shono
Advertisement

রান হিমা রান…

আচ্ছা, হিমা দাস যদি তুখড় ইংরেজি জানতেন এবং যদি ৪০০ মিটারে সোনা না জিততে পারতেন, তাহলে কি ভারতীয় অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন লিখত– ‘ইনি ভারতের হয়ে সোনা পেলেন না বটে, কিন্তু চোস্ত ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন’? উত্তর খুঁজলেন সম্বিত বসু। The post রান হিমা রান… appeared first on Sangbad Pratidin.
Posted: 02:52 PM Jul 20, 2018Updated: 03:22 PM Jul 20, 2018

আচ্ছা, হিমা দাস যদি তুখড় ইংরেজি জানতেন এবং যদি ৪০০ মিটারে সোনা না জিততে পারতেন, তাহলে কি ভারতীয় অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন লিখত– ‘ইনি ভারতের হয়ে সোনা পেলেন না বটে, কিন্তু চোস্ত ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন’? উত্তর খুঁজলেন সম্বিত বসু

Advertisement

অসমের প্রত্যন্ত গ্রাম। ‘দিন আনি দিন খাই’ কৃষকের মেয়ে হিমা দাস তাঁর বাবাকে চাষে সাহায্য করতেন মাঠে গিয়েই। ফসল তুলতেন, বীজ ছড়াতেন। এহেন হিমা দাস ছোটবেলায় ফুটবল খেলতেন। ছেলেদের সঙ্গেই। এমনই এক খেলার দিনে হিমা তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলে যাচ্ছিলেন। ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দপ্তরের অ্যাথলেটিকস কোচ নিপুণ দাস এমন অকপট ইংরেজি বলা দেখে বিস্ময়ে শ্বাসরুদ্ধ! দুরন্ত ইংরেজি বলিয়ে এই মেয়েটির দৌড়-সাফল্য নিয়ে সুনিশ্চিত নিপুণ দাস প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন। সেই হিমা দাসই ফিনল্যান্ডে অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের হয়ে প্রথমবার সোনা জিতলেন। ৪০০ মিটারের ট্র‌্যাক কার্যত চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতায় শেষ করে ফেললেন মাত্র ৫১.৪৬ সেকেন্ডে!

এটা আদতে গল্প। পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে লাগসই হতে পারে তেমনই একটা ‘পরিকল্পিত’ গল্প। এবং গল্পটা এরকম হলেই হয়তো ভাল হত! কিন্তু সৌভাগ্যজনকভাবে তা নয়। ইংরেজি বলার সঙ্গে এখনও দৌড়ের এ-জাতীয় কাণ্ডজ্ঞানহীন সুসম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। সত্যিটা হল, হিমা দাস কেবলমাত্র দৌড়নোর জন্য চোখে পড়েন কোচ নিপুণ দাসের। কিন্তু শুরুর গল্পটা ‘সত্যি’ হলে সুবিধা হত ভারতীয় অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের। কারণ হিমা দাসের সোনা জয়ের পর তাদের অফিশিয়াল অ্যাকাউন্ট থেকে টুইটে গর্বোদ্ধত বাক্যব্যয়ের সঙ্গে একটি খেদোক্তিও দেখা গিয়েছে। তা হল: ‘নট সো ফ্লুয়েন্ট ইন ইংলিশ’। সবমিলিয়ে ইংরেজি না জেনেই তো ইতিহাসে ঢুকে পড়েছেন হিমা দাস।

টুইটটির ‘বিশ্বস্ততা’ বজায় রাখতেই হিমা দাসের সাক্ষাৎকারের ভিডিওটি আপলোড করেছে তারা। এক বিদেশিনি সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অসমের হিমা হাঁপাচ্ছেন। সম্ভবত ঐতিহাসিক ওই দৌড়ের অল্প পরেই এই কথোপকথন। চুল টানটান। ক্লিপ লাগানো। চোখ-মুখেই স্পষ্ট, তিনি এই রেকর্ডসূচক দৌড়ের অনেক আগে থেকেই, ছোটবেলা থেকেই, দৌড়েছিলেন দারিদ্ররেখা ধরে। হিমা যে কমিউনিকেশন করতে পারেননি, তা নয়। সেই সাংবাদিক যে হিমার উত্তরে মাথা চুলকাতে লেগেছেন, তা-ও নয়। বরং সকল প্রশ্নের জবাবই তিনি স্বচ্ছভাবে দিতে পেরেছেন। খাপছাড়া ইংরেজি বলেও তিনি বোঝাতে পেরেছেন তাঁর দৌড়, তাঁর প্রস্তুতি ও সংকল্প। উচ্ছ্বাস। কিন্তু তাতে মন গলেনি ফেডারেশনের। সুতরাং টুইটে জুতসই গুঁতো। তারপর হাঁড়ি হাঁড়ি বিতর্কের টোকো রসগোল্লা জুটেছে তাদের। কুরুচিকর এই উক্তির জন্য ক্ষমাস্বীকারও করেছে সংস্থাটি। কিন্তু তাহলেও এই মানসিকতা দ্রুত ডিলিট হওয়ার নয় বলেই মনে হয়।

একজন লেখক, মৃৎশিল্পী, ভাস্কর, চিত্রশিল্পী, খেলোয়াড়– তাঁদের কি ইংরেজি ভাষা জানা আবশ্যক? লেখকের তাও একটা ভাষার দরকার পড়ে। অধিকাংশ সময়ে লেখকের ভাষা তাঁর মাতৃভাষাই। কিন্তু একজন ভাস্করের, একজন চিত্রশিল্পী বা খেলোয়াড়ের তো কোনও ভাষা নেই। আঙুলের ভাষা, তুলির ভাষা, নিজেদের শরীরের ভাষাই তাঁদের ভাষা। রামকিঙ্কর বেইজ কী ভাষায় কথা বলতেন, বা ইংরেজি জানতেন কি না, তার থেকেও জরুরি তাঁর ভাস্কর্য দেখা, তাঁর শিল্পের সঙ্গে একাত্ম হওয়া। পিকাসোর ছবি দেখে মনে হয়েছে কারও যে ছবিখানা ইংরেজি ভাষার সম্পদ? কিংবা কেউ কখনও বলেছেন মারাদোনার বাঁ-পা ইংরেজি ভাষায় গোল্ড মেডেল পেয়েছে? এরকম উক্তি নিদেনপক্ষে আমি কস্মিনকালেও শুনিনি। হঠাৎ কেন এই ইংরেজি জানা এত জরুরি হয়ে পড়ল তবে একজন দৌড়বিদের?

