'কিলবিল সোসাইটি' মুক্তির আগে ছবির ভিতরঘরের কথা, চরিত্র নির্মাণের নেপথ্য কাহিনি নিয়ে আড্ডায় সৃজিত মুখোপাধ্যায়। শুনলেন বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
'আনন্দ কর'-এর বেঁচে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু সে তেরো বছর পর ‘মৃত্যুঞ্জয় কর’ হয়ে ফিরছে। ‘হেমলক’ থেকে ‘কিলবিল’। অন্যদিকে ‘বাইশে শ্রাবণ’ থেকে একদিকে ‘দ্বিতীয় পুরুষ ’, ‘ভিঞ্চিদা’, ‘দশম অবতার’। এই যে নিজের গল্প নিয়ে নানারকম গল্প তৈরি করা– এটা কেন করতে ইচ্ছে করে?
- আমার ভিতর থেকেই সমস্ত চরিত্রের জন্ম। এই সব চরিত্রের টাইমলাইনের ইউনিভার্স বা মেটাভার্স আমার মধ্যেই। আর সত্যি বলতে কী, আমার মজা লাগে। এরা সবাই আমার পরিচিত, কেউ কেউ আমার এক্সটেনশন, কেউ আবার কল্পনাপ্রসূত- তো তাদের নিজেদের মধ্যে কথোপকথন হলে কেমন হবে এটা দেখতে আমার ভালো লাগে। তবে ‘হেমলক সোসাইটি’ করার সময় ভেবে রেখেছিলাম যে সিক্যুয়েল করব। ‘দশম অবতার’ বা ‘দ্বিতীয় পুরুষ’ করার কোনও প্ল্যান আগে ছিল না।
‘চতুষ্কোণ’ নিয়ে কি সিক্যুয়েল হবে?
- আমার নিজের প্ল্যান নেই, কিন্তু লোকজন ‘চতুষ্কোণ’ নিয়ে খুব উৎসাহী। যদি চুল্লি কাজ না করে, মানে লোডশেডিং হয়ে যদি পরম মারা না যায়– কোনও মানে হয়! তবে ‘ভিঞ্চিদা’র সিক্যুয়েল হতে পারে। শেষ দৃশ্যে তেমন সংকেতও দেওয়া আছে।
‘আনন্দ কর’ প্রাণ বাঁচাত, এখন সে কনট্র্যাক্ট কিলার, প্রাণ নিচ্ছে। ‘প্রবীর রায়চৌধুরি’-ও দোষীদের শাস্তি দেওয়ার ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। আপনি চরিত্রদের একটা সুপ্রিম ক্ষমতা দিয়ে দেন, যেন ভগবানের পরেই তাঁরা! এটা কেন?
- আমি মনে করি, প্রতিটা সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা সুপারম্যান সত্তা বা অসাধারণ এলিমেন্ট আছে। ‘বেগমজান’ও কোথাও
গিয়ে সুপারউওম্যান হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প বা দেবতুল্য হয়ে ওঠা সেলিব্রেট করি। যেমন প্রবীর রায়চৌধুরি, বেগমজান, ভিঞ্চিদা, আনন্দ কর, গুমনামী-র চন্দ্রচূড়ের চরিত্রটা। এবং চারপাশে দেখি বলেই সেলিব্রেট করতে ইচ্ছে করে।
আপনারও এইরকম প্রায় ভগবান হয়ে ওঠার ইচ্ছে আছে? মানে একেবারে শীর্ষে পৌঁছে যাওয়ার ইচ্ছে!
- ডেফিনিটলি আছে, তবে টপে ওঠার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল চারপাশে এই যে দুঃখ, যন্ত্রণা সেটাকে প্রশমিত করার যদি একটা পাওয়ার থাকত ভালো হত।
নিজের জন্য কী চাইতেন?
- উমমম... ফ্যাটি লিভার যদি কমে যায় তাহলে বিনা গিল্টে খাওয়াদাওয়াটা করতে পারি।
সত্যিই এটা বোধহয় আমরা সবাই চাই!
-হ্যাঁ, নীরোগ শরীরের কোনও বিকল্প নেই!
সৃজিত মুখোপাধ্যায় (ছবি- কৌশিক দত্ত)
আপনার যে পুরুষ চরিত্ররা এরা সকলেই রেগে থাকে এবং সকলেই প্রায় ‘মিসপ্লেস্ড অ্যাঙ্গার’-এর শিকার। এবং বোঝা যায় এরা ইনসিকিওরিটিতে ভোগে বলেই শক্তিশালী হয়ে উঠতে চায়, রিভেঞ্জফুল হয়ে উঠতে চায়। আপনার মধ্যেও কি অ্যাঙ্গার ইস্যু আছে?
- হতাশা, রাগ বা কষ্টের জায়গা সকলের থাকে। আমারও আছে। হয়তো সেটাই কোনওভাবে ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আমার চরিত্রদের মধ্যে ঢুকে যায়। এটা নিয়ে আলাদা করে লেখার সময় ভাবি না। তবে হ্যাঁ, একটা প্যাটার্ন তো আছেই।
এই প্যাটার্ন ডিকোড করবেন কীভাবে?
- সিরিয়াল কিলার তো নিজেকে ডিকোড করে না। সেটা ক্রাইম সাইকোলজিস্টরা ডিকোড করে।
আপনার মধ্যে সিরিয়াল কিলার মনোভাব আছে নাকি?
