গৌতম ব্রহ্ম: নিঃশব্দে, যন্ত্রণাহীন অবস্থায় প্রাণ কেড়ে নেওয়ার জন্য কুখ্যাত গ্রাম বাংলার কালাচ (Kalach) সাপ। এর দংশনে রোগীর শরীরে কোনও উপসর্গ প্রথমে দেখাই যায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘শিবনেত্র’ হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে রোগী। জড়িয়ে যায় কথা। তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মৃত্যু নিশ্চিত। তাই কালাচ দ্রস্ট রোগীকে সময়মতো চিকিৎসা না করলে মৃত্যু অবধারিত। এত জটিল উপসর্গ ধরে ফেলা যেখানে চিকিৎসকদের পক্ষেই কঠিন হয়ে ওঠে, সেখানে একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী (Group D staff) অব্যর্থভাবে, নিখুঁত সময়ে তা চিহ্নিত করে মৃত্যুর হাত থেকে বয়স্ক মহিলার প্রাণ বাঁচালেন! তৈরি করলেন নজির। হ্যাঁ, এমনই অসাধ্যসাধন করে ফেলেছেন পূর্ব মেদিনীপুরের (East Midnapore) দক্ষিণ দামোদর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের গ্রুপ ডি কর্মী পরেশ ভঞ্জ। তাঁর এই অসামান্য কৃতিত্বে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত বাংলার চিকিৎসকমহল। দীর্ঘদিন কাজের পর অবসরের দোরগোড়ায় এসে পরেশবাবুও বোধহয় সম্যক উপলব্ধি করতে পারছেন না যে তিনি আসলে কতটা আশার আলো হয়ে উঠলেন অন্যদের কাছে।
ঘটনা দিন তিনেক আগের। পূর্ব মেদিনীপুরের দক্ষিণ দামোদর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বছর পঁয়ষট্টির মাকে নিয়ে হাজির হন দুই ছেলে। সেসময় কর্তব্যরত চিকিৎসক ছিলেন ডা অনুপম জানা। তাঁকে ছেলেরা জানায়, মায়ের ডান পায়ে কালো রঙের একটা সাপ কামড়েছে। অথচ মহিলার কোনও শরীরে কোনও উপসর্গ নেই। কামড়ের কোনও দাগ নেই। তিনি দিব্যি সুস্থ। মেদিনীপুরে বিষাক্ত চন্দ্রবোড়ার দাপট বেশি। তাই চিকিৎসক মহিলার 20WBCT করান। এটি একটি রক্তের পরীক্ষা। যার ফলাফল দেখে বোঝা যায়, চন্দ্রবোড়ার দংশনে রোগী বিদ্ধ কি না। যদি রোগীর রক্ত জমাট না বাঁধে, তবে বুঝতে হবে ভিলেন চন্দ্রবোড়া। আর তা না হলে, চন্দ্রবোড়া কামড়ায়নি, সে বিষয়ে নিঃসন্দিহান হওয়া যাবে। এখন এই ৬৫ বছরের বৃদ্ধার WBCT রিপোর্ট অনুযায়ী, রক্ত জমাট বেঁধেছে। অর্থাৎ তিনি চন্দ্রবোড়ার কামড় খাননি। এরপর চিকিৎসক অনুপম জানা জানিয়ে দেন, রোগী সুস্থই আছেন। তবে কিছুক্ষন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। কিন্তু মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে চান দুই ছেলে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নার্স প্রায় জোর করেই তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখেন। ইতিমধ্যে অনুপমবাবু দুপুরের বিরতিতে কোয়ার্টারে চলে যান। বিকেল ৫টায় ফের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে ওই বৃদ্ধাকে দেখার কথা বলেন। তিনি বাড়ি ফেরার ঘণ্টা খানেক পর আচমকাই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী পরেশ ভঞ্জ তাঁর কোয়ার্টারে দৌড়ে যান। জানান, ওই মহিলাকে কালাচেই কামড়েছে। তিনি ‘শিবনেত্র’ হয়েছেন। কালাচ দংশনের সমস্ত উপসর্গ প্রকট হচ্ছে।
[আরও পডুন: খড়গপুরে জাতীয় সড়কের পাশের হোটেলে মধুচক্রের পর্দাফাঁস, গ্রেপ্তার এক মহিলা-সহ ৭]
এটা শুনে এক মুহূর্তও দেরি করেননি অনুপমবাবু। প্রায় দৌড়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান। বোঝেন পরেশবাবুর ডায়াগনোসিস অব্যর্থ। কালাচেই দংশন করেছে রোগীকে। দেরি করেননি ডাক্তারবাবু । মহিলাকে পর পর ১০টি অ্যান্টিভেনাম (AVS) ইঞ্জেকশন দিয়ে দেন। এর কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন ৬৫ বছরের বৃদ্ধা। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে শুক্রবার তিনি বাড়ি ফিরেছেন। তবে তাঁর এভাবে বেঁচে ফেরার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব কিন্তু ওই চতুর্থ শ্রেণির কর্মী পরেশ ভঞ্জকেই দিয়েছেন ডাক্তারবাবু। তিনিই সময়মতো রোগীকে দেখে উপসর্গ বুঝেছিলেন। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে Clinical Diagnosys। বিষয়টি নিয়ে উচ্ছ্বসিত দক্ষিণ দামোদর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সকলেই। অষ্টম মান যোগ্যতার চাকরি। কাজের প্রয়োজনেই তিনি ডাক্তারবাবুদের থেকে শিখে নিয়েছেন রোগীদের উপসর্গ বুঝে নেওয়ার কৌশল। তবে কালাচের কামড়ের মতো কঠিন উপসর্গ নির্ণয় করা যেখানে চিকিৎসকদের পক্ষেই কঠিন, সেখানে পরেশবাবুর অভ্রান্ত Clinical Diagnosys তাঁদের অবাক করেছে। সাপে কাটা রোগীর প্রশিক্ষক ডাক্তার দয়ালবন্ধু মজুমদার বলছেন, ”কালাচ বড় রহস্যময় সাপ, অত্যন্ত বিষাক্ত। এই সাপে কামড়ালে উপসর্গ নির্ণয় করা একদম সহজ না। শিবনেত্র হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে AVS না দিলে রোগীকে বাঁচানো মুশকিল। তবে এই গ্রুপ ডি স্টাফ উপসর্গ চিনতে পেরেছেন বলেই মহিলা প্রাণে বেঁচেছেন।”
[আরও পডুন: COVID-19: বঙ্গে নিম্নমুখী দৈনিক করোনা সংক্রমণ, একদিনে মৃত্যু দশেরও কম]
কিন্তু কালাচ নিয়ে চিকিৎসকদেরও এত ভ্রান্তি কেন? ডাক্তারি মহলে কান পাতলে শোনা যায়, মেডিক্যাল অর্থাৎ MBBS-এর সিলেবাসে সাপে কাটা চিকিৎসা নিয়ে খুব অস্পষ্ট কিছু ধারণা দেওয়া আছে। বাস্তবের চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে তা একেবারেই যথাযথ নয়। তাই MBBS ডাক্তাররা এই চিকিৎসার ক্ষেত্রে খানিক হোঁচট খান। কিন্তু গ্রামবাংলায় সাপের কামড় এবং তার চিকিৎসা অতি প্রয়োজনীয়। তাই প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির সমস্ত কর্মীকে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পূর্ব মেদিনীপুরের দক্ষিণ দামোদর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সকলকে এই প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন ডাক্তার অনুপম জানা। তবে এত সফলভাবে তার প্রয়োগ করবেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী পরেশ ভঞ্জ, তা বোধহয় ভাবেননি কেউই। সেদিক থেকে বাংলায় সর্পদংশনের চিকিৎসায় নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখলেন ষাট বছররে পরেশ ভঞ্জ। তাঁর কাজ অন্যদের কাছে শিক্ষণীয় হয়ে উঠল।