গৌতম ব্রহ্ম: এবার মশার (Mosquito) বংশ ধ্বংস করতে আসছে এক ছত্রাক। মশাখেকো ছত্রাক। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ফাইরেলিয়া-রোগসৃষ্টিকারী সব মশার লার্ভাকেই সে নিকেশ করবে, সময় লাগবে মাত্র সাকুল্যে আধঘণ্টা, ডোজও নামমাত্র। এক চৌবাচ্চা লার্ভা ধ্বংস হবে মাত্র এক ফোঁটা ছত্রাকের সলিউশনেই। যুগান্তকারী এই আবিষ্কার করে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন রহড়ার রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ সেন্টেনারি কলেজের এক গবেষক-অধ্যাপক ড. স্বপন ঘোষ। গবেষণাপত্রটি বিশ্ববন্দিত নেচার পত্রিকার সায়েন্টিফিক রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি।
‘ম্যাজিক ফাঙ্গাস’-এর নাম ট্রাইকোডার্মা অ্যাসপেরেলাম। কৃষিকাজে কীটনাশক হিসাবে ব্যবহৃত ছত্রাকটি অন্য রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাক (Fungus) ও ব্যাকটেরিয়াকে দমন করতে বড় ভূমিকা নেয়। এই নিয়ে প্রায় বছর চারেক ধরে কাজ করছেন স্বপনবাবু ও তাঁর ছাত্ররা। তাঁরাই প্রথম দেখালেন, ছত্রাকটি যে কোনও মশার লার্ভা মারতেও সিদ্ধহস্ত। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধবও, কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা-সহ রাজ্যের বেশ কয়েকটি জায়গায় গবেষণা চালিয়ে ওঁদের পর্যবেক্ষণ, মশার লার্ভা জন্মানোর নির্দিষ্ট কিছু মাপকাঠি রয়েছে। কোন তাপমাত্রায়, কত পিএইচ মশার বীজতলা তৈরির জন্য আদর্শ, তা খুঁজে বারও করেছেন। তৈরি করা হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড মার্কার। তারপর একাধিক লার্ভার আঁতুড়ঘরে ট্রাইকোডার্মা অ্যাসপেরেলামের সলিউশন প্রয়োগ করে আশাতীত সাফল্য!
[আরও পড়ুন: Mars-এর জমি পরীক্ষায় Perseverance-এর নতুন যন্ত্র, এবার পৃথিবীতে পাঠানো হবে নমুনা]
এটা কী ভাবে কাজ করে? প্রথমে ছত্রাকের স্পোর বা রেণু লার্ভার গায়ে আটকে যায়। শিকারের গায়ে আটকানোর জন্য ছত্রাকটি এক ধরনের প্রোটিন তৈরি করে। স্বপনবাবু জানালেন, আটকে যাওয়া ছত্রাক অঙ্কুরিত হবে, গজিয়ে উঠবে একটি নল, যা থেকে বেরিয়ে আসবে কিছু রাসায়নিক এবং কাইটিনেজ-প্রোটিয়েজ নামে দু’টি উৎসচেক। এরাই লার্ভার সেল ওয়াল ভেঙে ভিতরে ঢুকে তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউনিটি সিস্টেমের বারোটা বাজিয়ে দেবে। তৈরি করবে মাইসিলিয়াম বা অনুসূত্র। এরাই হল লার্ভার মূল ঘাতক। স্বপনবাবুর পর্যবেক্ষণ, লার্ভা নিধনে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হল ছত্রাক নিঃসৃত সাত যৌগের সম্মিলিত রাসায়নিক (হেক্সাডেকানইক অ্যাসিড, পাইরেন, কুইনোলাইন প্রভৃতি)। যা মাত্র ৩০ মিনিটেই দুশমনকে খতম করে দেয়। সম্পূর্ণ ছত্রাক ব্যবহার করলে অবশ্য সময় বেশি লাগবে, দু’ থেকে তিনদিন। এক চৌবাচ্চা জলে এক ফোঁটা ছত্রাক রেণুর দ্রবণই যথেষ্ট।
স্বপনবাবুদের গবেষণা নিয়ে রীতিমতো আশাবাদী ভাইরোলজিস্ট ডা. সিদ্ধার্থ জোয়ারদার। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “ধাপে ধাপে প্রথমে মিউসিলেজ, পরে কাইটিনেজ ও প্রোটিয়েজ এবং শেষে টক্সিন নিঃসরণ করে ছত্রাকটি কীভাবে লার্ভাকে ধ্বংস করে, সেই প্রক্রিয়া জানতে পারা গেল। এতে মশার লার্ভা নিধন সংক্রান্ত বায়ো-কন্ট্রোল গবেষণা আরও উত্সাহ পাবে ও এগিয়ে যাবে। সেই নিরিখে এই ফলাফল যথেষ্ট তাৎপর্যপুর্ণ ও সুদূরপ্রসারী।” ঘটনা হল, গবেষণাকে ব্যবহারিক প্রয়োগের লক্ষ্যে স্বপনবাবুরা কলকাতা পুরসভাকে প্রস্তাব দিলেও এখনও গ্রাহ্য হয়নি। পুরসভার মুখ্য পতঙ্গবিদ ড. দেবাশিস বিশ্বাস জানিয়েছেন, মশা নিয়ন্ত্রণের কর্মসূচি ঠিক করে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনস্থ ডিরেক্টরেট অফ ন্যাশনাল ভেক্টর বোর্ন ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের টেকনিক্যাল অফিসাররা। এক্ষেত্রে স্থানীয় কোনও পুরসভার কিছু করণীয় নেই। কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিলেই মশা মারতে ছত্রাক দাগতে তৈরি পুরসভা।