সুকুমার সরকার, ঢাকা: কর্মপাগল মানুষ বাংলাদেশের (Bangladesh) বিখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ সামন্ত লাল সেন। রাজনীতিবিদ নন। পেশা মানুষের সেবা করা। আর সেই সামন্ত লাল সেনকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina) তাঁর নয়া মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে দেশবাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছেন। আর এমন সুযোগ পেয়ে আনন্দে, বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন বিখ্যাত চিকিৎসক। ডাঃ সামন্ত লাল সেনের কথায়, ”রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না, তাই কোনওদিন ভাবিনি যে মন্ত্রী হব।” কিন্তু এবার তাঁকেই স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রকের (টেকনোক্র্যাট) দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ডাঃ সামন্ত লাল সেন আসলে কেমন মানুষ, কতটা কাজপাগল চিকিৎসক, দু-একটি ঘটনা জানলেই তা বোঝা যায়। ২০১০ সালের একটি ঘটনা। বাড়িতে রাতের খাবার খেতে বসেছেন। হঠাৎই ফোন বেজে উঠল। হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছে। ফোনের ওই পাশের কণ্ঠস্বর জানাল, হাসপাতালে প্রচুর দগ্ধ রোগী আসছেন। ভয়াবহ অবস্থা। হিমশিম খেয়ে যেতে হচ্ছে তাদের। তিনি যেন এখনই চলে আসেন। খাবার না খেয়েই তিনি কর্মস্থল ঢাকা (Dhaka) মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন। নিজেই গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে গেলেন হাসপাতালে। গিয়ে যা দেখলেন তা শিউরে ওঠার মতো। পুড়ে (Burnt) যাওয়া রোগীদের লাশ আর লাশ।আত্মীয়স্বজনের চিৎকার আর আহাজারিতে হাসপাতালের বাতাস তখন ভারী হয়ে উঠেছে।
বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির (Plastic Surgery) জাতীয় প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন। ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলিতে একটি কেমিক্যালের গুদাম থেকে আগুন লেগেছিল। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর শতাধিক পোড়া রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন তিনি এবং তাঁর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের দল। এত পোড়া রোগী আর কখনও দেখেননি তিনি। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কীভাবে সামলাবেন এঁদের? ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন যেন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন। দগ্ধ রোগীদের যেন চিকিৎসা করে বাঁচিয়ে তুলতে পারেন। সারা জীবন চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত। সেই ডাঃ সামন্ত লাল সেন টেকনোক্রেট কোটায় মন্ত্রী হলেন। চিকিৎসাসেবায় (Treatment) বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা আকাডেমি তাঁকে ২০১৮ সালে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে।
[আরও পড়ুন: মুম্বইতে গ্র্যান্ড রিসেপশন আমিরকন্যা ইরা খানের, আমন্ত্রিত নেতামন্ত্রীরা, ২৫০০ অতিথি! ৯ রাজ্যের পদ]
দেশের পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার নাগুরা গ্রামে ১৯৪৯ সালের ২৪ নভেম্বর জন্ম ডাঃ সেনের।খুব প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। বাবা জিতেন্দ্র লাল সেন সরকারি চাকরি করতেন। সেনের বাবার খুব ইচ্ছে ছিল তাঁর ছেলে চিকিৎসক (Doctor) হবে। ছোটবেলায় ডাক্তার সেজে কলাগাছে ইঞ্জেকশন দিতেন তিনি। ১৯৬৪ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন সামন্ত লাল। দিনাজপুর জেলার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এর পর চট্টগ্রাম (Chattogram) মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হন। ৭২-৭৩ সালে পাস করে বের হন। ১৯৮০ সালে ভিয়েনা থেকে প্লাস্টিক সার্জারিতে ডিপ্লোমা করেছেন। পরে জার্মানি ও ইংল্যান্ডে প্রশিক্ষণ নেন। ডাক্তারি পাস করার পর হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে প্রথম কাজ শুরু করেন। সাইকেল চালিয়ে, নৌকায় চড়ে রোগী দেখে বেড়াতেন। তখন সবেমাত্র পাশ করে বেরিয়েছেন। রোগী দেখতে গেলে কাঁসার থালায় অনেক রকম খাবার দিত সেসব পরিবার আর তার পাশে থাকত চিকিৎসার জন্য টাকা। একদম জামাই আদর যাকে বলে! বর্তমানে এক ছেলে, এক মেয়ের বাবা ডাঃ সেন। স্ত্রী রত্না সেন।
ডাঃ সেনের কথায়, ”আমি প্লাস্টিক সার্জারি নিয়ে লেখাপড়া শুরু করলাম। তখন স্বপ্ন দেখতাম প্লাস্টিক সার্জারি করে মানুষের চেহারা সুন্দর করব। আর অনেক টাকা রোজগার করব। ১৯৮২ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে বদলি হয়ে আসার পর দগ্ধ রোগীদের খুব কাতর অবস্থা দেখতাম। তাঁরা মাটিতে পরে থাকতেন, পথে পড়ে থাকতেন। এঁদের দেখে আমার মানসিকতার পরিবর্তন হল। এর পর তাঁদের নিয়েই পুরোদমে কাজ শুরু করে দিলাম।” এসব রোগীদের জন্য যখন হাসপাতাল করতে চেয়ে মন্ত্রকে ঘুরেছেন, তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগত বলে জানান দেশের নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এর পর ১৯৮৬ সালে দগ্ধ রোগীদের জন্য সরকারের কাছে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ তৈরি করার প্রস্তাব দেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে বার্ন ইউনিট তৈরির কাজ চলে। ২০০৩ সালে ইউনিটটি উদ্বোধন হয়। পাঁচটি বেড নিয়ে ইউনিট চালু হয়েছিল।
[আরও পড়ুন: বিয়ের আগেই রামমন্দিরে পুজো দিলেন রকুলপ্রীত-জ্যাকি ভাগনানি! প্রস্তুতি তুঙ্গে?]
বাংলাদেশের নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভীষণ প্রিয় উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা আর পুরনো দিনের গান। মাঝে মাঝে মজা করে বলেন, ”বাঙালির মধ্যে আছে শুধু তিন সেন। সুচিত্রা সেন, অমর্ত্য সেন আর আমি – সামন্ত লাল সেন।” তাঁর আশা, স্বপ্ন একটাই – বাংলাদেশের পুড়ে যাওয়ার কোনও রোগী যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়। এক জন্য বার্ন ইউনিটকে ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করা হচ্ছে।