প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে ধারাবাহিকতার অভাব কেন? একবার মেরুকরণ উসকে দিতে বক্তব্য রাখছেন, একবার মুসলিম-সহিষ্ণু বক্তব্য, তো একবার উগ্র হিন্দুত্বের সংঘ রাজনীতি! এই উত্থানপতন কি দেশের নানা প্রান্তের নানা জনসমাজের কথা ভেবে সচেতনভাবে তৈরি করা? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।
২১ এপ্রিল। ২০২৪। প্রথম দফার ভোটের ঠিক দু’দিন পরের কথা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (PM Modi) রাজস্থানের বান্সওয়াড়াতে বলেছিলেন– কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা দেশের সম্পদের উপর প্রথম অধিকার মুসলিমদের হাতে ছেড়ে দিত। যারা বেশি সন্তানের জন্ম দেয়, তাদেরকে এবং অনুপ্রবেশকারীদের মধে্যও বণ্টন করে দিত সেই সম্পদ। আপনারা কি চান, আপনাদের কষ্টার্জিত অর্থ অনুপ্রবেশকারীদের মধে্য বণ্টন করে দিতে? আপনারা কি চান আপনাদের কষ্টার্জিত অর্থ হাতছাড়া হোক? এটি আর্বান নকশালদের ভাবনা। এরা মা-বোনদের মঙ্গলসূত্রকেও ছাড়বে না।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তবে্য আমরা বিস্মিত হইনি। বিচলিত হয়নি। কারণ এটাই বিজেপির (BJP) পার্টি লাইন। এটাই তাদের মতাদর্শ। এই কারণেই গোধরা কাণ্ডের পর নরেন্দ্র মোদি ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’ হয়ে ওঠেন। এই কারণেই ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনী প্রচারের সময় লিখেছিলাম দেশের মানুষ চাইছে ‘মোদিত্ব’। মোদিত্ব কাকে বলে? মোদিত্ব: হিন্দুত্ব + শক্তিশালী এক রাষ্ট্রবাদ।
[আরও পড়ুন: সোনিয়ার গ্রেপ্তারি চেয়েছিলেন কেজরি, AAP-কে ভোট দিয়ে প্রিয়াঙ্কা বললেন, ‘আমরা গর্বিত’]
চলতি লোকসভা (Lok Sabha Election 2024) ভোটপর্বে ২৬ এপ্রিল ছিল দ্বিতীয় দফার ভোট। তার ঠিক চারদিন পর, ৩০ এপ্রিল, তেলেঙ্গানার জাহিরাবাদে মোদি বললেন– ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে কংগ্রেস সংবিধানকে অসম্মান করে। তাদের বলে দিতে চাই, আমি যত দিন বেঁচে আছি, তা হতে দেব না। আমি দলিত, এসসি, এসটি ও ওবিসি-দের জন্য যে-সংরক্ষণ চালু আছে, তা তুলে দিয়ে ধর্মের নামে মুসলমানদের সংরক্ষণ দিয়ে দিতে দেব না। তৃতীয় দফার ভোটের চারদিন আগে ৩ মে মোদি গুজরাতের আনন্দে বললেন– বিরোধী জোট মুসলিমদের বলছে ‘ভোট জিহাদ’ করতে। আমরা তা হতে দেব না।
এই পর্যন্ত তানপুরা একই সুরে বঁাধা ছিল। রাজে্য রাজে্য, বিশেষত যেসব প্রান্তে সংখ্যালঘু মুসলিম জনসংখ্যার শতকরা হার বেশি– সেসব রাজে্য কংগ্রেস ও আঞ্চলিক নেতারা মোদির এহেন বিবৃতি ‘সাম্প্রদায়িক দোষে দুষ্ট’ বলে আওয়াজ তুললেন। নির্বাচন কমিশনের কাছেও নালিশ গেল। এই ধুলোঝড়ের মধে্যই ১৪ মে নিজের মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার পর মোদি বললেন, আমি মুসলমান সমাজের বিরুদ্ধে কোনও দিন কিছু বলিনি। ১৪ মে এ-মন্তব্য করার পরই ১৫ মে মহারাষ্ট্রর ডিন্ডোরির সভায় তিনি বললেন– আগের কংগ্রেস সরকার বাজেটের ১৫ শতাংশ দিয়ে দিতে চেয়েছিল মুসলমানদের। বলা বাহুল্য, রামমন্দির-কেন্দ্রিক ভাষ্য থেকে তিনি পুরোপুরি হিন্দু-মুসলিম কেন্দ্রিক ভাষ্যকেই অঁাকড়ে ধরেছেন এবারের ভোটপ্রচারে। বিরোধীদের মত, দেশের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। সেই বাস্তব পরিস্থিতির অসন্তোষ ভোলাতেই মোদি হিন্দু-মুসলিম কেন্দ্রিক ভাষ্যকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
[আরও পড়ুন: পুরুলিয়ায় ৫টি ইভিএমে বিজেপির ট্যাগ, পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তলব কমিশনের]
