সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: কারও বাড়ি তৈরির ঋণ, আবার কারও ব্যক্তিগত ঋণ বা পার্সোনাল লোনের বোঝা। সুপ্রিম রায়ে পুরুলিয়ায় ৪৫০-র বেশি শিক্ষক-শিক্ষিকা চাকরিহারা। তাঁদের মধ্যে যারা ব্যাঙ্কের ঋণ নিয়ে বাড়ি তৈরি করেছেন বা জমি কিনেছেন কিংবা কোন ব্যক্তিগত কাজে পার্সোনাল লোন নিয়েছেন, তাঁরা এখন চরম বিপাকে। চলতি মাসে বেতন হয়ে যাওয়ায় ইএমআই-র হয়তো অসুবিধে হবে না। কিন্তু পরের মাস থেকে কীভাবে তারা ঋণের কিস্তি দেবেন তা বুঝতে পারছেন না।
জয়পুরের মণিপুর হাই স্কুলের এসএসসি-র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নবম-দশম শ্রেণির ইংরাজির শিক্ষক জগন্নাথ রায় বছর খানেক আগে বাড়ি তৈরির জন্য ২০ লক্ষ টাকা লোন নিয়েছিলেন। ফি মাসে এখন তাকে ১৭ হাজার ২৯৩ টাকা কিস্তি টানতে হয়। তাছাড়া এখনও সম্পূর্ণভাবে বাড়ি তৈরি হয়নি তাঁর। পুরুলিয়া শহরের বাসিন্দা ওই শিক্ষকের কথায়,"বাড়ি এখনও সম্পূর্ণ করতে পারিনি। প্রায় ২০ লাখ টাকা লোন নিয়েছিলাম। প্রতি মাসে এখন ১৭ হাজারের বেশি ইএমআই দিতে হয়। এরপর থেকে কীভাবে দেব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। " ওই স্কুলেরই নবম-দশম উপযুক্ত যোগ্যতা সম্পন্ন অংকের শিক্ষক সুব্রত মাহাতো। তিনি ১৭ লক্ষ টাকার ঋণ নিয়ে বাড়ি তৈরি করেছেন। ফি মাসে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার টাকা ইএমআই দিতে হয় তাঁকেও। প্রতি মাসের ২৯ তারিখ সেই টাকা কাটে। তার বেতন প্রায় ৪৮ হাজার টাকা। মানবাজার থানার ভালুবাসা গ্রাম পঞ্চায়েতের মাকড়কেন্দির শিক্ষক কীভাবে ওই লোনের টাকা পরিশোধ করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। তাঁর কথায়,"চাকরিহারা হয়ে অথৈ জলে পড়ে গেলাম। বাড়ি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাড়ির ঋণ কীভাবে শোধ করব বুঝে উঠতে পারছি না। "
এরকমই আরেক শিক্ষক বাংলার চেলিয়ামা বিজলিপ্রভা হাই স্কুলের এসএসসি-র নবম-দশম উত্তীর্ণ পাড়ার উদয়পুরের চিতড়ার বাসিন্দা বিজয় মাহাতো। তাঁর কথায়, "পারচেজ কাম হোম এই বিভাগে আমি ১৩ লাখ টাকা লোন নিয়েছিলাম। পুরুলিয়া শহরের সাহেব বাঁধের পাশে সাউথলেক রোডে জমি কিনেছি। এখনও বাড়ি শুরু করিনি। ৪৯ হাজার টাকা মত বেতন পাই। ১২ হাজার টাকা করে ইএমআই দিতে হয়। মাস পয়লাতেই এই টাকা কাটে। আগামী মাস থেকে কীভাবে দেব, কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারছি না।" পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য পুরুলিয়া ২ নম্বর ব্লকের ছররা হাই স্কুলের শিক্ষক সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। রঘুনাথপুরের বাসিন্দা রসায়ন বিভাগে উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণির ওই শিক্ষক ২১ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন বাড়ি তৈরির জন্য। রঘুনাথপুরে সেই বাড়ি তৈরি করেছেন। ফি মাসে ৩০ তারিখ ইএমআই কাটে। মাসিক কিস্তির ১৮ হাজার কীভাবে মেটাবেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না।
তার কথায়, "গোটা পরিবার আমার উপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে ইএমআই কীভাবে দেব, বুঝতে পারছি না" পাড়ার ভাগাবাঁধ হাই স্কুলের শিক্ষক, এসএসসি নবম-দশম উত্তীর্ণ পুরুলিয়ার সাউথ লেক রোডের বাসিন্দা রমেশচন্দ্র মাহাতো ইতিহাসের শিক্ষক। তিনি ও তাঁর স্ত্রীর যৌথ অ্যাকাউন্ট থেকে মোট ৬৪ লক্ষ টাকা ধার নিয়েছিলেন তিনতলা বাড়ির জন্য। সেই বাড়ি এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। ওই বাড়ির দরজা-জানলা এখনও বাকি। তিনি প্রথম তলায় থাকেন। বাড়ির ঋণের জন্য তাঁকে প্রতি মাসে ইএমআই দিতে হয় ৫২ হাজার টাকা। তিনি নিজে বেতন পান ৪৮ হাজার। স্ত্রী ঝাড়খণ্ডে প্রাথমিক শিক্ষক। তাঁর বেতন এক লক্ষ টাকা। ওই শিক্ষকের কথায়, "স্ত্রী অনেক টাকা বেতন পান ঠিকই। তবে লোনটা আমার অ্যাকাউন্ট থেকে কাটে। চাকরিটা চলে যাওয়ায় ৫২ হাজার টাকা কীভাবে মেকআপ করব বুঝে উঠতে পারছি না।"
একইভাবে পার্সোনাল লোন নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন বাঁকুড়ার ইন্দপুর থানার কেলিয়াপাথর গ্রামের বাসিন্দা, পুরুলিয়া এক নম্বর ব্লকের গাড়াফুসড় হাইস্কুলের শিক্ষক শুভাশিস পান। তিনি গত দু'মাস আগে তিন লক্ষ টাকা ঋণ নেন। পরিবারের একমাত্র রোজগের সদস্য তিনি। বাবা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। স্ত্রী,সন্তানকে নিয়ে সংসার। প্রতি মাসে সাত হাজার টাকা ইএমআই নিয়ে ভাবতে হচ্ছে তাঁকে। ওই শিক্ষক বলেন, "প্রতি মাসে এবার থেকে ইএমআইটা কীভাবে দেব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।"