সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: হাতিতে চেপে রাজা আর রাজরাজেশ্বরী ঠাকুরদালানে আসেন না। তাই রাজকীয় সেই জাঁকজমক নেই। রাজতন্ত্রের অবসান ঘটেছে বহু আগেই। তবুও সেই আগের মতোই পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজপরিবারের রাজরাজেশ্বরী আলয়ে আগমনী গানে মা উমা আসেন। ষোলোকল্পের পুজোয় প্রায় ১৬ দিন ধরেই আগমনি গানে গমগম করে ওই ঠাকুরদালান।
কোষাগারে যতই টান পড়ুক না কেন! কিংবা পঞ্চকোটের উচ্চাঙ্গ মার্গ সংগীত ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে এলেও সেই মূল ধারা থেকে এখনও সরে আসেনি। রাজদরবারের সংগীত সৃজন আজও অটুট। তাই তো পঞ্চকোটের ঠাকুরদালান থেকে ভেসে আসছে, “জয় দুর্গে দুরধী গম্য রূপিণী/ দুরন্ত দুর্গা শুর নিশুদিনী/ দীন দুর্বল তারিনী জননী দূরিত হারিণী।” কিংবা “এসো মা গো কাত্যায়নী/ নিখিল ভয়হারিনী অসুরদলনাশিনী/ তোমা বিনে ত্রিভুবনে, কে তারে তাপিত জনে/ স্থান দিও ওই চরণে, ত্রাণ কর ত্রিনয়নী।” দরবারি রাগের ঝাপতালে পাখোয়াজ, তবলা, হারমোনিয়ামের বোলে যেন অতীতের সংগীতকেই ফিরে ফিরে পাচ্ছে তামাম পঞ্চকোট।
[আরও পড়ুন: ৩৫০ বছর আগে মহানন্দা নদীতে উদ্ধার চণ্ডীর মূর্তি, মালদহে বিখ্যাত এই প্রাচীন পুজো]
মহালয়ার ৫ দিন আগেই এখানে পুজো শুরু হয়েছে। আর্দ্রা নক্ষত্রযুক্ত কৃষ্ণপক্ষের নবমীতে। শকাব্দ ২-র দুবছরেরও বেশি সময়ের প্রাচীন এই পুজোয় (Durga Puja 2023) দরবারি সংগীতের মূর্ছনায় যেন আলোর বিচ্ছুরণ! যেন কেঁপে উঠত রাজপ্রাসাদের ঝাড়লন্ঠন। সুমধুর আগমনী সংগীতে রাজদরবারেই রাজার উপস্থিতিতে গানে সুর দিতেন রাজেন্দ্রনারায়ণ সিং দেওর মতো সুরকাররা। কবি তথা রাজপুরোহিত রাখাল চক্রবর্তী, কবি ধ্রুবেশ্বরলাল প্রসাদ সিং দেও এই আগমনি গানগুলির রচয়িতা।
পঞ্চকোট রাজপরিবারের বর্তমান সদস্য তথা সিপাহী বিদ্রোহের মূল উদ্যোক্তা মহারাজাধিরাজ নীলমনি সিং দেওর প্রপৌত্র সৌমেশ্বরলাল সিং দেও বলেন, “শেষ রাজা ভুবনেশ্বরী প্রসাদ সিং দেওর আমলেও কাশীপুর রাজপ্রাসাদে সারা বছরের সঙ্গে আশ্বিন মাসের শুরু থেকেই আগমনীর পূর্ণাঙ্গ আসর বসত। দরবারি গানে সংগীতের মূর্ছনায় সমগ্র প্যালেসের চেহারা যেন একটা আলাদা রূপ নিত। এখনও ওই আগমনি গান শুনলে কানে যেন সেই সংগীতের সুরই বাজে। এখনও সেই মার্গ সংগীতের স্মৃতি চোখের সামনে ভাসে।”
আসলে পঞ্চকোট রাজপরিবারের সংগীতের একটা আলাদা ঘরানা রয়েছে। সেই সময় ভাদু বিসর্জনের পরেই পয়লা আশ্বিন থেকে দুর্গার আগমনি গান শুরু হতো এই রাজদরবারে। এই রাজদরবারে পা রেখেছিলেন যদুভট্টের মতো সংগীতবোদ্ধা। তাছাড়া ফি বছর দুর্গাপুজোর আগমনি গানে সুর মেলাতে বেনারস থেকে আসতেন গহরজান, জানকীবাই, মালকার মতো সংগীতজ্ঞরা। ঝাড়খণ্ড থেকে আসতেন কমলা ঝরিয়াও। আজ সেই সংগীতজ্ঞরা নেই। কিন্তু আগমনীর রেওয়াজ চলছেই সঞ্জয় সূত্রধর, সুশীল কুমার শাহ, ভুবন বাউরি, মানিক বাউরি, সুনীল বাউরিদের তত্ত্বাবধানে। তাঁরা সকলেই ষাটোর্ধ্ব।
তাঁদের কথায়, “আক্ষেপ একটাই। আমাদের পরবর্তী সময়ে এই আগমনী গান বন্ধ হয়ে যাবে না তো? আমাদের পরের প্রজন্ম যে এই গানের কোন চর্চাই করে না।” এই শিল্পীদের পূর্বপুরুষরা কোন না কোন ভাবে এই রাজ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সূত্রেই রাজদরবারের ওই সঙ্গীত ঘরানায় আচ্ছন্ন। তাই দুর্গাসংগীতে মাকে আহ্বান করছেন রাজরাজেশ্বরী ঠাকুরদালানে। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন পঞ্চকোটের প্রজারা সেই ঘরানাকে আজও আঁকড়ে রেখেছেন। তেওড়া তালে বাগেশ্রী রাগে দেবীর আহ্বান “আজকে পেলাম তোমায় উমা/ মনের মাঝে রাখতে চাই/ আঁধার ভবন করলে আলো/ এবার না মা বলবে যায়।” দুর্গা সংগীতে আজও রাত জাগে পঞ্চকোট।
দেখুন ভিডিও: