বিপ্লবচন্দ্র দত্ত, কৃষ্ণনগর: হিন্দু, মুসলমান বা খ্রিস্টান নয়, মানবধর্মই সবচেয়ে বড়। নিজেদের একমাত্র সন্তানের জন্ম শংসাপত্র (Birth certificate) পাওয়ার জন্য নদিয়ার রানাঘাট (Ranaghat) পুর কর্তৃপক্ষের কাছে সন্তানের ধর্ম হিসাবে ‘হিউম্যানিজম’ বা ‘মানবধর্ম’-এর উল্লেখ করে আবেদন জানিয়েছিল দম্পতি। তা হাতে পেয়ে কিছুটা ধন্ধে পড়ে গিয়েছিল রানাঘাট পুরকর্তৃপক্ষ। কারণ, এর আগে রানাঘাট পুরসভা থেকে জন্ম শংসাপত্রের জন্য এমন আবেদনপত্র জমা পড়েনি। স্বভাবতই পুরকর্তৃপক্ষ কিছুটা আপত্তি তুলেছিল। বিষয়টি রানাঘাট মহকুমা প্রশাসনের দুয়ার পর্যন্ত গড়ায়। তবে অবশেষে ওই দম্পতির আবেদন জয় হয়। রানাঘাট মহকুমা প্রশাসন ‘মানবধর্ম’কেই স্বীকৃতি দিল।
‘মানবধর্ম’ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিশুর নাম সৃজিত মুখোপাধ্যায়। বাবা স্বরূপ মুখোপাধ্যায়, মা মৌমিতা মুখোপাধ্যায়। রানাঘাট-২ নম্বর ব্লকের আইশমালির পুরাতন পাড়ার বাসিন্দা তাঁরা। স্বরূপ মুখোপাধ্যায় আগাগোড়া বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। নিজেকে সমাজকর্মী বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। বর্তমানে সিপিএমের যুব সংগঠন DYFI রাজ্য কমিটির সদস্য স্বরূপবাবু। আগাগোড়া একটু ব্যতিক্রমী মানসিকতা তাঁর। নিজেদের জমিজমা, চাষাবাদে সংসার চলে যায়। হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ, জৈনর মতো প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী নন। স্বরূপবাবু মনে করেন, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ধর্মই সর্বোত্তম।
[আরও পড়ুন: অসুস্থ ছেলে, রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে ‘আত্মঘাতী’ মা]
নিজের এই মতাদর্শের সঙ্গে স্বরূপ মিল খুঁজে পেয়েছিলেন চাকদহের ক্ষুদিরামপল্লির বাসিন্দা মৌমিতার। ২০২০-এর ফেব্রুয়ারিতে তাঁর সঙ্গেই বিয়ের রেজিস্ট্রেশন সেরে ফেলেছিলেন। স্বরূপ বলেন, ”আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশনেও ‘মানবধর্ম’ই উল্লেখ করা হয়েছিল। এবং চাকদহের যে ভবনে আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল, সেটি সাজানো হয়েছিল NRC বিরোধী পোস্টারে। আমরা দু’জন আগাগোড়াই চেয়ে এসেছি, ধর্মের গণ্ডি টপকে গিয়ে মানুষের পাশে থাকার ধর্মকে নিয়েই বড় হয়ে উঠুক আমাদের সন্তান। শেষপর্যন্ত সেই মর্যাদা পাওয়ায় আমরা খুব খুশি।” রানাঘাটের এক বেসরকারি নার্সিংহোমে গত ৫ এপ্রিল মৌমিতা মুখোপাধ্যায়ের পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। নাম রাখা হয় সৃজিত মুখোপাধ্যায়। এরপর নিজেদের সন্তানের জন্ম শংসাপত্র পাওয়ার জন্য তাঁরা রানাঘাট পুর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন। সেই আবেদনপত্রে ধর্মের জায়গায় তাঁরা ‘হিউম্যানিজম’ (Humanism) অর্থাৎ ‘মানবধর্ম’ উল্লেখ করেন।
[আরও পড়ুন: মাদলের তালে নাচ মুখ্যমন্ত্রীর, বাজালেন ধামসাও, বিশ্ব আদিবাসী দিবসে ভিন্ন রূপে Mamata]
যদিও প্রচলিত রীতির বাইরে গিয়ে হিন্দু, মুসলিম বা খ্রিস্টানের বদলে ‘মানবধর্ম’-কে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি এত সহজ ছিল না। স্বরূপ জানিয়েছেন, ”আমাকে প্রশাসনের দ্বারস্থও হতে হয়েছিল। আমাদের সন্তানের ধর্মের জায়গায় যাতে ‘মানবধর্ম’ লেখা হয়, সেই বিষয়ে আমরা কাতরভাবে আবেদন করি। অবশ্য শেষপর্যন্ত আমাদের সেই আবেদনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।” ছেলের জন্ম শংসাপত্র হাতে পাওয়ার পর খুশি ওই দম্পতি।
এ বিষয়ে রানাঘাট পুরসভার মুখ্য পুরপ্রশাসক কোশলদেব বন্দোপাধ্যায় বলছেন, ”হ্যাঁ, ‘মানবধর্ম’ লেখা একটি জন্ম শংসাপত্র রানাঘাট পুরসভা থেকে দেওয়া হয়েছে। আবেদনপত্র জমা পড়ার পর রানাঘাটের মহকুমা শাসকের সঙ্গে কথা বলে তাঁর অনুমতি নিয়েই এই শংসাপত্র দেওয়া হয়েছে। ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে কেউ যদি ‘মানবধর্ম’ লিখতে চান, এর থেকে ভাল কিছু হতে পারে না। এটি ব্যতিক্রমী বিষয়। ভবিষ্যতেও কেউ যদি এই ধরনের আবেদন করেন, সেক্ষেত্রে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি চাইব। অনুমতি পেলে জন্ম শংসাপত্র দেওয়া হবে।”