সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: রঙের প্রলেপে সেজে উঠেছে ঠাকুরদালান। জ্বলজ্বল করছে জয়পুর রাজ এস্টেট-র লোগো।রাজকর্মচারীরাও নানা কাজে ব্যস্ত। যে বন্দুক থেকে গুলি ছুড়ে সন্ধি পুজোর সূচনা হয় সেই নলও পরিষ্কার করার কাজ চলছে। ঝাড়পোচ চলছে ছোট্ট কামানের। মন্ডা, মিঠাই-সহ নানা মিষ্টান্নর পাক চলছে রাজ হেঁশেলে। কিন্তু রাজবাড়িজুড়ে কেমন যেন বিষন্নতা। পুরুলিয়ার জয়পুরের রাজপরিবারের ঠাকুরদালানে যে মা আসছেন না। এ যেন মায়ের বন্দিদশা। পুজোর পাঁচটা দিনেও সোনায় মোড়া মা লকার বন্দি থাকছেন। এই প্রথম ওই রাজপরিবারের ইতিহাসে কালাশৌচ চলায় কুল পুরোহিতের বিধানে কনকদুর্গা ব্যাঙ্কের লকারবন্দি থাকছেন। রাজ পরিবারের সদস্যরা মাকে স্পর্শ করতে পারবেন না বলেই পুরোহিতের এমন কঠিন সিদ্ধান্ত।
আসলে গত বছর পুজোর সময় রাজবাড়িতে ঘটে যায় অঘটন। মহাঅষ্টমীর আঁখ বলিতে বিঘ্ন ঘটে। তরোয়ালের এক কোপে বলি হয়নি। ওই দিন রাতেই আবার অখণ্ড ‘জাগর’ প্রদীপও নিভে যায়। তখনই পুরোহিত সকলের সামনে রাজপরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, পরিবারে কোন বিপদ নেমে আসতে পারে। এমনকি পুরোহিত নিজেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তার পরিবারের ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে। পুজো শেষের প্রায় ১৫ দিনের মাথায় মারা যান এই রাজপরিবারের সেজো ভাই শংকরনারায়ণ সিং দেও। এই প্রয়াণের সাড়ে পাঁচ মাসের মধ্যে এই রাজপরিবারের মেজ ছেলে প্রণবকুমার সিং দেও মারা যান। এমনকি পুরোহিতের স্ত্রীও শয্যাশায়ী।
[আরও পড়ুন: চতুর্থীর রাতেও দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্য হাবড়ায়! টাকার ব্যাগ ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় ব্যবসায়ীকে গুলি]
বর্তমানে এই রাজপরিবারের বরিষ্ঠ সদস্য প্রশান্তনারায়ণ সিং দেও বলেন, “পরিবারে যে বিপদ আসছে তা মহাঅষ্টমীতে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মা। মহাঅষ্টমীর আঁখ বলিতে যেমন বিঘ্ন ঘটে। তেমনই ওই দিন রাতে অখণ্ড ‘জাগর’ প্রদীপ নিভে যায়। পুজো শেষের প্রায় ছয় মাসের মধ্যে আমার দুই ভাইয়ের প্রয়াণ হওয়ায় এই প্রথম আমাদের পরিবারে কালাশৌচ চলছে। আর সেই কারণেই মাকে স্পর্শ করতে পারব না বলেই কনকদুর্গা এই ঠাকুরদালানে আসছেন না।”
তবে সমস্ত নিয়ম মেনে পুজো হবে। আর সেই পুজোয় শামিল থাকবেন পুরোহিত সহ রাজকর্মচারীরা। ঠাকুরদালানে পা না রেখে বাইরে থেকে দেখতে হবে রাজপরিবারের সদস্যদের। এটা যে কতটা বেদনার রাজবাড়ির বারান্দায় বসে এই কথা বলতে গিয়ে চোখের কোনায় জল চলে আসে প্রশান্তনারায়ণের। আগাছায় ভর্তি ভাঙাচোরা রাজবাড়ি। আর সেই ঝলকানি নেই এই রাজবাড়ির পাথরমহলেরও। কিন্তু পুজো এলেই যেন একেবারে রাজকীয় পোশাকে সেই রাজা-রাজা ভাব টা দেখা যায় এই রাজপরিবারের সদস্যদের। কিন্ত এবার সেই চেনা ছবিটা উধাও। মহাষষ্টিতে পুলিশ এস্ককর্টে যে জয়পুর রাজবাড়িতে পা রাখবে না দ্বিভুজা মহামায়া। যা বেনারসের কনকদুর্গার আদলে তৈরি। সেখানকার পুরোহিতদের নির্দেশ মেনে মহাঅষ্টমীতে আঁখ, শশা, চালকুমড়োর সঙ্গে শিঙি মাছও বলি হয়।
এই কনকদুর্গা গড়তে রাজকোষ থেকে দেওয়া হয় ১০৮টি আকবরি স্বর্ণমুদ্রা। সেই সঙ্গে বেনারসের মনিমুক্তো, হিরে- জহরত দিয়ে তৈরি এই মহামায়ার মূর্তি। যার উচ্চতা দুফুট। সাড়ে ১১ গ্রামের ওই স্বর্ণমুদ্রা মিলিয়ে ওজন প্রায় দেড় কেজি। সেই সঙ্গে দেড় মণ (৬০ কেজি ) রুপোয় তৈরি মায়ের চালচিত্র। বর্তমান সময়ে ভারতীয় মুদ্রায় যার দাম কোটি টাকার বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়েক হাজার ডলার। তাই সোনায় মোড়া মাকে দেখতে মহাষষ্ঠী থেকে ঢল নামত এই রাজবাড়িতে। মা ছাড়া এবার হয়তো আর সেই ছবিটা দেখা যাবে না।
ইতিহাস বলছে, ১৬৭০ সাল থেকে তরবারিকে সামনে রেখে শক্তির প্রতীক হিসাবে এখানে মা দুর্গার আরাধনা শুরু হয়েছিল। পরে এই রাজপরিবারের সপ্তম রাজা মদনমোহন সিংহ তরবারির সঙ্গে মাটির প্রতিমা তৈরি করে পুজো শুরু করেন। এই সময়ও পুজোর সময় ঘটেছিল অঘটন। ঠাকুরদালানে জ্বলতে থাকা অখন্ড ‘জাগর’ প্রদীপ উল্টে ঘটে অগ্নিকাণ্ড। পুড়ে যায় মায়ের মাটির মূর্তি। ক্ষতিগ্রস্ত হয় মন্দিরও।
তখন এই রাজপরিবারের অমঙ্গলের কথা চিন্তা করে মায়ের কাছে ধরনায় পড়েন রাজা। সেই সময় মায়ের স্বপ্নাদেশে বেনারস থেকে স্বর্ণকারদের এই রাজবাড়িতে নিয়ে এসে তৈরি হয় এই সোনার দুর্গা। এরপর ১৮৬৭ সাল থেকে স্বর্ণময়ীর পুজো করে আসছে এই রাজপরিবার। এই স্বর্ণময়ী মা ৩৬০ দিন ব্যাঙ্কের লকারবন্দি থাকলেও পাঁচটা দিন জয়পুর স্টেটের ঠাকুরদালানে থাকতেন। কিন্তু ওই ঠাকুরদালানে মা ছাড়াই পুজো হবে। তাই শুধু ওই রাজপরিবার নয়। পুজোর আনন্দ ম্লান জয়পুরেও।
দেখুন ভিডিও: