রাহুল গান্ধী চান এবার কংগ্রেস সভাপতি পদে পরিবারের বাইরে কাউকে দায়িত্ব দিতে। অথচ দলে নাকি তেমন একজনও ‘সর্বসম্মত’ নেতা নেই। তাহলে রাহুল গান্ধী নিজেই কেন একজন ব্যক্তিকে মনোনীত করে সভাপতি পদে নিযুক্ত করছেন না? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
রাহুল গান্ধী ঘোষণা করেছেন, এবার কংগ্রেসের সভাপতির পদে তাঁদের পরিবারের বাইরে কাউকে দায়িত্ব নিতে হবে। তার মানে তিনি নিজে সভাপতি তো হবেন-ই না, তাঁর মা অথবা বোনও এ দায়িত্ব নেবেন না। এই ঘোষণার পর কংগ্রেস দলের মধ্যেই আরও সংশয়, আরও সমস্যা, আরও হতাশা দেখা দিয়েছে। রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস যে সাম্প্রতিক ইতিহাসে খুবই খারাপ ফল করেছে তা নিয়ে বিতর্ক নেই। এ তো প্রকাশিত ভোট-ফলাফলের বস্তুগত পরিণতি। কিন্তু যে-দল ১৯৬৬ সাল থেকে অন্য কারও হাতে নেতৃত্ব তুলে দেয়নি- হঠাৎ ২০২২ সালে যখন তারা হাল-ভাঙা পাল ছেঁড়া, কার্যত নিরুদ্দেশ যাত্রী- ঠিক তখন রাহুল গান্ধী বারবার বলছেন- আমি খেলব না। এই পরিস্থিতিতে রাহুলের এ-কথা কি দলের জন্য আদৌ কাম্য?
তবে হঠাৎ করে এমন বলছেন তা কিন্তু নয়। তাঁর তরফে বারবার করা এই ধরনের মন্তব্য দুঃসময়ে দলের মধ্যে ঠিক কোন অবস্থা সৃষ্টি করছে? দলের শীর্ষ নেতারা আরও অসহায়, আরও অন্তর্দ্বন্দ্বে জীর্ণ। অনেকে পলাতক, অনেকে বিজেপি শিবিরে যোগ দিতে উদ্যত। অনেকে দল থেকে অবসর নিয়ে সন্ন্যাস জীবন কাটাতে চাইছেন। গান্ধী পরিবার এতদিন কি দলের নেতাদের তাদের পরিবারের বাইরে স্বাধীন, সার্বভৌম নেতা গঠনের প্রক্রিয়াকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে? সাইকেল চালানোর সময় শিশুকে স্বাধীন শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষককে হাত ছেড়ে দিতে হয়। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকেই তো বিপরীত প্রতিক্রিয়াই দেখেছি। এমনকী, পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডনের হাত থেকে সভাপতি পদের দায়িত্বটাও নিয়ে নিয়েছিলেন স্বয়ং জওহরলাল নেহরু।
[আরও পড়ুন: জয় ইউনেস্কোর জয়, বাংলায় যা পুজো হয়, দেশের কোথাও হয় না]
‘এক ব্যক্তি এক পদ’ নীতিকে ভূলুণ্ঠিত তো সেদিনই করা হয়। ট্যান্ডন পদে-পদে নেহরুর মন্ত্রিসভা পরিচালনার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করছিলেন। ডা. বিধান রায়কে চিঠি দিয়ে নেহরু তা জানান। এভাবে তো কাজ করাই যাবে না। এজন্য তিনি ইস্তফা দিতে চান প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে। ডা. বিধান রায় চিঠির জবাবে লেখেন- প্রশ্নই ওঠে না! বরং ওয়ার্কিং কমিটি ডাকা হোক। জওহরই হোন দলের সভাপতি। তেমনই হল। ইন্দিরা গান্ধী তো দলের মধ্যে তাঁর নিয়ন্ত্রণ এবং গান্ধী পরিবারের নিয়ন্ত্রণকে চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন। ইন্দিরার পর তস্য পুত্র সঞ্জয় গান্ধী এবং রাজীব গান্ধীও উত্তরাধিকার সূত্রে যথাক্রমে দলের সভাপতি ও
প্রধানমন্ত্রী হন।
পাখিকে খাঁচায় বন্দি করে রাখলে সে ওড়ার ক্ষমতা ও ইচ্ছা হারায়। অচলায়তনের মহাপঞ্চকের মতো সে শেখানো মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকে। তা হল পাভলভের প্রতিবর্ত ক্রিয়া। আর. কে. লক্ষ্মণের একটা কার্টুনে একদা দেখেছিলাম, দলের মুক্ত চিন্তনের বৈঠক। ইন্দিরা গান্ধী দাঁড়িয়ে আছেন আর কথা বলছেন। দলের প্রবীণ শীর্ষ নেতারা চতুষ্পদের মতো হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে তাঁর দিকে অপলক হাস্যমুখে তাকিয়ে। এই পটভূমিতে আমার দু’-একটি সহজ সরল প্রশ্ন আছে।
রাহুল গান্ধী নিজেই কেন একজন ব্যক্তিকে মনোনীত করে সভাপতি পদে নিযুক্ত করছেন না? কান্নাকাটি শুরু করার ফলে শীর্ষ নেতাদের কথা শুনে আবার সোনিয়া গান্ধীকে (Sonia Gandhi) দলের কান্ডারির দায়িত্ব নিতে হয়েছে, কিন্তু এই প্রক্রিয়াতে গান্ধী পরিবারের উপর সামন্ততান্ত্রিক নির্ভরশীলতা কমবে কী করে? কর্পোরেট সেক্টরে আধুনিক স্টাইল হল, একজন পদে অধিষ্ঠিত থাকার সময়ই পরবর্তী ব্যক্তিটি কে হবেন তা ঠিক করে নেওয়া হয়। তাকে ধীরে ধীরে সকলের সামনেই ‘গ্রুম’ করা হয় যাতে সহকর্মীরাও নানা স্তরে তাকে গ্রহণ করার জন্য যথেষ্ট সময় পায়। আবার সেই ব্যক্তিও উপপ্রধান হিসাবে প্রধানের কাছ থেকে কাজটা শেখার যথেষ্ট সময় পায়। আমি এমন একজন সংবাদপত্র গোষ্ঠীর মালিককে জানি যিনি পরবর্তী তিনজন সম্পাদক কে-কে হবেন তা ঠিক করে রেখেছিলেন। নীরবে তাঁদের তৈরি করেন। হয়তো সেই ব্যক্তিরাও তা আগাম জানতে পারেন না।
কখনওই বলছি না রাজনৈতিক দল সম্পূর্ণ কর্পোরেট স্টাইলে চলুক। এমনিতেই কর্পোরেটাইজেশন তো কম হয়নি। আবার দল পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু কর্পোরেট শৈলী গ্রহণ করায় কোনও অন্যায় আছে বলেও মনে করি না। রাহুল গান্ধী চাইলে কি একজন কাউকে ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট বা রাজনৈতিক উপদেষ্টাও করতে পারতেন না?
