বিপ্লবচন্দ্র দত্ত, কৃষ্ণনগর: ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’ – দেবী অন্নপূর্ণার কাছে আসলে ঈশ্বরী পাটনী আমবাঙালির মনের ইচ্ছেই প্রকাশ করেছিলেন, চেয়ে নিয়েছিলেন আশীর্বাদ। কিন্তু বাস্তবে দুধেভাতে থাকা আর হচ্ছে কই? লকডাউনের কারণে পরিবারে রোজগার বন্ধ। সরকারের দেওয়া রেশনের চাল, আটায় বড়দের মুখে দু’বেলা অন্ন জুটলেও, কোলের শিশুর খিদে মিটছে না। তার তো দুধ চাই।
রাজ্য সরকার যদিও দ্বিতীয় দফা লকডাউনের আগেই দুধ সরবরাহে ছাড় দিয়েছিল। কিন্তু তবু লকডাউনের সময়ে সকলের কাছে তা ঠিকমতো পৌঁছয়নি। আর তাই চরম সমস্যায় পড়েছেন নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া নোনাগঞ্জ গ্রামের আদিবাসী পরিবারগুলি। এখানকার ৯২ টি আদিবাসী পরিবারের লোকজনের কাজকর্ম বন্ধ। তাঁরা জানিয়েছেন, ”কাজকর্ম বন্ধ হয়ে থাকায় আমরা চরম অসুবিধার মধ্যে পড়েছি l কোলের সন্তানদের জন্য দুধ জোগাড় করতে পারছি না। কাজ নেই, হাতে টাকাও নেই l তাই সন্তানদের দুধের ব্যবস্থা করতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে শিশুদের জন্য দুধের ব্যবস্থা করা হয়নি, আমরা বাধ্য হয়েই শিশুদের দুধের বদলে ভাতের ফ্যান খাওয়াচ্ছিলামl কী করবো? কীভাবে জোগাড় করবো দুধ?” করোনা সংক্রমণ রুখতে লকডাউন যে দেশবাসীর একাংশকে কত তীব্র কষ্টের মধ্যে ফেলেছে, নোনাগঞ্জের আদিবাসী পরিবারের এই বক্তব্যই বোধহয় তার বড় প্রমাণ। পরিবারের অন্যদের অন্নসংস্থান হলেও, টাকার অভাবে কোলের সন্তানদের মুখে দুধ তুলে দিতে পারছিলেন না। তার বদলে দিচ্ছিলেন ভাতের ফ্যান। শিশুদের মধ্যে পুষ্টির অভাব দেখা দিয়েছিল।
[আরও পড়ুন: ১১ বছর আগে ‘পরিববর্তন’-এর জন্ম দিয়েছিলেন, এবার প্রসূতির কোলে এল ‘করোনা’]
এই খবরটি কানে পৌঁছনোমাত্রই সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হন কৃষ্ণগঞ্জ থানার ওসি রাজশেখর পাল। তাঁর থানা এলাকায় দুস্থ – দরিদ্র মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। মানুষের দুর্দশায় তিনি এর আগেও পাশে দাঁড়িয়েছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। সহকর্মীদের কাছে তিনি আক্ষেপ করেন, যা ঘটছে, তা অত্যন্ত অমানবিক। শিশুদের মুখে দুধ তুলে দেওয়ার সংকল্প করেন তিনি। লকডাউনের শুরু থেকেই পরিস্থিতি সামাল দিতে এখন বিভিন্ন কাজে ছুটে যেতে হচ্ছে পুলিশকে। রুখে দাঁড়াতে হচ্ছে বেআইনি বিভিন্ন কাজের বিরুদ্ধে ।সেইসঙ্গে করতে হচ্ছে সমাজকল্যাণের অনেক রকম কাজের দায়িত্বও পালন করতে হচ্ছে। তারই মধ্যে সহকর্মীদের ওসি রাজশেখর পাল বলেন, ”অমানবিক ওই বিষয়টি আমার কানে আসতেই আমি শিশুদের দুধ জোগাড় করার চেষ্টা শুরু করি।” শনিবার ভারত – বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী নোনাগঞ্জ গ্রামে বেবিফুড নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজশেখর পাল। এরপর ওই গ্রামের প্রতিটি পরিবারের শিশুদের জন্য পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দেন বেবি ফুড আর গ্রামের বয়স্ক মহিলাদের পুষ্টির জন্য তুলে দেন খাবার। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার ডেপুটি পুলিশ সুপার (সদর ) কৌশিক বসাক, সার্কেল ইনস্পেক্টর নীহাররঞ্জন রায়ও। এর জন্য অবশ্য পৃথক কৃতিত্ব নিতে রাজি নন ওসি রাজ শেখর পাল শুধু বলছেন, ”এসবই আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।”
[আরও পড়ুন: ডিজিটাল কার্ড ছাড়া মিলছে না রেশন, সমস্যায় কয়েক হাজার পরিবার]
গত কয়েকদিন ধরেই নিজের কোলের সন্তানের জন্য হয়নি দুধের জোগাড়, তাই সন্তানকে কোলে শুইয়ে ভাতের ফ্যান খাইয়েছিলেন গৃহবধূ লক্ষ্মী সর্দার l শনিবার গ্রামে এসে পুলিশের বড়বাবু তাঁর হাতে যখন তুলে দিয়েছিলেন সন্তানের জন্য বেবি ফুডের কৌটো, তখন চোখের কোনটা আনন্দে চিকচিক করছিল লক্ষ্মী সর্দারের। সন্তানকে কোলে জাপটে ধরেছিলেন তিনি। এর আগেও তিনি পুলিশ দেখেছিলেন। তবে কোনও পুলিশ যে কোলের সন্তানের জন্য দুধ এনে বাড়িতে দিয়ে যাবে, তা কোনদিন কল্পনাই করতে পারেননি লক্ষ্মী সর্দার। বাঁ হাতে কোলের বাচ্চাকে আঁকড়ে ধরে, ডান হাতে বেবি ফুডের কৌটো হাতে নিয়ে লক্ষ্মীর প্রতিক্রিয়া, ”পুলিশ এমন হয় নাকি? উনি নিশ্চয়ই ভগবান। আমার বাচ্চা দুধ খেতে পারছিল না। আমার বাচ্চার জন্য দুধ দিলেন। উনি তো ভগবান।” ওসি রাজশেখর পালের একটাই কথা, ”আমার এলাকার কোন শিশু দুধ পাবে না, তা হয় নাকি? অবশ্যই পাবে।”
The post দুধের বদলে সন্তানদের ভাতের ফ্যান! আদিবাসী শিশুদের বেবিফুড দিলেন পুলিশ আধিকারিক appeared first on Sangbad Pratidin.
