কৃশানু মজুমদার: “লেকিন খোঁকি তুমি শ্বশুরবাড়ি যাবে না, হামাকে ছেড়ে কোথা যাবে না। আমি শ্বশুরকে মারবে…”
এই সংলাপ শুনলেই আমবাঙালির চোখের সামনে ফুটে ওঠে এক কাবুলিওয়ালার (Kabuliwala) ছবি। বাঙালির সেই চিরচেনা কাবুলিওয়ালা ছবি বিশ্বাস (Chhabi Biswas)। পরদার মিথ হয়ে ওঠা রহমত শেখকে তো চেনেন সবাই। কিন্তু ক’ জন আর জানেন ছবি বিশ্বাসের কাবুলিওয়ালা হয়ে ওঠার পিছনে ছিলেন আরও একজন। যাঁর আদব কায়দা, আচার আচরণ অনুকরণ করেছিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা। ছোট জাগুলিয়ায় ছবি বিশ্বাসের আদি বাড়িতে গিয়ে জানা গেল সেই অজানা কাহিনি।
নব্বই বছরের বৃদ্ধ অধীর দাস কাঁপা কাঁপা গলায় সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল-কে বললেন, “তপন সিনহার সিনেমায় অভিনয়ের জন্য মাইনে দিয়ে একজন আসল কাবুলিওয়ালা রেখেছিলেন ছবি বিশ্বাস। দিনের পর দিন তাঁর আচার, আচরণ দেখে সেভাবেই নিজেকে তৈরি করতেন তিনি। চরিত্রের মধ্যে পুরোপুরি ঢুকে যাওয়ার জন্য এই পথ নিয়েছিলেন। পরদায় যাতে নিজেকে নিখুঁত ভাবে তুলে ধরতে পারেন, সে জন্য একদিন কাবুলিওয়ালাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার কথা জানান। দেখতে চান তাঁর প্রতিক্রিয়া। কাজ হারানোর কথা শুনে মাথা নিচু করে চলে যাওয়ার উপক্রম করে সেই কাবুলিওয়ালা। তখন ছবিবাবু তাঁর হাত চেপে ধরে বলেন, সিনেমার পরদায় নিখুঁত ভাবে চরিত্র উপস্থাপিত করার জন্যই কাবুলিওয়ালাকে তিনি আঘাত করেন। মানসিক আঘাত পেলে প্রতিক্রিয়া কেমন হয়, তা জানাই ছিল আসল উদ্দেশ্য।” ধীর কণ্ঠে কথাগুলো বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন নবতিপর বৃদ্ধ।
[আরও পড়ুন: Afghanistan Crisis: বাড়ি পুড়িয়েছে তালিবান, ভারতে আশ্রয় পেয়ে ধন্যবাদ আফগান মহিলার]
আফগান-মুলুক (Afghanistan) এখন অশান্ত। টেলিভিশনের পরদায় সে দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার ছবি দেখানো হচ্ছে। রবি ঠাকুরের ছোটগল্প অবলম্বনে তৈরি ‘কাবুলিওয়ালা’ সিনেমার ক্লিপিং ব্যবহার করা হচ্ছে গণমাধ্যমে। ছবি বিশ্বাসকে দেখেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাঙালি চিনেছে কাবুলিওয়ালাকে। সেই ছবি স্মৃতিতে এতটাই জাঁকিয়ে বসে রয়েছে যে তাকে মুছে ফেলা সম্ভবই নয়। ঠিক তেমনই ছোট জাগুলিয়ার ধুলো ওড়া রাস্তায় ছড়িয়ে রয়েছে ছবি বিশ্বাসের নানা কিংবদন্তি। দুর্গাপুজোর সময় আসতেন আদিবাড়ি কালী নিকেতনে। প্রায় দুশো বছরের সেই বাড়ি এখন ছবি বিশ্বাসের বাড়ি হিসেবেই বিখ্যাত। এই বাড়িতে একদা এসেছিলেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয়ও।
তিন মহল্লার বাড়িটায় ছিল দুটো উঠোন। চারদিকে ছিল বাড়ি। সিঁড়ি ছিল সেগুন কাঠের তৈরি। ঠাকুরদালান ছিল। ধীরে ধীরে সব বিক্রি হয়ে যায়। এখন আর ডাকসাইটে অভিনেতার শিকড় নেই বাড়িটিতে। বাড়িটির একটা অংশ কিনে নেন রঞ্জনকান্তি নাথ। মুদির দোকান দিয়েছেন তিনি। সেই দোকানে বসে রঞ্জনবাবু বলছিলেন, “এই বাড়িটা ছবি বিশ্বাসের ঠাকুরদা কালী বিশ্বাসের বাড়ি। পুজোর সময় নিজের হাতে গ্রামবাসীদের ভোগ বিতরণ করতেন, জামাকাপড় দিতেন ছবি বিশ্বাস। পুজোর সময়ে চলে আসতেন। এই গ্রামেই থাকতেন। কিন্তু এখন আর ওই পরিবারের কেউ এখানে থাকেন না। সামনের অংশটা এক ভদ্রলোক কিনেছেন। সেই অংশটাই আছে। বাকি অংশ প্রায় ভেঙে পড়ে গিয়েছে।” কথাগুলো সিনেপ্রিয় বাঙালিকে মনে করাবে ‘জলসাঘর’ সিনেমার জমিদার বিশ্বম্ভর রায়কে।
জনশ্রুতি বলে, দিলদরিয়া মানুষ ছিলেন কিংবদন্তি এই অভিনেতা। ছোট জাগুলিয়ায় সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য প্রায় ১৮ বিঘা জমি তিনি দান করেছিলেন। সেই কাহিনি এখন মিথের পর্যায়ে পর্যবসিত হয়েছে। সেখানকার বয়স্ক মানুষরা এখনও ছবি বিশ্বাসকে ‘দাদু’ বলে সম্বোধন করেন। তাঁর বাড়ি সংলগ্ন যে চায়ের দোকান রয়েছে, সেখানে বসে দীন আলি বলছিলেন, “দাদু সবাইকে জামাকাপড় দিতেন। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভেদাভেদ করতেন না। কলকাতা থেকে আমাদের জন্য বিস্কুট, লজেন্স আনতেন।” পরদার রহমত তো ঠিক এভাবেই ‘মিনি খোঁকী’কে পেস্তা, বাদাম দিত। শুধু কী তাই! এলাকার শিক্ষার উন্নয়নেও এগিয়ে এসেছিলেন ছবি বিশ্বাস। গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান নীলরতন ঘোষ ‘ছোট জাগুলিয়ার ইতিবৃত্ত’ নামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে অভিনেতাকে নিয়ে একটি অধ্যায়ও রয়েছে। তিনি বলছিলেন, “স্কুলের উন্নয়নের জন্য বিশ্বরূপায় চ্যারিটি শো করেছিলেন ছবি বিশ্বাস।” আরও গভীরে গিয়ে নীলরতনবাবু বলছিলেন, “বিডন স্ট্রিটে জন্ম হয়েছিল ছবি বিশ্বাসের। ওঁর আসল নাম শচীন্দ্রনাথ দে বিশ্বাস। কিন্তু ছবি নামের জনপ্রিয়তায় আড়াল হয়ে যায় আসল নামটি।”
যে রহমত শেখকে পরদায় দেখে বাঙালির প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠা, চিনে নেওয়া একটুকরো পাহাড়ি আফগানিস্তানকে, বাঙালির নিজের ‘কাবুলিওয়ালা’র সমস্ত কালজয়ী সংলাপ যেন আজও অনুরণিত হয় ওই বাড়ির অন্দরমহলে।