প্রথমে এমন একটা ব্যাখ্যা ছিল যে, তেমন একজনও নেতা নেই যিনি সর্বসম্মত। তাই ‘ক’ বাবুকে করলে বর্ণমালার অন্যরা সবাই বিদ্রোহ করবে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, গান্ধী পরিবারের প্রতিনিধি হলে সেই ইগো সমস্যা থাকে না। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন তো দেখা যাচ্ছে, রাহুল গান্ধী (Rahul Gandhi) আনুষ্ঠানিকভাবে না থাকলেও তিনিই দলের প্রধান চালিকাশক্তি। বয়স, শারীরিক কারণে এবং সচেতনভাবেই সোনিয়া গান্ধী বহু বছর ধরে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার আন্তরিক চেষ্টা করছেন, কিন্তু দলটি স্বখাত সলিলে ডুবে যাক এমনটা তিনি চান না বলে কিছুটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই দলের দায়িত্ব নিয়েছেন। পলাতকা হননি। তবে পলাতকা ছায়া সৃষ্টির চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। শুধু তো দল নয়, ইউপিএ-র চেয়ারপার্সন হিসাবেও তিনি আজও সর্বপ্রধান ‘সিমেন্টিং ফোর্স’।
এখন কংগ্রেসের অবস্থা শোচনীয়, সবাই স্বীকার করছেন। মোদি কংগ্রেস-মুক্ত ভারতের কথা ঘোষণা করেন। বিজেপি সেজন্য সাম-দান-দণ্ড-ভেদের কৌশলও নিয়েছে। ‘বিজেপি কংগ্রেসকে শেষ করে দিচ্ছে’ বলে কান্নাকাটি করার চেয়ে কেন দলের শিরদাঁড়া ভেঙে গেল, কেন সর্ববৃহৎ গণপার্টি আজ এভাবে সংকুচিত হয়ে গেল, তার ময়নাতদন্ত করে পাল্টা কৌশল পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল অনেক বেশি।
১৯২৫ সালে আরএসএস এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম। সালের ভিত্তিতে সহোদর হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় রাজনীতিতে আরএসএস এতদূর এগল আর কেন কমিউনিস্টরা পারল না, পিছিয়ে পড়ল তার জন্য যদি কমিউনিস্টরা আরএসএস-কেই দায়ী করে, তবে তা কি সঠিক কাজ? এখন তো মনে হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা রাজস্থান আর ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যেও কংগ্রেসকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার কারিকুরি আর ‘পোস্ট ট্রুথ’ জমানায় বিপণন নিশ্চয়ই বড় ফ্যাক্টর, কিন্তু মানুষের সমর্থন হারানোর জন্য কংগ্রেস নেতৃত্বের কি কোনও দায়িত্বই থাকে না?
এই সংকট সাগরে কংগ্রেস আজ হঠাৎ করে ডুবতে বসেছে এমন তো নয়। রাজ্যে রাজ্যে সবল নেতৃত্ব, বহু ‘মসিহা’-কে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিকেন্দ্রিক ‘হাইকমান্ড’ নামক এক পরম শক্তিময় সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। মহাত্মা গান্ধীর জনসম্মোহনী শক্তি যে-দলকে অভিজাত ক্ষুদ্র বৃত্ত থেকে আমজনতার কাছে নিয়ে যায়, বিশ শতকের শেষভাগ থেকেই তা আবার জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে অভিজাত ক্লাবে পরিণত হয়।
এখন একুশ শতকের তৃতীয় দশকে পৌঁছে বিষয়টি একটা হাস্যরস উদ্রেককারী গৌরব হারানো আলোচনার বিষয়। বিজেপির আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য গান্ধী পরিবার। তাই সত্যি সত্যিই সে পরিবার সরে দাঁড়ালে অসুবিধা হয়তো সবচেয়ে বেশি হবে বিজেপির-ই। নিছক ঘোষণা নয়, রাহুল গান্ধীকে সত্যি সত্যিই নতুন নেতৃত্ব তৈরি করার দায়িত্বও নিতে হবে। তা না হলে ‘আমি আছি’ এবং ‘আমি নেই’ এই দ্বান্দ্বিক মায়াতে কংগ্রেসকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রেখে রাহুল গান্ধী সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছেন কংগ্রেসেরই। প্রশ্ন শুধু পদ ছাড়ার নয়, প্রশ্ন সংকটে দায়িত্ব নেওয়ারও।