বিপ্লবচন্দ্র দত্ত, কৃষ্ণনগর: দিনভর বারুদ পোড়া গন্ধ আরও মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ। মিসাইলের অব্যর্থ লক্ষ্যে জ্বলে খাক আশপাশের ঘরবাড়ি। আর এই দৃশ্য দেখতে-দেখতে শিউরে উঠছেন নদিয়ার যুবক। আপাতত যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে বসে বেরনোর পথ খুঁজছেন পেটের টানে ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার বঙ্গতনয়। মনে একটাই চিন্তা, আর কি কখনও বাড়ি ফিরতে পারবেন? মাথা রাখতে পারবেন মায়ের কোলে? তাঁর এক-একটি ঘণ্টা, এক-একটি মুহুর্তও কাটছে একরাশ আতঙ্কের মধ্যে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের (Ukraine Crisis) নৌবন্দরে জাহাজে বসে রয়েছেন নদিয়ার চাকদহের সিলিন্দা এক নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের বেলে ভাজাবাড়ি পশ্চিমপাড়া গ্রামের বাসিন্দা দিবস সরকার। জাহাজে চাকরি করার স্বপ্ন ছিল ছোট থেকেই। দিবসের স্বপ্নপূরণ হয় গত আগস্টে। কানাডায় একটি জাহাজে হেড কুকের পদে যোগ দেন তিনি। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ইউক্রেনের নিকোলেভ বন্দরে নোঙ্গর করে দিবসের জাহাজ। ঠিক ছিল, ভুট্টা বোঝাই করে তাঁদের জাহাজ যাবে ইতালিতে। কিন্তু বিধি বাম। ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা চালায় পুতিন। তার পর থেকে সেখানেই বন্দী দিবস।
[আরও পড়ুন: মাধ্যমিকে প্রশ্নফাঁস রুখতে কোন কোন জেলায় বন্ধ থাকবে ইন্টারনেট? দেখে নিন তালিকা]
শুধু দিবসের জাহাজই নয়, বিভিন্ন দেশের আরও অন্তত ২০টি জাহাজ ওই বন্দরে আটকে রয়েছে। দিবস জানাচ্ছেন, সূর্যাস্তের পরই নৌবন্দর চত্বর-সহ সমস্ত জাহাজের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। অন্ধকারের মধ্যেই রাত কাটান জাহাজের কর্মীরা। জাহাজের কেবিনে বসে ভিডিও কলে রবিবার সকালে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের বর্তমান অবস্থার কথা জানিয়েছেন দিবস সরকার। তিনি জানাচ্ছেন,”শুধু আমরা নই, এখানে আরও ২০টি জাহাজ আটকে রয়েছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতেই এখান থেকে বেরনোর চেষ্টা করেও পারিনি। বিভিন্নভবে আমরা অফিসকে খবর দিয়েছি। ওরা শুধুই বলছে,আমরা চেষ্টা করছি। এখনও পর্যন্ত কোনও সুরাহা হয়নি।” দিবসের কথায়, “চারিদিকে বোমা বিস্ফোরণ হচ্ছে। মুহুর্মুহু রকেট ছোঁড়া হচ্ছে। সমুদ্রের যে চ্যানেল দিয়ে আমরা বের হওয়ার চিন্তাভাবনা করছিলাম, সেই চ্যানেলের মুখে রুশ সেনারা মাইন পেতে রেখেছে। ওই পথ দিয়ে বেরনো কোনওভাবেই সম্ভব নয়।”
ইউক্রেন থেকে কীভাবে ফিরবেন, আদৌ ফিরতে পারবেন কি না, তা জানেন না দিবস। বলছেন, “অফিস শুধু বলছে, তোমরা কোনওভাবে রোমানিয়া বা পোল্যান্ড সীমান্তে এসে পৌঁছাও, আমরা ব্যবস্থা করছি। কিন্তু এখান থেকে সীমান্ত তো প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে। গাড়িতে যেতে প্রায় ৬ ঘন্টা লেগে যাবে। আমরা গাড়িতে যাওয়ার ভাবনাচিন্তা করছি। কিন্তু আমাদের বন্দরের চারপাশে শুধুই বোমাবর্ষণ হচ্ছে। তাই বেরনোর সাহস পাচ্ছি না।” আতঙ্কের দিনরাত্রির অভিজ্ঞতা জানিয়ে দিবস বলছেন,”রাতে ঘুমতে পারছি না। ঠিকমত খাওয়া হচ্ছে না। একটু আওয়াজ পেলেই চমকে উঠে পড়ছি। রাতভর শুধু চারিদিকে বোমের আওয়াজ। চারিদিকে কালো ধোঁয়া উড়ছে, আগুন জ্বলছে। যেন মৃত্যুপুরীতে বসে আছি। আদৌ বেঁচে বাড়ি ফিরতে পারব কিনা, জানি না।”
[আরও পড়ুন: রোজ রাতে বিয়ারে চুমুক দেওয়ার অভ্যাস? এতেই বাড়ছে মস্তিষ্কের বয়স]
চৈত্র মাসের শেষের দিকে দিবসের বাড়ি ফেরার কথা। বাড়িতে তাঁর অপেক্ষায় বৃদ্ধা মা কৃষ্ণা সরকার, অসুস্থ দাদা, স্ত্রী ঝর্ণা সরকার, তিন বছরের পুত্রসন্তান দেবজিৎ এবং ছোট ভাই। ছেলে যেখানে রয়েছে সেখানে যে যুদ্ধ চলছে, তা এখনও স্পষ্ট করে জানানো হয়নি তাঁর মাকে। তবে স্বামী যে কত বড় বিপদের মুখে রয়েছেন,তা ভালভাবেই জানেন ঝর্ণাদেবী। তিনি বলছেন,”আমার স্বামী ইউক্রেনে জাহাজে খুব বিপদের মধ্যে রয়েছেন। আমরা ভীষণ দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছি। শুধু ঈশ্বরের উপর ভরসা করে বসে আছি।”