সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক আসলে দলনেত্রীর বার্তাটিই সামনে এনে দিলেন। মমতার স্পষ্ট মনোভাব প্রতিধ্বনিত হল যুবনেতার কণ্ঠে। খারিজ হল বিরোধীশূন্য তত্ত্বটিও। বার্তা শুধু কলকাতা নয়, জেলাস্তরেও গেল। বিগত পুরভোট ও পঞ্চায়েত ভোটে ক্ষেত্রবিশেষে যা হয়েছে তা অতীত। ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করতে হবে। বিরোধী হলে ভোটদানে বাধা দেওয়া যাবে না। বাংলার গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বভারতীয় স্তরে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী পদে ক্রমশ ‘মুখ’ হয়ে উঠছেন, তখন এই বার্তার গুরুত্ব অপরিসীম। লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক
বিরোধীশূন্য চিন্তা ছাড়তে হবে। গা-জোয়ারি করা যাবে না। মানুষকে ভোট দিতে বাধা দিলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে। যত বড় নেতার ছত্রছায়ার থাকুন, রেয়াত করবে না দল। বহিষ্কার করা হবে।
পুরভোট সামনে রেখে দলীয় প্রার্থীদের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যে কথা বলেছেন, সে কথা বলার সৎ সাহস ক’জনের আছে?
এ কথা কি আরামবাগের অনিল বসুকে বলাতে পারত সিপিএম? না কি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবকে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলবে- রাজধর্ম পালন করুন? মানুষ যাতে নিজের মত প্রকাশ করতে পারে, বিরোধী দল তাদের কর্মসূচি করতে পারে সেই ব্যবস্থা করুন। সিপিএমও বলেনি, বিজেপিও বলবে না।
কিন্তু অভিষেক বললেন।
মহারাষ্ট্র নিবাস হলে কলকাতা পুরসভার ১৪৪ আসনের প্রার্থীদের সামনে তিনি যেভাবে কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তাতে তৃণমূলের ভাবমূর্তি সাধারণ মানুষের সামনে আরও উজ্জ্বল হল। বিশেষ করে বাংলার গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বভারতীয় স্তরে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী পদে ক্রমশ ‘মুখ’ হয়ে উঠছেন, তখন এই বার্তার গুরুত্ব অপরিসীম।
[আরও পড়ুন: ‘বিরোধী ঐক্য’ একতরফা হয় না]
বলা বাহুল্য, সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক আসলে দলনেত্রীর বার্তাটিই সামনে এনে দিলেন। মমতার স্পষ্ট মনোভাব প্রতিধ্বনিত হল যুবনেতার কণ্ঠে। খারিজ হল বিরোধীশূন্য তত্ত্বটিও। বার্তা শুধু কলকাতা নয়, জেলাস্তরেও গেল। বিগত পুরভোট ও পঞ্চায়েত ভোটে ক্ষেত্রবিশেষে যা হয়েছে তা অতীত। ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করতে হবে। বিরোধী হলে ভোটদানে বাধা দেওয়া যাবে না। মানুষের রায়কে মর্যাদা জানাতে এটি খুব প্রয়োজনও ছিল।
এবারের বিধানসভা ভোট এককথায় অভাবনীয় রাজনৈতিক দলিল। এত ঘটনাবহুল ভোট আগে কখনও হয়নি। এই লড়াই জিতে গেলে মুখ্যমন্ত্রী আগামী দিনে দিল্লিতে চ্যালেঞ্জার হয়ে উঠবেন আঁচ করে বাংলা দখল করতে নামে বিজেপি। যে আক্রমণাত্মক কায়দায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তৃণমূলকে ভাঙতে তারা নেমেছিল তাতে অনেকের ধারণা ছিল, পালাবদল আসন্ন। এই চাপ রাখতে পারবে না তৃণমূল। কিন্তু ভাঙা পায়ে আসল খেলা দেখালেন মমতাই। রাজ্যের মানুষ তৃতীয়বারের জন্য তাঁর উপর বিরাট আস্থা রেখে বুঝিয়ে দিল, বিজেপির রাজনীতি তাদের না-পসন্দ। বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়। পরে সাত আসনের উপনির্বাচনেও দেখা গেল বাংলার মেয়ের জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে গিয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই ‘হাওয়া’ নষ্ট হোক, তা চাইবে না কেউ। সেই প্রেক্ষিতে সঠিক সময়ে সঠিক কথাই অভিষেক বলেছেন বলে রাজনৈতিক মহলের রায়।
বিধানসভা ভোটের বিপুল জয়ের পর তৃণমূলের সামনে পুরসভা নির্বাচন। নাগরিক পরিষেবার ক্ষেত্রে এই
ভোটের গুরুত্ব অপরিসীম। পুরসভা যদি হাতে না থাকে তা হলে শাসক দলের সমস্যা হয়। ফলে সর্বত্র ভাল করতে তারা মরিয়া। পটভূমিও প্রস্তুত। উত্তরবঙ্গ ও কিছু অংশ বাদ দিলে বাকি সব পুরসভাতেই গত বিধানসভা ভোটে লিড রয়েছে তৃণমূলের।
আপাতত কলকাতা পুরসভার ভোট। এরপর শতাধিক পুরসভায় ভোট হবে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মহানগরীর ফল কী হতে পারে তা নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ নেই। গত বিধানসভা ভোটে কলকাতার সব ক’টি বিধানসভা আসন তৃণমূল জিতেছে। শাসক বনাম বিরোধীর ভোটের অনুপাত দেখলে বোঝা যায়, আক্ষরিক অর্থে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। মহানগরীতে একতরফা জিতেছে শাসক দল। তৃণমূল পেয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ ভোট। জয়ের ব্যবধান কোথাও কোথাও পৌঁছে গিয়েছে ষাট-সত্তর হাজারে। এই ভোটে কোথাও কোনও গা-জোয়ারি অথবা অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি। মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে। শেষ ছয় মাসে এমন কোনও রংবদল হয়নি যে শাসক দলের চিন্তা আছে। বরং, ভবানীপুর আসনের উপনির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রীকে ৭১ শতাংশ ভোট দিয়েছে মানুষ। জেতা ওয়ার্ডে পিছিয়ে গিয়েছে বিজেপি। পর্যুদস্ত হওয়ার পর বিজেপিতে ভাঙন শুরু হয়েছে। ৭৭ এমএলএ সাত মাসে ৭০।
রাজ্যজুড়ে সাত বিধানসভা অাসনের উপনির্বাচনে সাতটিই জিতেছে শাসক। বিজেপির ‘প্রধান বিরোধী’ তকমা চ্যালেঞ্জের মুখে। কোথাও সিপিএম কোথাও কংগ্রেস দ্বিতীয় স্থানে উঠে অাসতে শুরু করেছে। ক’মাস আগে যে-আসন বিজেপি জিতেছিল, সেখানে ভোটে ধস। এই অবস্থায় বিরোধীদের আর কোনও সুযোগ দিতে রাজি নয় তৃণমূল নেতৃত্ব।
প্রার্থীদের সঙ্গে বৈঠকে অভিষেকের আরও একটি কথা তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘সারা দেশ কলকাতার দিকে তাকিয়ে আছে। কোনও অবস্থাতেই মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়ের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করা যাবে না।’
হক কথা! বাংলায় তৃতীয়বার জয়ের পর মমতার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে গিয়েছে। নানা সমীক্ষায় নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে মুখ হিসাবে মমতাকেই এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই সময় রাজে্য রাজে্য অাসছে সংগঠন তৈরির ডাক। মাত্র চার মাসে গোয়া ও ত্রিপুরায় বড় শক্তি হয়ে উঠেছে তৃণমূল। গোয়ার ভোট আসন্ন। জনমত সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল নির্ণায়ক শক্তি হতে পারে। আগরতলা পুরভোটে ২০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। হরিয়ানার খুব গুরুত্বপূর্ণ নেতা অশোক তানোয়ার তৃণমূ্লে এসেছেন। মুম্বইয়ে যেভাবে বাণিজ্যনগরীর শিল্পী, সুরকার, লেখক, অভিনেতা-সহ বুদ্ধিজীবীরা তাঁকে বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিতে বলেছেন, তা অভূতপূর্ব! সর্বোপরি মেঘালয়ের ১২ জন কংগ্রেস বিধায়কের তৃণমূলে যোগ।
সময় যত গড়াচ্ছে দেখা যাচ্ছে মোদি-বিরোধী নানা স্রোতের মুখ হয়ে উঠছেন মমতা-ই। বাংলার বাইরে তৃণমূল সম্পর্কে মানুষের এই আগ্রহ নতুন পটভূমি রচনা করেছে। এই সময় একটু ভুল মানেই মমতার উজ্জ্বল ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হওয়া। অভিষেক সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন।
আন্তর্জাতিক স্তরেও মমতার নাম আলোয়। বিশ্বের ক্ষমতাশালী মহিলার তালিকায় তিনি। ভ্যাটিক্যান থেকে ধর্মসভায় বক্তৃতায় দেওয়ার ডাক আসছে। নেপাল থেকে নেপালি কংগ্রেসের অধিবেশনে বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ এসেছে। আমেরিকা, ইউরোপ, ব্রিটেন থেকেও অতীতে অনেক অামন্ত্রণ এসেছে। মমতার এই ইমেজ জাতীয় রাজনীতিতে তাঁকে আরও প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এই সময় পুরভোটের মতো স্থানীয় স্তরের ভোটে গা-জোয়ারি এক গামলা দুধে এক ফোঁটা চোনার মতো হবে। তাই দল আর২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোটের পুনরাবৃত্তি চায় না। পঞ্চায়েত স্তরে সামাজিক প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বিপুল কাজ ও সংস্কার করার পরও ওই ভোটে ২০ হাজার আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় বিপদ ডেকে এনেছিল। অনেকের ধারণা, তার প্রভাব লোকসভা ভোটে পড়েছিল বলেই বিজেপি ১৮টি আসন পেয়ে যায়। না হলে তাদের এমন কোনও সংগঠন ছিল না যে এতগুলো আসন পাবে।
তৃণমূল ঘুরে দাঁড়ায় বিধানসভা ভোটে। মানুষ আবার তাদের দু’-হাত ভরে ভোট দিয়ে জিতিয়েছে। মোদির প্রচারকে উড়িয়ে মমতায় আস্থা। স্বভাবতই অভিষেকের খুব সময়োপযোগী বার্তা। তিনি যে সাহস দেখিয়েছেন, তাতে সাধারণ মানুষের খুশি হওয়া স্বাভাবিক। বার্তাকে ফলে কার্যকর করলে লাভ হবে তৃণমূলের। রাজ্যে, দেশেও।