রাজ কুমার, আলিপুরদুয়ার: 'হরিপদ একজন সাদামাটা ছোটখাটো লোক/ আকাশ থেকে নেমে এল এক রাত্রে, বড়বড় বড়বড় গোলগোল চোখ...'! সেই নব্বই দশকে কাল্পনিক চরিত্র হরিপদ উঠে এসেছিল অঞ্জন দত্তর গানে। সেখানে কথায়-সুরে সাধাসিধে নির্বিবাদী হরিপদর গল্প শুনিয়েছিলেন অঞ্জন। বাস্তবেও আরেক সাদামাঠা, সরল হরিপদর সন্ধান মিলল আলিপুরদুয়ারে। যিনি ঋণমুক্ত হতে স্কুলে ভর্তির প্রায় ৪৩ বছর পর বকেয়া ৫ টাকা ফি পরিশোধ করতে চেয়েছেন। যা দেখে কার্যত কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা ভাটিবাড়ি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রসেনজিৎ দত্ত চৌধুরীর। সরকারি আইন মেনে সেই পাঁচ টাকা আর নিতে পারেননি ১৯৪৩ সালে পত্তন হওয়া জেলার অত্যন্ত নামকরা ভাটিবাড়ি হাই স্কুলের স্কুলের প্রধান শিক্ষক। কিন্তু শনিবারের সেই ঘটনা এখনও ভুলতে পারছেন না তিনি।
ওই প্রধান শিক্ষক বলেন, "আমার স্কুলে এখন পরীক্ষা চলছে। আমার কাছে খবর আসে একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। পঞ্চাশোর্ধ ওই ব্যক্তি আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমাকে তাঁর মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড দেখিয়ে বলেন ১৯৮২ সালে উনি পঞ্চম শ্রেণিতে আমাদের স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু স্কুল ফি পাঁচ টাকা তিনি দিতে পারেননি। সেই টাকাটা তিনি শোধ করতে এসেছেন। আমি তো হতবাক। আইন মোতাবেক ওনার কাছে বকেয়া আছে এমন কোনও হিসাব আমাদের স্কুলে নেই। ফলে ওনার টাকাটা আমি নিই কীভাবে? ওনার টাকা নিতে হলে আমাকে একটা রসিদ ওনাকে দিতে হবে। আমি কিসের ভিত্তিতে ওনাকে রসিদ দেব? বাধ্য হয়ে আমি ওনাকে ঋণ মুক্তির ঘোষণা করে টাকাটা না নিয়েই ফিরিয়ে দিয়েছি।"
জানা গিয়েছে, ভাটিবাড়ি কদমতলা এলাকার কৃষক হরিপদ করের জন্ম তারিখ ১৯৭১ সালের ২৩ আগষ্ট। তার বাবার নাম কমলেশচন্দ্র কর। ১৯৮২ সালে ভাটিবাড়ি হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৮৮ সালে এই বিদ্যালয় থেকে তিনি মাধ্যমিকও পাশ করেন। কিন্তু হটাৎ করে এতদিন পর এই সময়েই কেন তিনি বকেয়া স্কুল ফি দিতে স্কুলে হাজির হলেন? তাঁর স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন হরিপদ কর। তিনি বলেন, "৫০ পার করে ফেলেছি। এখন এই জীবনের সব ঋণ আস্তে আস্তে শোধ করতে হবে। যে স্কুল থেকে শিক্ষা নিয়েছি। জীবনে আজ যতটুকু সফল হয়েছি তা স্কুলের শিক্ষার জন্যই। সেসময় আর্থিক টানাটানি ছিল। স্কুল ফি দিতে পারি নি। এখনতো আমার ক্ষমতা আছে। তা স্কুলের সেই ঋণ শোধ করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তা আর শোধ করতে পারলাম কই। আসলে সেসময় স্কুল কর্তৃপক্ষ আমার বকেয়া টাকার কোনও হিসেব দেখাননি। সেই কারণে আমার ঋণ আর শোধ করতে পারলাম না।" ভাটিবাড়ি স্কুলের শিক্ষকরা আসলে গ্রামের সৎ হরিপদরা আজও বেঁচে আছেন। যারা চুরি জোচ্চরির দুনিয়ায় এখনও ৫ টাকা ঋণের দায় নিতে চান না। আর সেই হরিপদরা বেঁচে আছেন বলেই তো হরিপদদের নিয়ে গান হয়, সিনেমা। বেঁচে থাকে আমাদের সমাজ সভ্যতা। বলছিলেন ভাটিবাড়ির কদমতলার হরিপদরই এক প্রতিবেশী।
