সুকুমার সরকার, ঢাকা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তাঁর উত্তরসূরি শেখ হাসিনাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে ২৩ বার চেষ্টা চালিয়েছে পাকপন্থী জঙ্গিরা। বেশ কয়েকজন সঙ্গী প্রাণ হারালেও কোনওক্রমে রক্ষা পান মুজিবকন্যা। আজ ২১ আগস্ট। বারুদ আর রক্তমাখা নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞের দিন। নারকীয় গ্রেনেড হামলার ১৯তম বার্ষিকী।
বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের এই দিনে রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামি লিগের ‘সন্ত্রাস ও দুর্নীতিবিরোধী’ শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা চালানো হয়। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ হয়ে উঠেছিল মৃত্যুপুরী। শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে শত শত কর্মীর আর্তনাদ। চরম আতঙ্ক। তবে কঠিন সময়েও তাঁরা ভুলে যাননি প্রিয় নেত্রী হাসিনাকে। মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের মধ্যেও আওয়ামি লিগের নেতাকর্মীরা মানবপ্রাচীর তৈরি করে তাঁকে আগলে রাখেন। এভাবে মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে গেলেও কানে আঘাত পান আওয়ামি লিগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এই দিনটি স্মরণে গ্রেনেড হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার সকালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামি লিগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তিনি শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে গ্রেনেড হামলা স্মরণে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আয়োজিত আলোচনা সভায় অংশ নেন হাসিনা। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পৈশাচিক এই হামলায় সেদিন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মহম্মদ জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও মহিলা আওয়ামি লিগ সভাপতি বেগম আইভি রহমান-সহ ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina)।
সেদিন শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে মানবঢাল তৈরি করে প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন দলের নেতাকর্মীরা। শুধু গ্রেনেড হামলাই নয়, সেদিন মুজিবকন্যাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে চালানো হয় গুলিও। হাসিনার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেদিন গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী-সহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও। আহত নেতাকর্মী-সমর্থকদের অনেকে শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে এখনও বেঁচে আছেন। তৎকালীন বিএনপি-জামাত সরকারের রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় প্রকাশ্য আওয়ামি লিগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।’
জানা যায়, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মতোই ২১ আগস্টের হামলার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করা হয়েছিল। ২০০৪ সালের কিছু সামরিক আধিকারিক ও জঙ্গি নেতাদের নিয়ে খালেদা জিয়ার ভবনে বসে ক্ষমতায় থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তথা খালেদাপুত্র তারেক রহমানের নির্দেশে এটা চূড়ান্ত করা হয়। হামলায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের পাকিস্তানে ট্রেনিং দেওয়া হয়। ট্রেনিংয়ের পর তাদের গ্রেনেড সরবরাহ করে পাকিস্তান। আর হামলা শেষে পাকিস্তান ঘাতকদের আশ্রয়ও দেয়। ১৯ বছর আগে এই দিনে মুহুর্মুহু গ্রেনেডের বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ।
[আরও পড়ুন: বাংলাদেশে ‘লঙ্কাকাণ্ড’, মন্ত্রীদের মরিচগুঁড়ো ও শুকনো পেঁয়াজকুচি দিলেন হাসিনা]
সেই হামলায় পঙ্গু হলেও বেঁচে প্রাণে বেঁচে যান মহিলা আওয়ামি লিগের নেত্রী ও জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের প্রাক্তন সাংসদ নাসিমা ফেরদৌসী। তিনি বলেন, “মাথা, বুক, দুই পা, পেট—সর্বাঙ্গে বিঁধে আছে অসংখ্য স্প্লিন্টার। সেদিন মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি, মরে গেছি ভেবে লাশের ট্রাকে তুলেছিল, ঢাকা মেডিক্যালের করিডোরেও রেখেছিল, কিন্তু জ্ঞান ফিরে আসায় চিৎকার করে উঠি, তারপরই সবাই বোঝে আমি মরিনি, তখনও বেঁচে আছি। এখনো ভাবি, আর কিছুক্ষণ পর যদি জ্ঞান ফিরত তাহলে হয়তো মর্গেই চলে যেতাম।”
অ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল শরীরে ৩৫০টি স্প্লিন্টার নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন। বাম পায়ের পুড়ে যাওয়া অংশে রক্ত সঞ্চালন নেই। শুধু কোমরের এক জায়গায় ৫২টা স্প্লিন্টার, পায়েও আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। আহতদের একজন বর্তমান ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়াম লিগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান বলেন, “কিডনি, রক্তনালি-সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এখনও ৫৮টি স্প্লিন্টার রয়েছে।”
এই বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছিলেন- আইভি রহমান, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব) মাহবুবুর রশিদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন, ইসাহাক মিয়াসহ ২৪ জন। ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। নারী নেত্রী আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ২৪ আগস্ট মারা যান।