ভারতীয় অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন একটি জাতীয় সংস্থা। সংবিধান অনুযায়ী ভারতের কোনও ‘জাতীয়’ ভাষা নেই। যদিও ‘হিন্দি আমাদের জাতীয় ভাষা’ বলে একদল জোর করেই মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা করছে। অফিশিয়াল (দাপ্তরিক) ভাষা অবশ্য দু’টি– ইংরেজি ও হিন্দি। যে কোনও সরকারি দপ্তরে এই ভাষায় কাজ চালানো হয়। কিন্তু রেস ট্র‌্যাক তো কাজের জায়গা নয়। যাঁরা অন্যান্য দেশে থাকেন, ধরা যাক ফিলিপিন্সের একজন মানুষ হয়তো ভেবে বসলেন ভারতে ইংরেজি জানা আবশ্যক। তাঁর ‘ভুল ধারণা’ তৈরি করল এই টুইট। এই দায় কে নেবে? ভারতের মতো বহুভাষিক দেশে কোনও একটি ভাষা না জানার অপরাধে তাঁকে খামোকা বেইজ্জত হতে হবে কেন? হিমা দাস যে পরিবার থেকে উঠে এসেছেন, সেই পরিবারের পক্ষে ইংরেজি জানাটা একটা দুঃসাধ্য বিষয়। পশ্চিমবঙ্গের খাস শহরতলিতেও বহু দরিদ্র পরিবারে তরুণ-তরুণীরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত নন। তাঁদের কমিউনিকেটিভ ইংলিশ জোরদার না হওয়াই বরং স্বাভাবিক। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে তাঁদের প্রথাগত শিক্ষার চর্চা না হয়ে সরকারি স্কুলেই হয়েছে। ফলে ইংরেজি না জানা নিয়ে যে হল্লা আন্তর্জাতিক মঞ্চে করা হচ্ছে, তার কোনও ভিত-ভূমি নেই।

তবে ইংরেজি না-জানা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা সবসময় যে অপ্রাসঙ্গিক, তা-ও নয়। যদি শিক্ষাবিদ বা স্কলার গোছের কেউ হতেন অসমের এই মেয়েটি, সেক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলা সঙ্গত হত। কিন্তু যাঁর ভাষা কেবলমাত্র দৌড়, তাঁর উপর এই আরোপ চাপিয়ে দেওয়া যায় না মোটেই। ভারতীয় ক্রিকেট টিমেও একদা এমন অনেক খেলোয়াড়ই ছিলেন, যাঁরা চোস্ত ইংরেজি বলতে পারতেন না। উদাহরণস্বরূপ হরভজন সিংয়ের কথাই বলা যায়। তাঁকেও যে ‘না জানা’-র ঢুঁসো সামলাতে হয়নি, তা নয়। ভারতীয় ফুটবল টিমের সকলে কি খুব ধারালো ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন? ভাষাশিক্ষাটা আস্তে আস্তে হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক স্তরে খেলতে খেলতে, মিশতে মিশতেই ভাষাটা অন্তত কমিউনিকেশনের পক্ষে সড়গড় হয়ে যায়। এটাই হয়ে এসেছে। ভারতীয় টিমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর হরভজন সিং টিম মিটিংয়ের জন্য প্রথমবার গিয়েই সাফ জানিয়েছিলেন, ‘আমি ইংরেজি বলতে পারি না। পাঞ্জাবি জানি।’ তখন মহম্মদ আজহারুদ্দিন বলেছিলেন, ‘পাঞ্জাবিতেই বলো। যে ভাষা জানো, সেই ভাষাতেই বলো।’ হরভজন একটা কথাই বলেছিলেন। ‘দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে লড়ব।’ হিমা দাসও ইংরেজি জানেন না বলে কর্তব্যে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন, তা নয়। সোনার ফসল থেকে সোনা– এই রূপকথার লেখক তিনিই।

ফেডারেশন এই বিতর্কিত টুইটের জন্য ক্ষমাস্বীকার করেছে। ক্ষমা চাওয়া ও ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য দরাজ হৃদয় থাকা দরকার। আমাদের নীতিশিক্ষাও ক্ষমা করে দেওয়ার পক্ষেই। কিন্তু যে উক্তি একটি জাতীয় সংস্থা থেকে আসে, তার বিচার-বিবেচনা বোধকে কতটুকু মান্যতা দেওয়া যায়? ক্ষমা করে দিলেও এই ক্ষত কি বুজবে? কিছুদিন পর এরকম আরও প্রশ্ন কি উঠবে না অন্য খেলোয়াড়দের দিকে আঙুল তুলে? সংস্থার পক্ষে যোগ্য টুইট কি এরকম হত, ‘তিনি ভারতের হয়ে সোনা পেলেন না, কিন্তু চোস্ত ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন।’ তাহলে কি ছাতি ফুলত ভারতের আপামর জনসাধারণের?

The post রান হিমা রান… appeared first on Sangbad Pratidin.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement