বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর তীব্র নির্যাতন চলছে। যদি প্রতিবাদী না হই, তাহলে আগামী কাল ভারতের মাটিতে সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের মুখে পড়লে, আমার তখন প্রতিবাদী হওয়ার মুখ থাকবে না। বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের আর কোনও অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আমাদের দেশে তো রয়েছে! লিখছেন সৈয়দ তনভির নাসরিন।
মুনীর চৌধুরীর লেখা ‘দিনপঞ্জি-মনপঞ্জি-ডাকঘর’ বইটা পড়ছিলাম। কবীর চৌধুরীর ছোট ভাই মুনীর চৌধুরীর লেখা এই বইটি আসলে তাঁর স্ত্রী লিলি মির্জার সঙ্গে চিঠির আদানপ্রদান। তাঁর পুত্র আসিফ মুনীর স্পষ্টভাবে বলেছেন, তাঁর বাবাকে ১৯৭১-এর সেই অভিশপ্ত দিনে ‘রাজাকার’-রা তুলে নিয়ে গিয়েছিল। বইটা পড়তে-পড়তে ভাবছিলাম, এই বছর বাংলাদেশ সেই ১৪ ডিসেম্বরকে কীভাবে উদ্যাপন করবে? কারণ, এখনকার বাংলাদেশে ‘রাজাকার’দের ঘৃণা করার এবং যারা ‘মুক্তিযুদ্ধ’-র বিরুদ্ধে ছিল, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস সকলের আছে তো? প্রশ্নটা এই কারণে আরও উঠল, এবার ১৬ ডিসেম্বরকে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার ‘বিজয় দিবস’ হিসাবে উদ্যাপন করবে কি না, বা ভারতের সঙ্গে যুগ্মভাবে যেসব অনুষ্ঠান হয়, সেগুলো করবে কি না, তার কোনও খবর নেই। প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী যতটা উদ্যাপন করে, ততটাই উদ্যাপন করে সেই সময়কার মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু এই বছর কী হবে? বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, ছাত্ররা ‘রিসেট বাটন’ দেগে দিয়েছে। কিন্তু সেই ‘রিসেট বাটন’-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা, তার গোটা ইতিহাস সবই গুলিয়ে যাচ্ছে না তো?
মুহাম্মদ ইউনুস এবং জো বাইডেন। আশি পেরিয়ে যাওয়া দুই রাষ্ট্রপ্রধান। মুহাম্মদ ইউনুসকে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’-ই বলছি, কারণ, তিনিও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান। এই দুই অশীতিপর রাজনীতিককে ২০২৪ সালে মনে রাখব দু’টি দেশে চলা ‘নারকীয়’ ঘটনায় মদত দেওয়ার জন্য। জো বাইডেন বসে বসে দেখেছেন, ইজরায়েল কী ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে প্যালেস্টাইে। আর, মুহাম্মদ ইউনুস একটি শব্দও উচ্চারণ করছেন না বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে, মন্দির ভাঙা নিয়ে, বৌদ্ধ ধর্মস্তূপে আক্রমণের ঘটনা নিয়ে। আসলে কিন্তু জো বাইডেন বাংলাদেশের জন্যও দায়ী। কারণ, তিনি এবং তাঁর আর-এক রাজনৈতিক সহযোগী হিলারি ক্লিনটন-ই মুহাম্মদ ইউনুসকে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ থেকে রাষ্ট্রপ্রধানের পদে বসিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন। জো বাইডেনকে যেমন পৃথিবীর মুসলমানরা কোনও দিন ভুলে যাবে না গাজায় ইজরায়েলি বাহিনীর দিনের-পর-দিন ধ্বংসলীলা চালানোর জন্য, বা তখন মার্কিন প্রশাসন কী ভূমিকা নিয়েছিল সেজন্য, তেমনই কোনও দিন মুহাম্মদ ইউনুসকে অর্থনীতিবিদ রূপে মনে রাখবে না; বরং মনে রাখবে, তিনি একজন ব্যর্থ রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি ১৬ কোটি মানুষের একটি দেশের দেড় কোটি মানুষকে নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন।
কেন আমি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে প্রতিবাদ করব? কারণ, যদি আমি প্রতিবাদ না-করি, তাহলে এখন বাংলাদেশে যা হচ্ছে, একটি হিন্দু মেয়েকে জোর করে ধর্মান্তরকরণে বাধ্য করা হচ্ছে, আগামী কাল যদি সেই ঘটনা ভারতে আমার পরিচিত কারও সঙ্গে হয়, তাহলে প্রতিবাদ করার মুখটি আমার থাকবে না। ঠিক যে-কারণে সাম্ভাল কিংবা আজমীঢ়ের দরগায় যারা মাটি খুঁড়ে মন্দিরের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে মসজিদকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে চায়, আমি তাদের সমালোচনা করি; ঠিক তেমনই বাংলাদেশে যারা রোজ কোনও-না-কোনও অজুহাতে মন্দির ভাঙছে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে তাদের উপর আক্রমণ করছে, তাদেরও আমি সমালোচনা করব। এটাই গান্ধী, নেহরু এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদের কাছ থেকে শেখা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া উত্তরাধিকার। যদি আমি নিজের ভারতীয় সত্তা নিয়ে গর্বিত হই, তাহলে প্রতিদিন বাংলাদেশে ঘটে চলা প্রতিটি ঘটনা আমাকে ক্ষুব্ধ করবে, বিদ্ধ করবে এবং প্রতিবাদের জন্য বাধ্য করবে।
যাঁকে নিয়ে এই লেখার সূচনা করেছিলাম, সেই মুনীর চৌধুরী বামপন্থী ছিলেন, কিন্তু ‘বাঙালি অস্মিতা’-র জন্য তিনি এতবার কথা বলেছিলেন যে, সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানে বারবার তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল। জানা নেই, এই বাংলার তথাকথিত বাম এবং অতিবামরা এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে কী ভাবছে? ‘রাজাকার’ বা ‘আল-বদর’ শব্দ নিয়ে তারা কতটা চিন্তিত? জানা নেই তারা মুনীর চৌধুরীকে আর স্বীকার করে কি না? এই বাম বা অতিবামদের সঙ্গে আমি ভেসে যেতে চাই না। চাই না, কারণ, ভারতের সংবিধান, ভারতের জাতীয় পতাকা আমাকে যে অধিকার, যে সম্মান এবং যে স্বাধীনতা দিয়েছে, আমি তা নিয়ে গর্ববোধ করি। এবং সেই কারণেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা এবং ভারতের জাতীয় পতাকার অবমাননাকে অপমান হিসাবেই দেখব।
এই উপমহাদেশের ইতিউতি কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করার সুবাদে জানি, ভারতের জাতীয় পতাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং যারা সেই জাতীয় পতাকাকে ‘গুরুত্বহীন’ করে দিয়ে ‘ওটা কোনও অসম্মানই নয়’ বলে প্রচার করতে চাইছে, আমি সবিনয়ে বলব, তারা আসলে জানে না, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, কখনও অলিম্পিকে, কখনও এশিয়ান গেমসে, যখন ভারতের জাতীয় পতাকা ওঠে, তখন কী আবেগ আমাদের প্লাবিত করে দিয়ে যায়! কেন আমার চোখের জলের বাঁধ মানে না যখন বন্ধুর কাছে কার্গিলের সেই বিজয়লগ্নে ভারতের জাতীয় পতাকা তোলার ছবি দেখি। বারবার দেখি। যদি জাতীয় পতাকাকে সম্মান না-করতে পারি, তাহলে জাতীয় সংগীত নিয়ে ভাবব কী করে? এই জায়গা থেকে বুঝতে পারি, বাংলাদেশে যা হচ্ছে, তা কখনওই গণতন্ত্র অথবা ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। কলকাতা থেকে ঢিল-ছোড়া দূরত্বে একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র, তাকে নিয়ে আমরা চিন্তিত। এবং অবশ্যই সেখানকার সংখ্যালঘুদের উপর দিনের-পর-দিন যে ঘটনা ঘটে চলেছে, তা নিয়ে ক্ষুব্ধ।
