নিজস্ব সংবাদদাতা, ঢাকা: বিদ্যুতের কোটি কোটি টাকা বকেয়া। ধারের টাকায় ঘর আলো হয়েছিল বাংলাদেশে। কিন্তু বকেয়া অর্থ মেটাতে 'তাগাদা' দিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে চিঠি পাঠালেন ভারতের আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি। প্রথমবারের মতো পাঠানো চিঠিতে বকেয়া আদায়ে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে। বকেয়া টাকা পরিশোধে দেরি হওয়ায় বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঋণদাতা সংস্থা ও অংশীদারদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়ার কথা জানিয়েছেন আদানির চেয়ারম্যান। এদিকে, বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে আদানির চিঠি বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের কাছে আদানিদের প্রাপ্য বকেয়ার পরিমাণ ৪৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৫,৭০৭ কোটি টাকা।
চিঠি প্রাপ্তির বিষয়টি স্বীকার করে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আদানির বকেয়া পাওনা পরিশোধের বিষয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বকেয়া টাকা কীভাবে পরিশোধ করা হবে, সেটি নিয়ে কাজ চলছে। ওই কর্মকর্তা জানান, গত জুলাইয়ে আদানির সব বকেয়া পরিশোধ করা হয়। এরপর নতুন করে এই পরিমাণ টাকা বকেয়া পড়েছে।
চলতি বছরের জুন মাসে একই বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত আদানি পাওয়ারের বকেয়া ৪৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার একসঙ্গে পরিশোধ করা হয়। তখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে আদানির পাওয়া সবচেয়ে বড় এককালীন অর্থপ্রাপ্তি। এর আগে ভারতীয় এই কোম্পানিটি বিদ্যুতের বিল হিসেবে প্রতি মাসে বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৯০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার করে পেত। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মহম্মদ ফাওজুল কবীর খান বলেন, ‘‘এখন যে বকেয়া জমা হয়েছে, সেটাই সাম্প্রতিক। এর আগে এই বছরেই একসঙ্গে সব বকেয়া পরিশোধ করা হয়েছিল। এখন বকেয়া পরিশোধের বিষয়টি নিয়ে পিডিবি কাজ করছে। এটা নীতিগত কোনো বিষয় নয়। এন্টারপ্রাইজ লেভেলের ইস্যু। বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তিত নই।’’
গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টাকে লেখা চিঠিতে আদানির চেয়ারম্যান উল্লেখ করেন, আদানি পাওয়ারের গোড্ডা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহে পিডিবির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। আমরা এ পর্যন্ত প্রাপ্ত অর্থ পরিশোধের বিষয়টি স্বীকার ও প্রশংসা করি। বিশেষ করে চলতি বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিশোধিত অর্থ, যা আমাদের বকেয়া স্থিতি আংশিকভাবে কমাতে সাহায্য করেছে। একইভাবে জ্বালানি ও খুচরা যন্ত্রাংশ সংগ্রহের সঙ্গে সম্পর্কিত আমাদের অন্য সংস্থানগুলো পরিচালনায় কষ্ট লাঘব করতেও সাহায্য করেছে। তবে এখনো প্রায় ৪৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বকেয়া রয়েছে। এই বকেয়া পরিশোধে বিলম্ব আমাদের ঋণদাতা এবং অংশীদারদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ''চলতি বছরের ২৩ জুন পিডিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে, লেট পেমেন্ট সারচার্জ-সহ সব বকেয়া ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিশোধ করা হবে। কিন্তু বর্তমান বকেয়া নিয়ে বেশ উদ্বেগে ঋণদাতারা। কারণ, কোনও সুনির্দিষ্ট সময়সূচি বা কোনও চূড়ান্ত পরিকল্পনা এখনও পিডিবি থেকে জানানো হয়নি। পিডিবির কাছ থেকে ৪৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পাওনা দ্রুত নিষ্পত্তির সুবিধার্থে প্রধান উপদেষ্টা মূল্যবান হস্তক্ষেপ আন্তরিকভাবে কামনা করছি। আমরা আমাদের অংশীদারত্বকে আরও জোরদার করতে এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত করতে আগ্রহী।''
এদিকে, আদানির সঙ্গে পিডিবির কয়লার দাম নিয়ে বিরোধ এখনো অমীমাংসিত থেকে গেছে। মতবিরোধটি ঝাড়খণ্ড প্লান্টে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট ব্যয় নিয়ে। গত জুনে একটি ভারচুয়াল বৈঠকে বিপিডিবি কর্মকর্তারা আদানির কয়লার মূল্য নির্ধারণের সূত্রটি ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য করার প্রস্তাব করেন। আদানি বিদ্যমান পিপিএর (বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি) নির্দিষ্ট শর্তাবলি উল্লেখ করে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। একই বৈঠকে আদানি প্লান্টের নির্ভরতাযোগ্য সক্ষমতা (ডিপেন্ডেবল ক্যাপাসিটি) সংশোধনের অনুরোধ করা হয়। পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, যদি কোম্পানিটি বিতর্কিত শুল্ক পর্যালোচনায় সম্মত হয়, তাহলে আদানি পাওয়ারকে শীতকালে ভারতীয় বাজারে বিদ্যুৎ বিক্রির প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হবে। পাশাপাশি সক্ষমতা সংশোধনের জন্য একটি সম্পূরক চুক্তির প্রয়োজন হবে। তারিখ নির্ধারিত না হলেও উভয় পক্ষই অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য শিগগির একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করতে সম্মত হয়েছে।
আওয়ামি লিগ সরকারের আমলেই সরকারের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ভারতীয় কোম্পানি আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়। পরে আওয়ামি লিগ সরকারের পতনের পর চুক্তি বাতিলের দাবি উঠে। ব্যাপক সমালোচনার পর সরকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি আদানির চুক্তি এবং পূর্ববর্তী আওয়ামি লিগ সরকারের আমলে খোলা টেন্ডার ছাড়াই স্বাক্ষরিত আরও সাতটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করেছে। পরে পর্যালোচনা কমিটি আদানির চুক্তি আন্তর্জাতিক চুক্তি হওয়ার কারণে পিডিবিকে সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক সালিশ কেন্দ্রের (এসআইএসি) মাধ্যমে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করে।
২০১৭ সালে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডা জেলায় ১ হাজার ৪৯৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করে তৎকালীন সরকার। একই বছর আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করে পিডিবি। চুক্তি অনুযায়ী, এই কেন্দ্র থেকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ কেনা হবে।
