সন্দীপ্তা ভঞ্জ: 'রেনেসাঁ' এবং অপর্ণা সেন, একে-অপরের সমার্থক বললেও অত্যুক্তি হয় না। বিশেষ করে বাংলার ক্ষেত্রে। একাধারে অভিনেত্রী, পরিচালক, প্রযোজক থেকে নারী অধিকারের জন্য লড়াই, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, বিগত ষাট বছরের সিনে কেরিয়ারে 'মিস ক্যালকাটা'র বিভিন্ন সত্ত্বা শুধুমাত্র আবিষ্কৃতই হয়নি, বরং আমজনতাকে মুগ্ধ করেছে। ব্যক্তি অপর্ণার বিবিধ রঙিন সত্ত্বা 'পরমা' তথ্যচিত্রে লিপিবদ্ধ করেছেন পরিচালক সুমন ঘোষ। ৩০তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের (Kolkata International Film Festival 2024) পয়লা দিনের অন্যতম চমক এই ডকুমেন্টারি।
সুমন শুরু করলেন একেবারে '৩৬ চৌরঙ্গী লেন' থেকে। যেখানে পরিচালকের আসনে অপর্ণা। ঠিক তার পরই প্রবেশ করলেন অভিনেত্রী অপর্ণা সত্ত্বার অন্দরে। যেখানে সত্যজিৎ রায়ের ফ্রেমে 'তিন কন্যা'য় এক ষোড়শীর দস্যিপানা। কীভাবে সমাজ, রাজনৈতিক দর্শন তাঁর কাজের মাধ্যমে প্রতিভাত হয়েছে, তাঁর লেন্সে ধরলেন পরিচালক। অপর্ণা সেনের ফ্রেমে কলকাতার যেসব লোকেশন দেখা গিয়েছে, 'রিনাদি'কে নিয়ে সেসব জায়গায় ঢুঁ মেরে সুখস্মৃতি রোমন্থন করলেন। তার অবসরেই পর্দায় কখনও ভেসে উঠলেন গৌতম ঘোষ আবার কখনও বা অঞ্জন দত্ত, শাবানা আজমি থেকে সোহাগ সেনরা। সুমন ঘোষের তথ্যচিত্রে তাঁরা উদযাপন করলেন 'ব্যক্তি অপর্ণা'কে। বিগত ছয় দশকের সিনে কেরিয়ারে তাঁর কাজ, ক্যাপ্টেনশিপ থেকে মা-সুলভ আচরণে কলাকুশলীদের আপন করে নেওয়া, সব মোড়কই ধীরে ধীরে উন্মোচিত হল তাঁদের কথায়।
শুধুই 'অভিনেত্রী' কিংবা 'পরিচালক' বিশেষণ তাঁর নামের পাশে বসালে অদৃষ্ট হয়তো ক্ষমা করবে না! মধ্যবিত্ত বাঙালির অন্দরমহল, ড্রয়িং রুম, হেঁশেল থেকে ওয়ার্ড্রোবেও বিস্তর প্রভাব ফেলে দিয়েছিলেন অপর্ণা সেন। 'দ্য ফ্যাশন আইকন'। সমসাময়িক 'পুরুষতান্ত্রিক' পেশায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে। সিনেমাকে হাতিয়ার করেই নারীঅধিকার আদায়ের জন্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, সিস্টেমকে বারবার প্রশ্ন ছুঁড়়েছেন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন নারীরাও রক্তমাংসের মানুষ। মুক্তির স্বাদ, দু দণ্ড খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়ার অধিকার তাঁদেরও রয়েছে। 'পরমা' হোক কিংবা 'পারমিতার একদিন'-এর চরিত্রদের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নারীরাই নারীদের জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। মধ্যবিত্ত ছাপোষা সংসার, প্রচলিত প্রথার মাঝে হারিয়ে যেও না, নিজের মতো করে বাঁচো, সিনেমা হোক বা তাঁর তত্ত্বাবধানে থাকা ম্যাগাজিন, সর্বক্ষেত্রেই মেয়েদের লড়াকু হওয়ার বার্তা দিয়েছেন। তৎকালীন সমাজে যা কিছু ট্যাবু ছিল, নিষিদ্ধ ছিল, যাবতীয় বিষয়কে ভেঙেচুরে নিজের মতো করে নারীবাদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন অপর্ণা সেন। নারীদের নাড়িস্পন্দন বুঝে নারীবাদকে ব্যাখ্যা করেছেন নিজের মতো করে। 'পরমা' তথ্যচিত্রের স্তরে স্তরে লিপিবদ্ধ করেছেন সুমন ঘোষ।
'পরমা'র স্ক্রিনিংয়ে পরিচালক সুমন ঘোষের সঙ্গে অপর্ণা সেন, ছবি- ব্রতীন কুণ্ডু
অপর্ণা সেন তাঁর সিনেমায় স্বাধীন ভারতের মেয়েদের নানাভাবে ভেঙেছেন গড়েছেন। যেমন '৩৬ চৌরঙ্গী লেন'-এর ভায়োলেট স্টোনহ্যাম বা নন্দিতা রায়, 'পরমা', 'পারমিতা' কিংবা 'মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার'-এর মীনাক্ষি আইয়ার, 'দ্য জাপানিজ ওয়াইফ'-এ সন্ধ্যা মিয়াগে, 'সোনাটা'-র তিন ব্যাচেলর মহিলার বন্ধুত্ব... প্রত্যেকটি নারীচরিত্রদের চোখ দিয়ে সমাজের কঙ্কালসার চেহারা তুলে ধরেছেন তিনি। কারণ ব্যক্তি অপর্ণা বারবার সোচ্চার হয়েছেন আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ইস্যুতে। ঠিক যেমন তাঁর ভাবনায় ম্যাগাজিনে কখনও ঠাঁই পেয়েছে গর্ভপাত কেন জরুরী বা পরকীয়া সম্পর্কিত নানা বিষয়। তেমনই নানা ট্যাবুকে কাঁটাছেড়া করা।
পরিবর্তনের জন্য যে কোনও রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ার প্রয়োজন হয় না, 'পরিবর্তনের পোস্টার গার্ল' সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বহু রাজনৈতিক পালাবদল চাক্ষুষ করেছেন। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনে প্রথম সারিতে থেকে প্রতিবাদ করা এবং তৃণমূল সরকার উত্থানের নেপথ্যে নাগরিক সমাজের অবদানও ডকুমেন্টেশন করেছেন সুমন ঘোষ। রাজনীতি সচেতন অভিনেত্রী-পরিচালক গেরুয়া শিবিরের 'উগ্র' মানসিকতার বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলেছেন তাঁর ছবিতে। সিনেমা হাতিয়ারের বাইরে গিয়েও অন্যায়ের বিরুদ্ধে মনুষ্যত্বের খাতির বারবার গর্জে উঠেছেন যে কোনও শাসকের বিরুদ্ধে। 'পরমা' তথ্যচিত্র সিনেপাড়ার আস্ত দলিল হয়ে থাকবে, তা বলাই যায়। সিনেমার মতো ডকুমেন্টারির কোনও রিভিউ মাপকাঠি হয় না। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, ব্যক্তি অপর্ণা বা মহীরুহ অপর্ণাকে 'পরমা' তথ্যচিত্রে সুমন ঘোষের তুলে ধরার প্রচেষ্টা সফল।