পাকিস্তানের বিখ্যাত সাংবাদিক বাবর আয়াজের একটি বইয়ের নাম ‘হোয়াটস রং উইথ পাকিস্তান?’ আমাদের পশ্চিমের প্রতিবেশীর কী অবস্থা, সেটা আমরা দীর্ঘদিন ধরে জানি। বেহাল অর্থনীতি, সেনাবাহিনীর অঙ্গুলিহেলনে সব চলা, মৌলবাদের উত্থান– পাকিস্তানকে নিত্যদিন আরও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর, গত কয়েক বছর ধরে আমেরিকার কলকাঠি নাড়ায় ইমরান খান সরে যাওয়ার পর থেকে ‘তেহরিক-ই-ইনসাফ’-এর সমর্থক, যারা হয়তো পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদের সঙ্গে আমেরিকার নির্দেশে বসা শাসকদের নিত্যদিন সংঘাত চলছে। কিন্তু এত দিন পূর্বের প্রতিবেশীকে নিয়ে আমরা কিছুটা নিশ্চিন্ত ছিলাম।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিকরা কলকাতায় এসে গর্ব করে অনেক কিছু বলতেন। বলতেন, তাঁদের নাগরিক সমাজ কত ঋদ্ধ হয়েছে, নাগরিক সমাজ কত প্রভাবশালী হয়েছে। গত কয়েক মাসের বাংলাদেশের ঘটনা দেখিয়ে দিল বাংলাদেশও আসলে একটা ‘ফেলড স্টেট’ হওয়ার দিকে যাচ্ছে। এবং যে ‘ফেলড স্টেট’-এ, যে ব্যর্থ রাষ্ট্রে, ‘নাগরিক সমাজ’ বলে আসলে কিছু নেই। নাগরিক সমাজ থাকলে তো প্রতিবেশীর মেয়েকে জোর করে ধর্মান্তরের জন্য তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় কেউ-না-কেউ বাধা দিত। যে-বিশ্বাস আমরা ভারতীয়রা প্রত্যহ হৃদয়ের মধ্যে লালন করি বলে ভারতে থাকি, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ কি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের সেই নিরাপত্তা দিতে পারল?
ধর্মের ভিত্তিতে যখন ভারত ভাগ হচ্ছিল, তখন ভারত ত্যাগ না-করার জন্য মুসলমানদের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন কংগ্রেসের অবিসংবাদী নেতা মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সেদিন দিল্লির জামা মসজিদে দাঁড়িয়ে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই ভাষণ শুনতে আমার মাতামহ সদলবলে দিল্লি চলে গিয়েছিলেন। এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদের বক্তব্য শুনে আমার মাতামহ, সৈয়দ সিরাজ আলি, নিশ্চিত হয়েছিলেন কেন ভারতেই তাঁদের থেকে যাওয়া উচিত। সাতক্ষীরার দিকে জমিজমা, সরকারি চাকরির নিরাপত্তা– এসব কিছুকে অতিক্রম করে আমাদের পরিবার বর্ধমানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রায় সাত দশকের ব্যবধানে এখন আমি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করছি এবং গর্বিত হচ্ছি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কতটা সঠিক ছিলেন, আমার মাতামহ কত সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে সেদিন চলে গেলে একটি বাঙালি-মুসলিম পরিবার হিসাবে আমাদের ইতিহাসকে কতবার যে ‘রিসেট’ করতে হত, সেটা ভেবেই আতঙ্ক চরম-বিন্দুতে উপনীত হচ্ছে।