সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: নাসিম শাহের বলটা লং অনে ঠেলেই দৌড় শুরু করলেন লোকেশ রাহুল (KL Rahul)।
এ তাঁর জীবনের দৌড়। ভেসে থাকার দৌড়।
উলটো দিকে দাঁড়ানো বিরাট কোহলির (Virat Kohli) তাড়ায় এক রানকে দু’ রানে পরিণত করলেন রাহুল। ৯৮ থেকে তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছলেন তিনি।
তার পরের দৃশ্য, রাহুল ব্যাট তুলে ধরেছেন আকাশের দিকে। প্রেমদাসায় সাররিয়ালিস্ট ছবি।
রাহুলকে ওই ভঙ্গিমায় সেঞ্চুরি উদযাপন করতে দেখে কল্পকাহিনির হিম্যানের সেই আইকনিক মন্তব্য মনে পড়ে যেতে বাধ্য, ”আই অ্যাম দ্য মাস্টার অফ দিস ইউনিভার্স।”
রাহুল বলতেই পারেন, তিনিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মালিক। প্রত্যাবর্তনের ম্যাচে সেঞ্চুরি পেলে এমন মনে হওয়াই যে স্বাভাবিক।
নিন্দুকদের ধেয়ে আসা সমালোচনা একসময়ে ক্ষতবিক্ষত করেছিল তাঁকে, অনেকেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন রাহুলকে নিয়ে। বিশ্বকাপের দলে কেন তিনি? কী এমন করলেন যে এশিয়া কাপেও জায়গা হয়ে গেল তাঁর? এমন সব প্রশ্ন উড়ে এসেছিল কর্ণাটকীর দিকে।
[আরও পড়ুন: বিশ্বকাপে কি যুবি হতে পারবেন হার্দিক-জাদেজা? বিতর্কে জড়ালেন মঞ্জরেকর ও ওয়াকার ইউনিস]
মাঠের বাইরে থেকে ছুঁড়ে দেওয়া সব নিন্দা-সমালোচনার জবাব মাঠে নেমেই দিলেন লোকেশ রাহুল। পারফর্মাররা তো এমনই এক মঞ্চ খোঁজেন। এমন মঞ্চেই জ্বলে ওঠেন। হিম্যানের ছিল সোর্ড। রাহুলের ‘গাণ্ডীব’ ব্যাট।
এর আগে ক্রিকেট মাঠে রাহুল বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ধরা দিয়েছেন। চোখ বন্ধ করে কানে আঙুল দিয়ে রয়েছেন তিনি। এই ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ার আনাচকানাচে। রাহুল বোধহয়, বোঝাতে চেয়েছিলেন, বাইরের সমালোচনা তাঁকে স্পর্শ করে না। তাঁর কানে ঢোকে না সে সব। কলম্বোয় সেঞ্চুরির পরে তাঁর অভিনব উদযাপন সব অর্থেই তাৎপর্যপূর্ণ।
তার পরের ফ্রেমটা মনে করে দেখুন। ক্যামেরা সামনে থেকে ধরেছে রাহুলকে। তাঁর চোখ-মুখের অভিব্যক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করছে ক্যামেরা। রাহুলের চোখের আগুন সহজেই পড়া যায়। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে তাঁর মনও পড়ে নেওয়া যায় সহজেই। সমালোচকদের দেখিয়ে দেওয়ার জেদ ধরা পড়েছে তাঁর চোখে-মুখে। ছিল নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ। ছিল রানের প্রবল খিদেও। অনেককিছু বলে দিচ্ছিল রাহুলের ওই লড়াকু সেঞ্চুরি।
তাঁর কাছে এগিয়ে এলেন বিরাট কোহলি। জড়িয়ে ধরলেন রাহুলকে। বাইশ গজে কোহলি আলিঙ্গন করলেন ঠিকই। কিন্তু এ তো আসলে গোটা দেশের আলিঙ্গন। রাহুল স্বস্তি ফেরালেন ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে। রোহিত শর্মা-রাহুল দ্রাবিড়কেও কি স্বস্তিতে রাখলেন না কর্ণাটকী?
ফিরে আসা বোধহয় একেই বলে! প্রত্যাবর্তনের রাহুলের দিকে চোখ ছিল সবার। আইপিএল চলাকালীন চোট পেয়েছিলেন। ১ মে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিরুদ্ধে ফিল্ডিংয়ের সময়ে মারাত্মক চোট হয়তো তাঁকে ছিটকেই দিত চিরকালের জন্য। এক সাক্ষাৎকারে সেই অন্ধকার সময়ের কথা বলেছেন রাহুল, “বল তাড়া করছিলাম। টেন্ডন ছিঁড়ে যায়। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল।
আমার পরিবার ভেবেছিল চোট হয়তো তেমন গুরুতর নয়। ভেবেছিল, খুব একটা বেশি ছিঁড়ে যায়নি টেন্ডন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হয়তো সব ঠিক হয়ে যাব। কিন্তু স্ক্যান রিপোর্ট এলে ভুল ভাঙে। বোঝা যায় পুরোটাই ছিঁড়ে গিয়েছে টেন্ডন। তখনই বোঝা গিয়েছিল অস্ত্রোপচার করতেই হবে। ওই একটাই রাস্তা খোলা আছে।”
তার কয়েকদিন আগেই বিয়ে করেছেন সুনীল শেট্টীর মেয়ে আথিয়াকে। অনিশ্চয়তায় মোড়া এক জীবন অপেক্ষা করছিল নব দম্পতির সামনে।
ক্রিকেটমাঠ থেকে ছিটকে গেলেন রাহুল। খবরে নেই তিনি। ধেয়ে আসে সমালোচনা। চলে নিন্দা। সুযোগের অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন। অস্ত্রোপচার করে ফিরলেন। নিঃশব্দে নীরবে ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে তৈরি হচ্ছিলেন বড় এক যুদ্ধের জন্য। এশিয়া কাপের (Asia Cup 2023) দলে ডাক পেলেন। কিন্তু দল যখন রওনা দিচ্ছে দ্বীপরাষ্ট্রে, তখন ফের চোট।
গ্রুপের প্রথম দুটো ম্যাচ খেলতেই পারলেন না। ফিরলেন সুপার ফোরের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে। সামনে পাকিস্তান। যে কোনও দিন ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে বড় বক্স অফিস। এই ম্যাচ মুহূর্তে বাড়িয়ে দিতে পারে একজন ক্রিকেটারের আত্মবিশ্বাস। আবার এই ম্যাচ তালগোল পাকিয়ে দিতে পারে সব।
সুপার ফোরের ভারত-পাক দ্বৈরথ গড়াল দু’দিনে। বরুণদেবতা অঝোর ধারায় ঝরলেন রবিবারের প্রেমদাসায়। প্রথম দিনের শেষে লোকেশ রাহুল অপরাজিত ১৭ রানে।
রবিবার ঠিক যেখানে শেষ হয়েছিল খেলা, সোমবার সেখান থেকেই শুরু হল মহাযুদ্ধ। নতুন করে আবার শুরু। কাজটা কঠিন। নামেই ভারতের ইনিংসের ২৪.১ ওভার শেষ হয়েছে।
আসলে তো রিজার্ভ ডে-তে ওপেন করতে নেমেছেন রাহুল ও কোহলি। কার্যত তাঁরাই হয়ে গেলেন ওপেনার। ওপেনাররা যেভাবে নতুন বল সামলান, কোহলি-রাহুল একই ভাবে পাক বোলারদের খেললেন।
রাহুলের সেঞ্চুরির পরে এক টুইটার ব্যবহারকারী লিখলেন, ”ভেঙ্কটেশ প্রসাদ নিশ্চয় কিছু টুইট করবেন এবার লোকেশ রাহুলকে নিয়ে।” একসময়ে রাহুলের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন প্রসাদ।
রাহুল কি প্রসাদকে উৎসর্গ করলেন এই সেঞ্চুরি? হয়তো তাই, হয়তো নয়। আরেক টুইটার ব্যবহারকারী লিখলেন, ”প্রায় চার মাস মাঠের বাইরে, একটি ম্যাচও খেলেননি, সন্দেহ ছিল আপনাকে নিয়ে, কয়েকজন ভক্ত-প্রাক্তন ক্রিকেটাররা আপনার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন…চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে অবশেষে দুর্দান্ত ভাবে ফিরলেন। নিজেই উত্তর দিয়ে গেলেন।”
দিনান্তে ১১১ রানে অপরাজিত রাহুল। বাইশ গজে বিদ্যুৎগতিতে দৌড়লেন। কে বলবেন চোট সারিয়ে ফেরার পরে এটাই তাঁর প্রথম ম্যাচ! রাহুল আগুন জ্বাললেন বৃষ্টিভেজা কলম্বোয়।
পারফর্মাররা এমনই এক মঞ্চ খোঁজেন। জ্বলে ওঠেন কঠিনতম প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই। এই সেঞ্চুরিতে আছে আনন্দ। এই সেঞ্চুরি ভুলিয়ে দেয় অনেক যন্ত্রণা। আকাশের দিকে তাকিয়ে তাই বলতে ইচ্ছা করে, ”আই অ্যাম দ্য মাস্টার অফ দিস ইউনিভার্স।” আমিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর।