বিশ্বদীপ দে: খালি চোখে তারা অদৃশ্য়। সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণুই যে এমন বিপুল শক্তির ভাণ্ডার, তা একসময় ছিল মানুষের কল্পনারও বাইরে। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (2nd World War) ইতিহাস ঘাঁটতে বসলেই হিটলার, নাৎসি, রুশ লালফৌজ থেকে শুরু করে পার্ল হারবার কিংবা আরও বহু স্থান ও চরিত্রের পাশাপাশি অবধারিত ভাবে উঠে আসবে পরমাণু বোমার (Atomic bomb) কথা। যুদ্ধ প্রায় সভ্যতার গোড়া থেকেই মানুষের কাছে এক অনিবার্য নিয়তি। কিন্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ধ্বংস ও ক্ষয়ের যে ছবি এঁকেছিল তেমনটা আর কখনও হয়নি। আর সেই ছবির মধ্যে সবচেয়ে ভয়প্রদ ছবি বোধহয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের নিধন যজ্ঞ এবং হিরোশিমা-নাগাসাকির ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ মৃত্যুলীলা। আর পরমাণু বোমার কথা বলতে বসলে ‘পরমাণু বোমার জনকে’র কথাও আসবেই। তিনি জে রবার্ট ওপেনহাইমার (J. Robert Oppenheimer)। এমন এক মানুষ যাঁকে ঘিরে বিতর্কের শেষ নেই। অথচ সবকিছু মিলিয়েই তিনি একজন ট্র্যাজিক চরিত্র। আমেরিকাকে পরমাণু বোমা উপহার দিয়েও তিনি পেয়েছিলেন দেশদ্রোহীর তকমা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ঘিরে জন্ম নেওয়া বহু বিষণ্ণ আখ্যানের মতোই সেও এক করুণ ইতিহাস।
কিন্তু কেন এভাবে রাষ্ট্রের চোখে বদলে গিয়েছিলেন ওপেনহাইমার? সেকথায় আসার আগে চলে যেতে হবে গত শতকের তিনের দশকে। না হলে পুরো বিষয়টি বোঝা যাবে না। আসলে পারমাণবিক বিভাজন বা নিউক্লিয়ার ফিশনের মতো বিক্রিয়ায় নিউক্লিয়াস নিউট্রন ও কম ভরবিশিষ্ট নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। কমে যাওয়া ভর থেকে তৈরি হয় বিপুল শক্তি। সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কী করা সম্ভব তার আঁচ পেয়ে গিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা! আর এরপরই শুরু হয় এক ‘দৌড়’! কে আগে বানাতে পারে পারমাণবিক বোমা। ১৯৩৮ সালে দুই জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রিৎজ স্ট্রাসম্যান ও অটো হান পারমাণবিক বিভাজন ঘটাতে সফল হন গবেষণাগারে। আর এরপর তাঁরা যেন নীরব হয়ে গেলেন। জার্মানির কোনও বিজ্ঞানীই কোনও জার্নালে এই বিষয়ে কিচ্ছু লিখছিলেন না। বছর ঘুরতেই শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দেখা গেল জার্মানির দখলে থাকা চেকোস্লোভাকিয়ার খনি থেকে বন্ধ হয়ে গেল তেজস্ক্রিয় মৌল ইউরেনিয়ামের বিক্রি। আর তাই মার্কিন বিজ্ঞানীরা দুইয়ে দুইয়ে চার করে নিলেন। ধরে নিলেন হিটলারের (Adolf Hitler) হাতে এবার উঠতে চলেছে পরমাণু বোমা!
[আরও পড়ুন: হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের পরই সিদ্ধান্ত বদল, অবসর প্রত্যাহার তামিমের]
আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতেই আমেরিকায় আশ্রয় নেওয়া তিন ইহুদি বিজ্ঞানী চিঠি লিখেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। কেবল তাঁরাই নন, চিঠি লিখলেন খোদ আইনস্টাইনও (Albert Einstein)। তাও একটি নয়। দু’টি। তাঁদের আরজিতে সাড়া দিয়ে শেষ পর্যন্ত বোমা তৈরির নির্দেশ দিলেন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। গঠিত হল ‘ম্যানহাটন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিস্ট্রিক্ট’। আর এই বোমা তৈরির ক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্বই দেওয়া হল ওপেনহাইমারকে। তবে এখানে একটা গোলমাল রয়েছে। জার্মানি কিন্তু পারমাণবিক বিভাজন রপ্ত করেও বোমা তৈরি থেকে ছিল বহু দূরে। কিন্তু আমেরিকার উৎকণ্ঠার পারদ ক্রমেই বাড়ছিল। হিটলার নামের লোকটা পরমাণু বোমা হাতে পেলে সে দুনিয়ার দফারফা করবেই। সুতরাং আগে নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডারে মজুত করে ফেলতেই হবে ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। তাদের এতটা দ্রুততার আসলে প্রয়োজনই ছিল না। দায়িত্ব পেয়েই যে কাজ অনায়াসে করে ফেলেছিলেন ৬ ফুট দীর্ঘ, ঋজু চেহারার ওপেনহাইমার। একই দায়িত্ব পেয়েও সে কাজ করতে পারেননি ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ।
