্রয় না নিয়ে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার কাম্য।’ পিতৃত্ব প্রমাণে ডিএনএ টেস্টের ক্ষেত্রে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার রায় ‘ঐতিহাসিক’ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রায় একই ধরনের একটি মামলায় কেরল হাই কোর্টের বক্তব্য ছিল, শুধুমাত্র পিতৃত্ব নিয়ে সন্দেহ দূর করার জন্য আদালত ডিএনএ টেস্টের নির্দেশ দিতে পারে না। এই ডিএনএ টেস্টের আবেদন আগেই খারিজ করে দিয়েছিল একটি পারিবারিক আদালতও। সেই আদেশ বহাল রেখে হাই কোর্ট জানিয়ে দেয়, ‘বাবা’ কে শুধুমাত্র তা নিয়ে সন্দেহ দূর করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষার নির্দেশ দেওয়া ন্যায়সংগত নয়। আদালত আরও বলে, শুধুমাত্র যেক্ষেত্রে আদালত মনে করবে ডিএনএ টেস্ট ছাড়া সিন্ধান্তে আসা সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রেই ডিএনএ পরীক্ষার নির্দেশ দিতে পারে আদালত।
আইন-আদালতের এই যুক্তি-তর্ক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই বিদেশের মতো এখন ভারতের বাজারেও পিতৃত্ব যাচাইয়ে ‘পেটারনিটি ডিএনএ টেস্টিং কিট’-এর চাহিদা ক্রমবর্ধমান। ভারতীয় বাজারে বিভিন্ন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে সুবিধাজনক দামে সহজেই মিলছে ঘরোয়া কিট। কিন্তু এই ঊর্ধ্বমুখী চাহিদাই গুরুতর প্রশ্নও তুলে দিয়েছে: পিতৃত্ব পরীক্ষা কেন একটি সাধারণ প্রয়োজন হয়ে উঠছে? এটি কি সম্পর্কের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাসের লক্ষণ, না কি স্বচ্ছতা এবং দ্বায়বদ্ধতার বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তন? এই প্রবণতা বাড়তে থাকলে, সম্পর্ক যেসব পারস্পরিক আস্থার উপর দঁাড়িয়ে থাকে, সেগুলি দুর্বল হয়ে পড়বে? পরিবার বলে হয়তো আর কোনও বন্ধন থাকবে না।
এসব ‘কিট’ সাধারণ প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিটের মতো নয়। বরং অনেকটা করোনা টেস্ট কিটের মতো। কিটে সংগৃহীত নমুনা সংস্থার ল্যাবে পাঠাতে হবে। ল্যাব অ্যানালিসিস করে রিপোর্ট দেবে গ্রাহককে। এক সময় পিতৃত্ব যাচাইয়ের যে ক্লিনিক্যাল পদ্ধতি আইনি জটিলতার আওতায় ছিল, এবং ব্যয়বহুলও ছিল যথেষ্ট– তা এখন সাধারণের হাতের মুঠোয়, যা একজন ব্যক্তিকে জৈবিক সম্পর্ক নিশ্চিত করার ক্ষমতা দেয়। আধুনিক পেটারনিটি ডিএনএ কিটগুলি ৯৯.৯৯ শতাংশ নির্ভুল রিপোর্টের দাবি করে। কঠোর ‘আন্তর্জাতিক মান’-এর স্বীকৃতি মেনে চলে এসব সংস্থা। সংস্থাগুলি রিপোর্টের সর্বাধিক গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিশ্রুতিও দিয়ে থাকে। পিতৃত্বের ডিএনএ টেস্ট কেন দৈনন্দিন চাহিদা হয়ে উঠল?
প্রথমত, সম্পর্কে অনাস্থা। জীবনসঙ্গীর প্রতি অবিশ্বাসের ক্রমবর্ধমান ঘটনাগুলি এই প্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। সামাজিক গতিশীলতা বাড়ছে, কিন্তু পারস্পরিক বিশ্বাস বা সম্পর্কের বৈধতা সম্পর্কে সন্দেহ এখনও মানুষের মনে শিকড় গেড়ে বসে আছে। সেই প্রবণতা থেকেই মানুষের বৈজ্ঞানিক স্পষ্টতা খোঁজার চেষ্টা।
দ্বিতীয়ত, আইনি এবং সামাজিক কারণ। হেফাজত, উত্তরাধিকার বা শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে আইনি লড়াইয়ে প্রায়ই পিতৃত্ব পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য নির্ভরযোগ্য জৈবিক পরীক্ষার
গুরুত্ব রয়েছে। তৃতীয়ত, কৌতূহল এবং পরিচয়। বংশগতি এবং ব্যক্তিগত পরিচয়ের প্রতি অতি আগ্রহের যুগে ডিএনএ পরীক্ষা জৈবিক শিকড় সম্পর্কে নিশ্চয়তা দেয়।
এই সহজলভ্য পিতৃত্ব-পরীক্ষা ‘ব্যক্তিক্ষমতার বিকাশ’ বলে গণ্য হলেও নৈতিক ও সামাজিক প্রশ্ন এড়ানো যাচ্ছে না। সংবেদনশীল ‘জেনেটিক ডেটা’ এর সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে, তথ্যের অপব্যবহার বা অননুমোদিত ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ থাকছেই। অপ্রত্যাশিত ফলাফল পারিবারিক বন্ধন দুর্বল বা ছিন্ন করতে পারে, মানসিক কষ্ট, এমনকী সামাজিক কলঙ্কের কারণ হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং এই পরীক্ষার চাহিদা ও অস্তিত্ব, ব্যক্তিগত সম্পর্কের অন্তর্নিহিত অবিশ্বাসের দিকে নির্দেশ করে, যা একটি বৃহত্তর সামাজিক চ্যালেঞ্জকেও প্রতিফলিত করছে।
সমাজবিজ্ঞানীদের মত, ‘পেটারনিটি ডিএনএ টেস্টিং কিট’-এর ক্রমবর্ধমান চাহিদা পারস্পরিক আস্থার সম্পর্কে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে কি বিশ্বাস নামক বোধটি বৈজ্ঞানিক প্রমাণের উপর ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে? মনোবিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এই ধরনের পরীক্ষার উপর নির্ভরতা সম্পর্কের ভিত্তিগত আস্থা নষ্ট করতে পারে। দাম্পত্য সম্পর্কে সন্দেহ ক্রমে অস্বাভাবিক রূপ নিতে পারে। তবে আইনি বিশেষজ্ঞদের যুক্তি, এই পরীক্ষার লভ্যতার সুবাদে পারিবারিক বিবাদে দীর্ঘ আইনি লড়াই এড়ানো যাবে।
পুনশ্চ প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের ডিএনএ টেস্ট অনুমতিসাপেক্ষ, তবে শিশু ও অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের ক্ষেত্রে ডিএনএ টেস্ট তার অধিকারকে লঙ্ঘন করতে পারে। তাছাড়া, সন্তানের মায়ের অনুমতি না-নিয়ে পিতৃত্বের ডিএনএ টেস্ট সেই মহিলার ব্যক্তি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপও বটে। তাই এই ধরনের কিট নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা এড়ানো যাচ্ছে না।