একসময়ে ভারতকে দেখলেই অন্য অবতারে ধরা দিতেন তিনি। ১৯৯৫ সালের এশিয়া কাপে ভারতের বিরুদ্ধে ১৯ রানে নিয়েছিলেন পাঁচ-পাঁচটা উইকেট। ভারতের বিরুদ্ধে চার বার ম্যাচের সেরা হয়েছেন। ১৯৯১ সালে শারজায় অনুষ্ঠিত উইলস ট্রফির ফাইনালে হ্যাটট্রিক-সহ সাত উইকেট দখল করেছিলেন তিনি। তাঁর আগুনে বোলিংয়ে ধস নামে ভারতীয় ইনিংসে। খুব সহজেই মরুশহরে মহম্মদ আজহারউদ্দিনের ভারতকে হারিয়ে সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল পাকিস্তান।
কে তিনি? তিনি পাকিস্তানের প্রাক্তন পেসার আকিব জাভেদ। শুক্রবার সন্ধেয় দূরভাষে যখন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হল, তখন টেলিভিশনের লাইভ শো করে সদ্য বেরিয়েছেন। এশিয়া কাপে ভারত-পাক আসন্ন ক্রিকেট মহাযুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠতেই প্রাক্তন পাক পেসার কালবিলম্ব না করে বলে উঠলেন, ”চলুন শুরু করা যাক।” তার পরের মিনিট কুড়ি দুই প্রতিবেশী দেশের শক্তি, দুর্বলতা, দেশের ফুটতে থাকা রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত-পাক ম্যাচের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করলেন বহু ক্রিকেট যুদ্ধের সৈনিক আকিব জাভেদ (Aaqib Javed)। শুনলেন সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালের প্রতিনিধি কৃশানু মজুমদার।
আগে আপনার ক্রিকেট জীবনের প্রসঙ্গে আসি। ভারতের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হলেই আপনার সেরাটা বেরিয়ে আসত। কারণটা কী?
আকিব জাভেদ: আই ইউজড টু লাভ ইন্ডিয়া (হাসি)। আসলে আমি ইনিংসের শুরুর দিকে বল সুইং করাতাম। ওই সুইং বল খেলতে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের সমস্যা হত। যেহেতু ফ্ল্যাট পিচে ওরা খেলে অভ্যস্থ তাই সুইং বল মোকাবিলা করতে সমস্যা হত। অ্যান্ডারসনও বহুবার সমস্যায় ফেলেছে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের।
উইলস ট্রফির ফাইনালে আপনি একাই ভারতকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। শচীন তেণ্ডুলকরও সেদিন আপনাকে সামলাতে পারেননি।
আকিব জাভেদ: তেণ্ডুলকর (Sachin Tendulkar) গ্রেট প্লেয়ার। আসলে কিছু বোলার ব্যাটসম্যানদের সামনে সমস্যা তৈরি করে। আমার আউটসুইংয়ের সামনে তেণ্ডুলকর কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্বস্তিতে পড়ে যেত।
সদ্যই দুই দেশ ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেছে। রবিবার ক্রিকেট মাঠে মুখোমুখি ভারত ও পাকিস্তান। আসন্ন ক্রিকেটযুদ্ধকে কীভাবে দেখছেন আপনি?
আকিব জাভেদ: ভারত ও পাকিস্তানের ম্যাচ যখনই হবে, তখনই উত্তেজনা হবে। কারণ দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহুদিন হল। ক্রিকেটভক্তদের অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতে হয় কবে আইসিসি-র কোনও টুর্নামেন্ট আসবে। কেবলমাত্র আইসিসি-র টুর্নামেন্টেই যে দুই প্রতিবেশী দেশ একে অপরের মুখোমুখি হয়। ভারত-পাক ম্যাচকে কেন্দ্র করে স্বাভাবিক ভাবেই দুই দেশের মানুষের মধ্যেই দারুণ উত্তেজনা, উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়।
গতবছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইতিহাসের চাকা ঘুরে গিয়েছে। প্রথম বার কোনও বিশ্বকাপে ভারতকে হারায় পাকিস্তান। আর এই ম্যাচ জেতার ফলে পাকিস্তানের ক্রিকেটপ্রেমীদের উৎসাহ বেড়ে গিয়েছে বহুগুণে। এই ধরনের ম্যাচে দুটো দলের উপরেই চাপ থাকে। কিন্তু আমার মনে হয় শেষ সাক্ষাতে যে রেজাল্ট হয়েছে, তার প্রভাব পড়তে চলেছে রবিবারের ম্যাচে। এই ম্যাচ কোনও দলই হারতে চায় না। কিন্তু যে দল হেরে যায়, সেই দলকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সমর্থকরা গালমন্দ করতে শুরু করে দেয়। এরকম পরিস্থিতিতে বাড়তে থাকে চাপ। আর যে দল জিতে যায়, একরাতের মধ্যেই তো সেই দলের সদস্যরা নায়কের সম্মান পায়।
কিছুদিন আগে ভারত (India) ও পাকিস্তান (Pakistan) ৭৫-তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে আমাদের ভাবার সময় এসে গিয়েছে, এই দুশমনি-দুশমনি করে কী লাভ হল? কার লাভ হল? দুশমনির পরিবর্তে বন্ধুত্বের কথা ভাবার সময় এখন। আমার মনে হয়, ক্রিকেট ডিপ্লোম্যাসির ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক ভালই হয়েছিল। যাই হোক, পরের প্রশ্ন করুন।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির। এই অবস্থায় দু’ দেশের মধ্যে খেলা হচ্ছে। ম্যাচ নিয়ে উৎসাহ রয়েছে দেশে?
আকিব জাভেদ: আমাদের এখানে সমস্যা তো রয়েইছে। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যখনই খেলা হয়, তখন মানুষ সব কিছু ভুলে যায়। সব কিছু বন্ধ করে দেয়। দুই প্রতিবেশী দেশ খেলার উপরে ফোকাস করে, প্রবেলমের কথা মাথা থেকে বেরিয়ে যায় মানুষজনের। পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, নিজের নিজের দেশকে সাপোর্ট করে দুই দেশের মানুষ। ক্রিকেটে ডুবে যায় সবাই।
[আরও পড়ুন:বাইরের চাপ নিয়ে বেশি ভাবার দরকার নেই, এশিয়া কাপের আগে রোহিতদের পরামর্শ সৌরভের]
ধরুন রবিবার আপনি বল করবেন রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিদের। আপনার স্ট্র্যাটেজি কী হবে?
আকিব জাভেদ: আমার স্ট্র্যাটেজি খুব সিম্পল। এই ম্যাচের চাপ তো আছেই। কিন্তু চাপের মুখে শান্ত থাকতে হবে। এটাই মূল মন্ত্র হওয়া উচিত। আমার কথাই ধরুন না। আমি সব সময়ে ভারতের বিরুদ্ধে ভাল খেলেছি। আই এনজয়েড দ্য ক্রাউড, এনজয়েড দ্য সিচুয়েশন। চাপ থাকলেও তা উপভোগ করা এবং ম্যাচের উপরে সম্পূর্ণ ফোকাস করাই উচিত। এই মানসিকতা নিয়েই ছেলেদের খেলতে নামা উচিত।
এবার ম্যাচের বল গড়ানোর আগেই কিন্তু দুঃসংবাদ পাক শিবিরে।
আকিব জাভেদ: সেটাই। গতবছর পাকিস্তানের কাছে হেরে যাওয়ায় কিছুটা হলেও চাপ ছিল ভারতের উপরে। দুর্ভাগ্যক্রমে শাহিন শাহ আফ্রিদি চোট পাওয়ার পরে চাপ অনেকটাই কমে গিয়েছে ভারতের উপর থেকে, ভারতের টপ অর্ডারের উপর থেকে। ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে মহম্মদ আমিরের দুর্দান্ত স্পেল ম্যাচ থেকে ছিটকে দিয়েছিল ভারতকে। একইভাবে গতবছর অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শাহিন শাহ আফ্রিদির ধাক্কায় ভারত বেসামাল হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হয় বল মুভ করালে, হাওয়ার সাহায্য নিয়ে ম্যাক্সিমাম সুইং করালে সমস্যায় পড়ে যায় ভারতীয় ব্যাটাররা। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি ভারতীয় ব্যাটারদের বেশি ঝামেলায় ফেলে সুইং বোলাররা। ফ্ল্যাট পিচে খেলে অভ্যস্থ ভারত। আউটসুইং করিয়ে ভারতকে বহুবার আমি সমস্যায় ফেলে দিয়েছিলাম। ভারতের বিরুদ্ধে সুইং করানোর উপরে জোর দিতে হবে পাক বোলারদের। বল সুইং করানোর ক্ষমতা রয়েছে আমাদের নাসিম শাহের। ভারতীয় ব্যাটারদের সামনে সমস্যা তৈরি করতে পারে ও।
গতবছর শাহিন আফ্রিদিকে সামলাতেই পারল না ভারত। আইপিএলে পাকিস্তান ছাড়া সব দেশের ক্রিকেটাররা খেলে। পাক বোলারদের কম খেলার জন্যই কি সমস্যায় পড়তে হয়েছে ভারতকে?
আকিব জাভেদ: আপনি ভাল করে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবেন, আইপিএলে (IPL) ব্যাটিং পিচে খেলা হয়। যদি তুলনা করা হয় আইপিএল ও পিএসএলের (PSL) মধ্যে তাহলে আমি বলব পিএসএলের বোলিং স্ট্যান্ডার্ড আইপিএলের থেকে ঢের ভাল। পাকিস্তান সবসময়তেই কোয়ালিটি ফাস্ট বোলারের জন্ম দিয়েছে। আপনার বোলারের যদি পেস থাকে, সুইং থাকে, তাহলে পৃথিবীর যে কোনও ব্যাটারকেই চ্যালেঞ্জ জানানো সম্ভব।
আপনার প্রাক্তন ক্যাপ্টেন ইমরান খান বলতেন, বোলাররাই ম্যাচ জেতায়। এশিয়া কাপে ভারতের বিরুদ্ধে নামার আগে আপনাদের বোলিং বিভাগ কিন্তু দুর্বল।
আকিব জাভেদ: শাহিন না থাকায় পাকিস্তানের বোলিং নিঃসন্দেহে দুর্বল হয়ে গিয়েছে। তবে হারিস রাউফ আছে। ও ঘণ্টায় ১৪০-১৫০ কিমি বেগে বল করতে পারে। রিভার্স সুইং করাতে পারে। ভারতকে ঝামেলায় ফেলে দিতে পারে হারিস। তাছাড়া নাসিম শাহ নতুন বলে বেশ ভাল সুইং করাতে পারে। পাকিস্তান ও ভারতের বোলিংয়ের যদি তুলনা করা হয় তাহলে আমি বলব ভারতের কাছে এমন কোনও বোলার নেই যে ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারে। ভুবনেশ্বর কুমার আছে ঠিকই। তবে ও মিডিয়াম পেসার। অন্যান্য বোলার যারা রয়েছে, তারা নামী নয়। ভারতের বোলিং বিভাগে প্রতিষ্ঠিত নামজাদা কোনও বোলার নেই। ঘটনা হল, নামী কোনও প্লেয়ার খেললে তার নামের একটা চাপ সবসময় থেকে যায় প্রতিপক্ষের উপর। ওয়াসিম আক্রম যখন খেলত, তখন ওর নামটাই ব্যাটসম্যানদের চাপে ফেলে দিত। ভয় ধরিয়ে দিত। দীর্ঘদিন বাদে এত দুর্বল ভারতীয় বোলিং আক্রমণ দেখছি।
তাহলে রবিবারের ম্যাচে কে এগিয়ে? কেইবা পিছিয়ে?
আকিব জাভেদ: দুটো দলের যদি তুলনা করা হয়, তাহলে বলব পাকিস্তানের বোলিং জবরদস্ত। আবার ভারতের ব্যাটিং বিভাগ বেশ শক্তিশালী। পাকিস্তানের ব্যাটিং টপ থ্রি ব্যাটারের উপরে নির্ভরশীল। বাবর আজম, মহম্মদ রিজওয়ান এবং তিন নম্বরে নামা ফকর জামানই দলের ভাল ব্যাটার। পাকিস্তানের মিডল অর্ডার একদমই শক্তিশালী নয়। শোয়েব মালিককে রাখাই যেত চার নম্বরে। কিছু কিছু সময়ে অভিজ্ঞতাকে দাম দিতে হয়। মিডল ওভারে অভিজ্ঞ ক্রিকেটারকে দলে রাখতে হয়। পাকিস্তানের মিডল অর্ডার উইক লিংক। ভারতীয় ব্যাটিংয়ের ক্ষেত্রে বলব বিরাট কোহলি ভাল ফর্মে নেই। পাকিস্তানকে যদি ম্যাচ জিততে হয়, তাহলে দ্রুত উইকেট তুলে নিতে হবে। বিরাট ক্রিজে এসে মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য সময় নেবে। তখন ওর উপরে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এটাই স্ট্র্যাটেজি হওয়া উচিত পাকিস্তানের। আমার মনে হয় ম্যাচের দিন এই স্ট্র্যাটেজিই নেওয়া হবে। ভারতের উইকেট দ্রুত তুলে নিয়ে বিরাটের উপরে চাপ তৈরি করো।
আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, ম্যাচ না খেলে বিরাট কোহলি বিশ্রাম নিচ্ছেন। আপনি কি বিরাটের এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন?
আকিব জাভেদ: বিরাটকে আরও একটা সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। দীর্ঘদিন ধরে ও খেলছে। ভারতের জন্য অনেক কিছু করেছে বিরাট। তবে এটাও আমার মনে হচ্ছে, ফিরে আসার জন্য এই হয়তো শেষ সুযোগ বিরাটের কাছে। সিলেকশন ক্রাইটেরিয়ার প্রসঙ্গই যদি আসে তাহলে বলব অন্য ব্যাটার যারা নিয়মিত খেলছে, পারফর্ম করছে, তাদের বসিয়ে রেখে যদি বিরাটকে কেবলই সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে সেটা ঠিক নয়।
আপনি কিন্তু বললেন না কে এগিয়ে আর কে পিছিয়ে?
আকিব জাভেদ: ভারতের বোলিং দুর্বল। ব্যাটিংয়ে কিন্তু গভীরতা রয়েছে। পাকিস্তানের বোলিং আবার শক্তিশালী। প্রথম তিন জন ব্যাটারের উপর বড্ড বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল পাক-ব্যাটিং। সব দিক বিচার করে দেখলে আমার মনে হয় ম্যাচ ফিফটি-ফিফটি।