১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই। ইতিহাস এই দিনটাকে চেনে ‘দ্য ট্রিনিটি টেস্ট’ নামে। একথা সকলেরই জানা। ওপেনহাইমারের চোখের সামনে ভেসে উঠছিল মৃত্যুর উজ্জ্বল কমলা আলো। বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট বিষ-মেঘের দিকে তাকিয়ে গীতার শ্লোক উচ্চারণ করে বসেছিলেন ম্যানহাটন প্রোজেক্টের সর্বময় কর্তা ওপেনহাইমার। ‘নাউ আই হ্যাভ বিকেম ডেথ, দ্য ডেসট্রয়ার অফ ওয়ার্ল্ডস।’ নিজেকে স্বয়ং মৃত্যু বলে ঘোষণা করেছিলেন তিনি। এর ঠিক পরের মাসেই হিরোশিমা ও নাগাসাকির বিস্ফোরণ। ৬ ও ৯ আগস্ট। তারপরই জাপানের আত্মসমর্পণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপরে নেমে এল যবনিকা। কিন্তু চিরকালের মতো বদলে গেল পৃথিবীটা। বদলে গেল ওপেনহাইমারের জীবনও।
[আরও পড়ুন: সুষ্ঠুভাবে পঞ্চায়েত ভোট করানোই লক্ষ্য, লে-লাদাখ থেকে বাহিনী এল আকাশপথে]
লস আলামাসে তৈরি হওয়া পরমাণু বোমার কারখানা ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দিলেন ওপেনহাইমার। আর এখান থেকেই শুরু হয়ে গেল মার্কিন প্রশাসনের কাছে তাঁর ভাবমূর্তির পরিবর্তনের পালা। আসলে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারল্ড ট্রুম্যানকে এডওয়ার্ড টেলরের মতো বিজ্ঞানীরা পরামর্শ দিচ্ছিলেন, যেন পরমাণু বোমা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যাওয়া হয়। যাতে ভবিষ্যতে নিজেদের মারণাস্ত্রগুলিকেও আরও শানিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু ওপেনহাইমার হিরোশিমা-নাগাসাকির ভয়ংকর ছবিগুলি ভুলতে পারছিলেন না। তিনি যেন হয়ে উঠলেন ‘ম্যাকবেথ’। সটান প্রেসিডেন্টকে বলে বসলেন, তাঁর হাতে লেগে রয়েছে রক্ত। যা শুনে ট্রুম্যান নাকি পকেট থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দিয়েছিলেন। নিষ্প্রভ কণ্ঠে বলেছিলেন, হাত মুছে নিলেই দাগ চলে যায়। আসলে রাজনীতিবিদরা যা পারেন, তা কি আর কোনও বিজ্ঞানীর পক্ষে সম্ভব? বিবেকের দংশনে রক্তাক্ত হৃদয়ের ক্ষতচিহ্ন বাকি জীবনে আর লুকিয়ে রাখতে পারেননি ওপেনহাইমার।
পরবর্তী সময়ে তিনি চেয়েছেন শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পরমাণু গবেষণার সব নথি ভাগাভাগি করে নিতে। সারা বিশ্ব মিলে মারণাস্ত্র প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটা নিয়ন্ত্রণের জায়গা তৈরি হোক। তাঁর এইসব কথা ভাল লাগেনি মার্কিন প্রশাসনের। তার উপর এডওয়ার্ড টেলরের মতো একদা সহকর্মীরা লাগাতার ষড়যন্ত্রের বীজ বুনে তুললেন। এর মধ্যে ১৯৪৯ সালে স্তালিন পরমাণু বোমা হাতে পেয়ে গেলেন। সোভিয়েতের সফল পরীক্ষার পর ক্রমে জানা গেল আমেরিকা থেকেই ফাঁস হয়েছে পরমাণু গবেষণার তথ্য। এই সন্দেহের তিরও বেঁকে গিয়েছিল আইনস্টাইনের স্নেহধন্য ওপেনহাইমারের দিকেই। ক্রমে ক্রমে তাঁকে ‘স্তালিনের চর’ বলে দেগে দেওয়া শুরু হল।
রীতিমতো ‘বিচার’ শুরু হল তাঁর। শোনা যায় তাঁর ফোনে আড়িও নাকি পাতা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত অবশ্য ‘পার্সোনাল সিকিউরিটি বোর্ড’ জানিয়ে দিয়েছিল তিনি দেশদ্রোহী নন। কিন্তু লস আলামাসে রয়ে যাওয়া তাঁর নিজের লেখা পরমাণু গবেষণার কাগজপত্রে আর কোনও অধিকার রইল না তাঁর। তাঁর ঘনিষ্ঠ মানুষরা বলতেন, এরপর যে দেড় দশক বেঁচেছিলেন ওপেনহাইমার, তিনি কার্যতই ছিলেন একজন ‘ব্রোকেন ম্যান’। ১৯৬৭ সালে ক্যানসারে মৃত্যু হয় বিজ্ঞানীর। পাঁচ দশক পেরিয়েও তাঁর কমিউনিস্ট-ঘনিষ্ঠতা কিংবা অন্যান্য পরস্পরবিরোধী আচরণ নিয়ে আজও তিনি রয়ে গিয়েছেন আলোচনায়। নোলানের মতো বিশ্বখ্যাত পরিচালক ছবি বানিয়েছেন তাঁকে। শিগগিরি মুক্তি পাচ্ছে সেই ছবি। যে ছবিকে ঘিরে ফের নতুন করে বাড়বে ওপেনহাইমার-চর্চার মাত্রা। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানেই এই সব চরিত্রদের ঘুরেফিরে আসা। তাই মহারণের ইতিহাসের সঙ্গে পুনরাবৃত্ত হতে থাকেন এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মহারথীরাও।