নাগরিকত্বের শংসাপত্র পেতে আপনি যে মুহূর্তে ‘সিএএ’-র নির্দেশনা অনুযায়ী আবেদন করলেন, আপনারই স্বীকৃতিমতে কিন্তু আপনি আর ভারতের নাগরিক রইলেন না। কিন্তু আপনার জমা দেওয়া নথিপত্র যদি সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের পছন্দ না হয়? তখন আপনার এই রাষ্ট্রে অবস্থানটা কী হবে? ডি-ভোটার, না কি সন্দেহভাজন অনুপ্রবেশকারী? লিখলেন স্বাগতম দাস।
সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তি ও ভয়ের ঘোলাজলে মাছ ধরা কোনও বড় নির্বাচনের আগেই রাজনীতির কারবারিদের পক্ষে এখন বেশ স্বাভাবিক। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব থেকে দিল্লির শাহিনবাগ পর্যন্ত একটা জিনিস খুব পরিষ্কার– দেশে বেকারত্ব, শিশুমৃত্যু, চাষির ফসলের দাম না-পাওয়া, পরমাণু চুক্তিতে আমাদের যোগদান করা বা না-করা, নেতাদের ক্যামেরার সামনে ঘুষ খাওয়া, প্রশ্ন করলেই মিথ্যে মামলার জালে ফঁাসিয়ে জেলে ভরা– এই সবকিছুর থেকে মানুষকে অনেক বেশি প্রভাবিত ও ভাবিত করে তার নিজের জায়গা, নিজের জমি হারানোর ভয়– নাগরিক পরিচয় হারিয়ে ফেলে নিজেরই জন্মভিটায় উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার আশঙ্কা। ধর্মের ভিত্তিতে এক সম্প্রদায়কে সেই আশঙ্কা থেকে মুক্ত করার লোভ দেখিয়ে আইন কার্যকর করলে একইসঙ্গে যদি আরেকটি সম্প্রদায়কে যথেষ্ট চাপে রাখা যায়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা– বিভাজনের রাজনীতিও অব্যাহত থাকে, মানুষের নজরও ক্ষমতাসীনদের আসল ব্যর্থতার জায়গাগুলো থেকে ঘুরে যায়।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের অব্যবহিত আগে, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপি ও অন্যান্য দলের তহবিলে কোটি-কোটি টাকা জমা পড়ার নথিপত্র যখন সুপ্রিম কোর্টের কল্যাণে মানুষের সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে, ঠিক সেই সময় গত ১১ মার্চ রাতে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সারা দেশে কার্যকর হল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, সংক্ষেপে ‘সিএএ’। সিএএ ঘোষণার এই সময়টা নিঃসন্দেহে মোক্ষম– ১১ মার্চ মতুয়া সম্প্রদায়ের গুরু হরিচঁাদ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী, আর ঠিক তার পরের দিন ১২ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে রমজান। সুতরাং একইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ৩৯টি বিধানসভা কেন্দ্রের প্রায় ২০ শতাংশ মতুয়াদের হিন্দু ভোট সুনিশ্চিত করা এবং নাগরিকত্বের আবেদনের অধিকার থেকে বাদ রেখে এনআরসি-র অধুনা অকথিত জুজুকে মনে করিয়ে দিয়ে মুসলিম সম্পদায়ের একাংশকে ভয় দেখানোর যৌথ উদ্দেশ্য সফল করার এই তো সুযোগ। লক্ষণীয় যে, ঠিক পঁাচ বছর আগে, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগেও সিএএ এবং রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি-র ঘোষণা নিয়ে তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল দেশ।
[আরও পড়ুন: দশ কোটি টাকায় মুক্তি! জামিন পেলেন ধর্ষণে অভিযুক্ত দানি আলভেজ!]
সিএএ-র মাধ্যমে ভারতের প্রতিবেশী তিনটি মুসলিম রাষ্ট্র– পাকিস্তান, আফগানিস্তান, এবং বাংলাদেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া অ-মুসলিম অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, জৈন, পারসি, বৌদ্ধ, ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষদের আবেদনের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট নথিপত্র মিলিয়ে দেখে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। আপাতদৃষ্টিতে খুবই শুভ প্রচেষ্টা। কিন্তু তলিয়ে ভাবলে, বেশ কিছু জটিল প্রশ্ন উঠে আসে আইনটিকে ঘিরে। সংবিধানের
বিপ্রতীপ স্বরে শুধু মুসলমান এবং অ-মুসলমানদের মধ্যে বিভাজনরেখা টানার একটা জোরালো প্রয়াস আইনটির মধ্যে লক্ষণীয়। মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা কিংবা নেপাল থেকে অত্যাচারিত হয়ে এসে যঁারা আশ্রয় চাইবেন ভারতে, তঁাদের এই আইনে কোনও আশ্রয় থাকবে না। এমনকী, মুসলমানদের মধ্যেও রয়েছে শিয়া, বেলুচ বা আহমাদিয়া-র মতো সম্প্রদায়, যঁারা বিভিন্ন সময় মৌলবাদী অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। কী হবে তসলিমা নাসরিনের মতো প্রতিবাদী লেখিকার, কাগজে-কলমে মুসলমান হয়েও যিনি বাংলাদেশ থেকে দীর্ঘকাল নির্বাসিত? সিএএ তঁাকেও ভারতের নাগরিকত্ব দিতে অপারগ। সিএএ নিয়ে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতেও ব্যাপক বিক্ষোভ ধূমায়িত হয়েছে। বিজেপি-শাসিত অসম এর ব্যতিক্রম নয়, সেখানকার বহু মানুষের বক্তব্য: এর ফলে শরণার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করা হয়ে উঠবে কঠিন, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান হবে কঠিনতর। অন্যদিকে দক্ষিণের রাজ্যগুলিও সিএএ-র বিরোধিতায়
নেমে পড়েছে তামিল উদ্বাস্তুরা বাদ পড়ার দরুন।
সিএএ-র মাধ্যমে নাগরিকত্ব পেতে গেলে আবেদনকারীকে দু’টি বিশেষ কাগজ দেখাতে হবে– একটি নথিতে তঁাকে প্রমাণ করতে হবে তিনি ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে এসেছিলেন, এবং অন্যটিতে প্রমাণ হবে তিনি বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের (অর্থাৎ যে তিনটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের নাম সিএএ-তে করা হয়েছে) নাগরিক ছিলেন। প্রশ্ন উঠছে, ধর্মীয় অত্যাচারের শিকার হয়ে কঁাটাতার পেরিয়ে, তাড়া খেতে-খেতে পালিয়ে এলেন যঁারা, তঁাদের কতজনের কাছে সযত্নে সুরক্ষিত থাকে এই ধরনের নথি– পাকিস্তানের স্কুল-পাশের সার্টিফিকেট কি বাংলাদেশের বাড়ির দলিল? এঁদের অনেকেই বহু দিন ভারতে আছেন, ভোট দেন, আধার কার্ড এবং পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। হঠাৎ সিএএ-র আবেদন জানিয়ে এঁরা নিজেদের ভারতের ‘বৈধ’ নাগরিক নন বলে ঘোষণা করবেন, অথচ এঁদেরই ভোটে নির্বাচিত সরকার বৈধভাবে আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে থাকবেন– এ কেমন রঙ্গজাদু? সবথেকে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটা বোধহয় এরকম। নাগরিকত্বের শংসাপত্র পেতে আপনি যে-মুহূর্তে সিএএ-র নির্দেশনা অনুযায়ী আবেদন করলেন, আপনারই স্বীকৃতিমতে কিন্তু আপনি আর ভারতের নাগরিক রইলেন না। কিন্তু আপনার জমা দেওয়া নথিপত্র যদি সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের পছন্দ না হয়? এর ফলে যদি খারিজ হয়ে যায় আপনার নাগরিকত্বের আবেদন, তখন আপনার এই রাষ্ট্রে অবস্থানটা কী হবে? ডি-ভোটার, না কি সন্দেহভাজন অনুপ্রবেশকারী?
[আরও পড়ুন: চোটে আইপিএলের বাইরে মহম্মদ শামি, বিকল্প হিসেবে প্রাক্তন নাইটকে নিল গুজরাট টাইটান্স]
এই বিষয়ে সিএএ-র সপক্ষে সবচেয়ে জোরালো সওয়াল করে থাকা মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও কিন্তু নিঃসংশয় নন বলেই মনে হচ্ছে। বছর পঁাচেক আগে তঁার সেই বহুচর্চিত ‘ক্রোনোলজি’ বুঝে নেওয়ার সাবধানবাণীটি এখনও অনেকেই ভুলে যাননি। ফলে, ভোটের বাজারে বিজেপি নেতারা সিএএ-র পরের ধাপে ভারতের সব রাজ্যে এনআরসি-র অর্থাৎ জাতীয় নাগরিকপঞ্জির বাস্তবায়ন নিয়ে মুখে কুলুপ অঁাটলেও, এনআরসি এবং ডিটেনশন ক্যাম্পের আতঙ্ক এখনও পিছু ছাড়ছে না খেটে খাওয়া মানুষদের।
এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিই, অসমে প্রথম পর্যায়ের এনআরসি-র পরে ৩ কোটি ৩০ লক্ষ আবেদনকারীর মধ্যে যে ১৯ লক্ষ মানুষ বাদ পড়ে গিয়েছিলেন, তঁাদের তিন-চতুর্থাংশই ছিলেন হিন্দু। এহ বাহ্য, যঁারা করদাতাদের পরিশ্রমার্জিত অর্থের অপরিমিত অপব্যয়ের মূল্যে প্রস্তুত এই নাগরিকপঞ্জিতে শেষমেশ উঠলেন, তঁাদের নাগরিকত্বও এখনও পর্যন্ত এ-দেশের সর্বোচ্চ আইনি সিলমোহর পেল না। এই ডামাডোলের বাতাবরণে, অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নকে প্রায় কবর দিয়ে তড়িঘড়ি সিএএ কার্যকর হয় গেল।
পশ্চিমবাংলার মতুয়া সম্প্রদায় সিএএ-র দাবিতে বহু দিন ধরেই আন্দোলন করেছে। এর কারণটা সহজবোধ্য, হয়তো তঁাদের নাগরিকত্বের প্রতি একটা অবিশ্বাস সরকারেরই বিভিন্ন মহলে থেকে গিয়েছে, হয়তো তার দরুন বিভিন্ন নাগরিক পরিষেবা পেতে তঁাদের কোথাও একটা অসুবিধা হয় আসছে। সিএএ-কে এঁদের সামনে
সব সমস্যার একটাই সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হলেও, ভারতের নির্বাচনে এত দিন ধরে মতদান করে এসে এখন এঁরাই কি ভারতের নাগরিকত্বের আবেদন করবেন? অর্থাৎ সজ্ঞানে মেনে নেবেন যে, এত দিন নাগরিক না হয়েও তঁারা এই দেশের সরকার নির্বাচন করেছেন? না কি ভোটার কার্ড যে আছে, সেটা লুকিয়ে আবেদন
জানাবেন এবং ভবিষ্যতে আরও বড় আইনের ফঁাকে পড়ার সম্ভাবনাটি নিজেরাই প্রস্তুত করবেন? রাষ্ট্রের উত্তর স্বভাবতই স্তব্ধতা।
যে-সমস্যাগুলো আসলে খুব সহজে সমাধান করা যায়, তাদের পুষে রেখে পরে প্রয়োজনমতো বড় করে নিয়ে মানুষে-মানুষে বিভেদের রাজনীতি পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। ১৯৩৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর একইভাবে জার্মানিতে কায়েম হয়েছিল ন্যুরেমবার্গ আইন। যে-আইনের ভিত্তিতে, নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে, ক্ষমতাসীন নাৎসি পার্টি জার্মান এবং ইহুদিদের মধ্যে জাতির ভিত্তিতে বিভাজনের উপর লাগিয়েছিল রাষ্ট্রীয় সিলমোহর। অদূর ভবিষ্যতে নাৎসি জার্মানি তথা সারা পৃথিবীর উপর এর কী সুদূরপ্রসারী ফল হয়েছিল, সেটা যেন এখনকার দিনে দঁাড়িয়ে আমরা ভুলে না যাই।
(মতামত নিজস্ব)