সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: মুজিব কন্যার বাংলাদেশ ত্যাগের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাত ধরে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন সেখানকার প্রায় ১৭ কোটি মানুষ। এই সংখ্যার ভিড়ে এমন কিছু মানুষও রয়েছেন যারা স্বপ্নেও কখনও ভাবেননি আবার কখনও মুক্ত পৃথিবীতে শ্বাস নিতে পারবেন। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে একের পর এক বিশাল দুর্নীতি ও অত্যাচারের তথ্য। তবে সে সব ছাপিয়ে জনমানসের কৌতুহল কেন্দ্রীভূত হয়েছে প্রাক্তন শাসকের তৈরি ভয়াল 'আয়না ঘরে'। সংবাদমাধ্যমের দৌলতে প্রকাশ্যে আসছে নির্যাতনের প্রতীক এই গুপ্ত কুঠুরির গোপন রহস্য। যেখানে ঈশ্বরের কাছে মুক্তি নয়, মৃত্যুর প্রার্থনা করেন বন্দিরা।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর সরকারের বিরোধিতা করা অন্তত ৭০০ মানুষ স্রেফ গুম হয়ে যান। যদিও দাবি করা হয়, বাস্তব সংখ্যাটা এর চেয়ে আরও বেশি। বাংলাদেশের মানুষ জানতেন গুম হয়ে যাওয়া সেই সব মানুষকে রাখা হয়েছে 'আয়না ঘরে'। তবে কোথায় এই আয়না ঘর? কেমন তার চেহারা সে বিষয়ে কোনও ধারণা ছিল না কারও। জানা যেত, এ এক গোপন কুঠুরি। যেখানে একবার গেলে কেউ ফেরে না। সরকার পতনের পর এই আয়না ঘর নিয়ে কৌতুহল তুঙ্গে ওঠে মানুষের। একাধিক সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই আয়না ঘর হল বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর এক গোপন কুঠুরি। যেখানে সত্যজিৎ রায়ের 'হীরক রাজার' মতোই চলত বিরোধীদের মগজ ধোলাই ও অত্যাচার।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টে জানা যায়, হাসিনা সরকারের বিরোধিতা করছেন, বা সরকারের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে এমন ব্যক্তিদের অপহরণ করে আনতেন নিরাপত্তা এজেন্সির লোকেরা। সাদা পোশাকে তাঁদের বাড়ি, অফিস, বাস, ট্রেন থেকে অপহরণ করে আনা হত। পরে সরকারি এজেন্সি তাঁদের গ্রেপ্তারের দায় সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করত। বছরের পর বছর ধরে বিনা বিচারে তাঁদের বন্দি করে রাখা হত এই আয়না ঘরে। চলত অকথ্য নির্যাতন। জানা যায়, বহু মানুষকে হত্যা করে লাশ গুম করে দেওয়া হয়েছে এখানে। হাসিনা জমানায় বাংলাদেশের এই আয়না ঘর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রিপোর্টেও জায়গা করে নিয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রসংঘও এই আয়না ঘর নিয়ে সরকারকে সতর্ক করে। যদিও তাতে কিছুই বদল হয়নি।
এই আয়না ঘর থেকে মুক্তি পাওয়া বহু মানুষ দাবি করেছেন, যে আন্ডার গ্রাউন্ডে তাঁদের রাখা হত তার উপর সকালে মিলিটারি প্যারেড শোনা যেত। বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান জানান, ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়ার আগে ৪৬৭ দিন বন্দি ছিলেন আয়না ঘরে। মারুফ এক কালে কাতার এবং ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছিলেন। তাঁর দাবি অনুযায়ী, গুগল ম্যাপে ঢাকার সামরিক গ্যারিসনে অবস্থিত এই আয়না ঘর। যদিও অনেকের মতে, আয়না ঘর একটি নয়, দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে এই নিষ্ঠুর জেলখানা।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম অনুযায়ী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা এই আয়না ঘর পরিচালিত ছিল। ফলে সেনা জওয়ানদের বাইরে আর আরও মুখ দেখার সুযোগ ছিল না বন্দিদের। এখান থেকে মুক্তি পাওয়া অনেকের দাবি, যে ঘরে তাঁদের রাখা হত তাকে কবর বললেও কম বলা হয়। নড়াচড়ার জায়গা নেই এখানে। তবে বন্দিদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হত। একইসঙ্গে চলত চরম শারীরিক নির্যাতন। চার থেকে ছয় মাস অন্তর চুল কাটা হত বন্দিদের।
হাসিনা সরকারের পতনের পর এখান থেকে মুক্তি পেয়েছেন আইনজীবী আহমেদ বিন কাসেম। ২০১৬ সালে বন্দি করা হয়েছিল তাঁকে। দীর্ঘ ৮ বছর পর হাতকড়া পরানো অবস্থায় গোপন কুঠুরি থেকে উদ্ধার করে মুক্তি দেওয়া হয় তাঁকে। এএফপিকে তিনি বলেন, "আট বছরের মধ্যে এই প্রথম আমি মুক্ত পৃথিবীতে শ্বাস নিচ্ছি।" তাঁর দাবি অনুযায়ী, জানালাবিহীন এক ছোট ঘরে ২৪ ঘণ্টা বেঁধে রাখা হত। দিনের বেশিরভাগ সময় হাতে পরানো থাকত হাতকড়া। তাঁর দাবি অনুযায়ী, যেখানে তাঁকে বন্দি করা হয় সেখানে অন্তত ৬টি ঘর ও করিডর রয়েছে। জেলের প্রতিটি ঘরের শেষে ছিল শৌচাগার। প্রত্যেক ঘরে থাকত বিরাট এক্সজস্ট ফ্যান। যার আওয়াজে বাইরের কোনও শব্দ শোনা যেত না। একজন মানুষকে উন্মাদ করে দেওয়ার জন্য সব রকম আয়োজনই ছিল এই জেল খানায়।