প্রশ্ন হল, মোদি হিন্দু-মুসলমান বিরোধে বিশ্বাস করেন না বলে আবার হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের আলেখ্যতেই ফিরে আসছেন কেন বার বার? কংগ্রেস ও বিরোধী নেতারা এবার বলতে শুরু করলেন– মোদি আবার ক্ষমতায় এলে ভারতের সংবিধান বিজেপি আমূল বদলে দেবে। ভারত হয়ে যাবে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’। হিন্দু ধর্মকে ‘সেমেটিক’ ধর্মে রূপান্তর করে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সমসত্ত্বধর্মী কাঠামোর উপর দঁাড়িয়ে এক ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র নির্মাণের দিকে অগ্রসর হবে। হিন্দু ধর্মের বৈচিত্রও তা-ই বিজেপির সমস্যা। আমাদের ছাত্রজীবন থেকে বিজেপি সম্পর্কে এই বক্তব্য কমিউনিস্টদের কাছ থেকে শুনে আসছি। কিন্তু এবার ভোটপর্বে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের এই অভিযোগ খণ্ডন করে বিজেপি শীর্ষ নেতারা বলেছিলেন– ভারতীয় সংবিধান অবিকৃত, অটুট থাকবে না, বিজেপির এমন কোনও অভিসন্ধি নেই। আবার প্রশ্ন জাগে, বিজেপিকে কেন এত রক্ষণাত্মক হতে হল? জবাব দেওয়ার এহেন রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিজেপির স্টাইল তো নয়।
২২ মে নির্বাচন কমিশন আদেশ জারি করে জানাল, বিজেপির ‘স্টার’ প্রচারকরা যেন ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক লাইনে প্রচার না চালান। জে. পি. নাড্ডা দলের সভাপতি, তাই কমিশন তঁার কাছেই এ ব্যাপারে নোটিস পাঠাল। আবার বিজেপির নালিশের ভিত্তিতে কমিশন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেকেও নোটিস পাঠিয়ে জানাল, বিজেপি ক্ষমতায় এলে সংবিধান ধ্বংস করে দেবে এমন প্রচারও যেন কংগ্রেস না-করে। মোদি, রাহুল বা খাড়গের নাম না-করে দুই প্রধান বড় দলের সভাপতিকে নোটিস দিয়ে কমিশন জানিয়েছে, যেন তাদের স্টার প্রচারকরা এহেন প্রচার না করে।
প্রশ্ন উঠেছে, একাধারে মুসলিম-বিরোধী প্রচার চালিয়ে হিন্দু ধর্ম ভিত্তিক ভোটকে আরও সুসংহত করার মেরুকরণ রাজনীতি করে, অপর দিকে মোদি ও বিজেপি উদার সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলছে কেন? ‘ফেজ’ পরতে যে-মোদি কোনও দিন রাজি হননি, তিনি হঠাৎ মুসলমান দরদি হয়ে উঠছেন কেন? ‘বিশ্বগুরু’ ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক স্তরে কালিমালিপ্ত হতে পারে ভেবে? কেন না মোদি আরব দুনিয়া ও তুরস্ক থেকে সৌদি, দুবাই প্রতিটি ইসলামিক রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করছেন। আলিঙ্গনে তঁাদের সঙ্গে অাবদ্ধ হয়ে ‘ভাইজান’ সম্বোধন করছেন।
এদিকে এ-বছরের লোকসভা ভোটপ্রচারে বিজেপি বাংলায় মুসলিম ও ওবিসি সম্প্রদায়ের সংশাপত্র বাতিলের হাইকোর্ট রায় নিয়ে মমতা-বিরোধী প্রচার চালাচ্ছে। সে ভোটপ্রচারও হিন্দু-মুসলিম বিষয়কেন্দ্রিক। ভোট শুরুর সময় ‘বিকশিত ভারত’-এর উন্নয়ন ছিল বিজেপির প্রচারের অগ্রাধিকার। আর এখন অগ্রাধিকার হিন্দু-মুসলমান, মঙ্গলসূত্র, ধর্মভিত্তিক সংরক্ষণ। ভোটের শেষ পর্বে প্রধানমন্ত্রী দিল্লি ভোটের মুখে নিশানা করলেন জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে। সেখানে মুসলিম পড়ুয়াদের জন্য সংরক্ষণ তিনি তুলে দেওয়ার পক্ষে। কলকাতায় এসে অমিত শাহ বলছেন, মা-মাটি-মানুষ নয় মোল্লা-মাদ্রাসা-মাফিয়ায় হালে ভরে গিয়েছে পশ্চিম বাংলা। এসব দেখে অনেকের প্রশ্ন– এবার ভোটে মোদির বক্তবে্য ধারাবাহিকতার অভাব কেন? তঁার ভাষ্য কেন এত দ্রুত বদলাচ্ছে? কেন তা একবার তঁার পার্টি লাইনের অনুকূল চিরাচরিত হিন্দু-মুসলমান বিরোধে যাচ্ছে, পর মুহূর্তে সেখান থেকে সরে এসে মুসলিমদের প্রতি আপাত-সহিষ্ণু হচ্ছে?
ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, এই বিবিধ মন্তব্যর উত্থান-পতন আসলে মোদির ভাষ্যর ধারাবাহিকতার অভাব নয়, এটি হল দ্বিমুখী রণকৌশল। ২০১৪ এবং ২০১৯-এর পরিস্থিতি আর ২০২৪-এর দেশীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক নয়। তাই দেশের নানা প্রান্তে আলাদা আলাদা জনসমাজের কাছে নানা ধরনের মোদিকে তুলে ধরতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদি। বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য দিয়ে প্রচারকে ‘মিক্সড প্ল্যাটার’ করতে চাইলেও বিজেপি প্রধানত নির্ভরশীল উগ্র-হিন্দুত্বর প্রচারে এবং মুসলিম সংখ্যালঘু তোষণের বিরোধে। দেশে এই হিন্দু-মুসলমান বিরোধে বিজেপির লাভ কী হবে জানি না, কিন্তু বাংলায় এই কৌশল বুমেরাং হতে পারে।