- (হা হা হা হা)... এই ধরো, প্রতিটা অ্যালফাবেট দিয়ে ছবি বানাব ঠিক করেছি এটা তো নর্মাল ভাবনাচিন্তা নয় বরং সচেতনভাবে একটা প্যাটার্নকে আপন করেছি। আর এই আপন করে নেওয়ার মধ্যে হালকা সাইকোপ্যাথ টেনডেনসি রয়েছে। নর্মাল মানুষ এভাবে ভাবে না। আসলে আমার ছোটবেলা, বা আমার বড় হয়ে ওঠার মধ্যে যে যন্ত্রণা, বা না-পাওয়া রয়েছে সেটা প্রভাব ফেলেছে হয়তো। আমার যে চরিত্ররা–দে ডোন্ট কাম ফ্রম আ হ্যাপি ফ্যামিলি। তাদের ভাঙাচোরা মন, নড়বড়ে জীবন নিজেদের মতো করে সেলিব্রেট করে। তাদের কাছে ব্রোকেন ইজ বিউটিফুল। সেটা হয়তো আমার জীবন থেকেই। আই অ্যাম পারপেচুয়ালি ব্রোকেন।
এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন কেন?
- ১৫ বছর বয়সে আমার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল। এবং আমার দশ-এগারো বছর বয়স থেকে তাদের মধ্যে বিপুল ঝগড়া-ঝাঁটি দেখেছি। আই হ্যাড এ ভেরি ভায়োলেন্ট অ্যান্ড ডিসটার্বড চাইল্ডহুড। কথা কাটাকাটি, চিৎকার চেঁচামেচি, ভায়োলেন্ট দৃশ্য দেখে বড় হয়েছি। আমার পরিবারে বেশ কিছু ডিভোর্স দেখেছি, সেগুলোও হয়তো প্রভাব ফেলে।
আপনার নারীচরিত্রদেরও একটা প্যাটার্ন আছে। ‘শ্রীনন্দিতা’, ‘অমৃতা’, ‘মৈত্রেয়ী’ বা অন্যান্য চরিত্ররা- তারা ভালোবেসে পুরুষদের সহ্য করে, ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে, সবসময় রিসিভিং এন্ড-এ থাকে! এটা কেন?
- সেটার মধ্যে আমার মা অনেকটা চলে আসে বোধহয়। মা সবসময় ভারসাম্যটা বজায় রাখার চেষ্টা করত। সংসার সামলানো যাকে বলে। বাচ্চা মানুষ করা, চাকরি, ডাক্তার-বদ্যি- সব দিক দেখাশোনা মা-ই করত। আমার নারী চরিত্ররা সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত বোধহয়। তবে তারা কখনও-কখনও বিপ্লবীও। গোটা ‘রাজকাহিনী’র মেয়েরাই তো রেবেল।
আপনার জীবনে তেমন ভারসাম্য বজায় রেখেছে কোন নারী?
- মা ছাড়া তেমন গভীরভাবে কেউ নেই যে এতটাই প্রভাবিত করবে যে আমার চরিত্রের মধ্যে ঢুকে পড়বে।
আপনার ছবির যারা অপেক্ষাকৃত কম টক্সিক, কম ভেঙেচুরে থাকা, কম রাগী পুরুষ চরিত্র যেমন আবির অভিনীত ‘সূর্য সিনহা’- তারা বিশেষ পাত্তা পায় না কেন?
- উমমম.. সেটাও আমার চারপাশে দেখা। ‘সূর্য সিনহা’ তো আমার চোখে দেখা। আমি নিজে অনেক গল্পে ‘সূর্য সিনহা’ হয়ে গিয়েছি। আবার অনেক গল্পে ‘অভিজিৎ পাকড়াশি’। আসলে এই চরিত্রগুলো কোনও একজন মানুষকে ঘিরে নয়, এবং একটা চরিত্রে এই দুধরনের মানুষই থাকতে পারে। জীবনের কোন লগ্নে আমরা ‘অভিজিৎ পাকড়াশি’ আবার কোন লগ্নে ‘সূর্য সিনহা’ এটা আগে থেকে বলা যায় না। ইট অলসো ডিপেন্ডস যে ‘অমৃতা’টা কে (হাসি)! আর ‘সূর্য সিনহা'র স্ক্রিন টাইম কম হলেও তার ইমপ্যাক্ট এবং গ্লোরি এতটুকু কম নয়। ‘হেক্টর’ আর ‘একিলিস’-এর মধ্যে স্ক্রিন টাইম কমপেয়ার করলে তো হবে না। হেক্টরের হিরোইজম সবসময়ই হেক্টরসুলভ।
সৃজিত মুখোপাধ্যায় (ছবি- কৌশিক দত্ত)
পরপর চারটে ছবি হিট না করলে কী হবে, এই ভয়টা করে?
- না, করে না। আমার ছবির এতগুলো প্যারামিটার আছে, আমার ঘরে এতজন বসত করে, তাদের হিসাব মানুষ পেয়ে গিয়েছে। আমার এগজিবিটর ‘দশম অবতার’ আর ‘টেক্কা’ দিয়ে বিচার করে, আমার কোর অডিয়েন্স ‘পদাতিক’ এবং ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ দিয়ে বিচার করে। আমার ফিল্মোগ্রাফি থেকে তারা দুদিকটাই পেয়ে যাচ্ছে। তারাও কমপ্লেন করছে না, আমিও না। আমি জানি আমি দুটোই পারি এবং করি আর ভালোবেসে করি। আমার মধ্যে পপুলিস্ট এবং এক্সপেরিমেন্টাল দুটো মানুষই আছে।
চারদিকে এত হিংসা, সেখানে একজন কনট্রাক্ট কিলারের গল্প কেন আবার?
- তার জন্য তো ছবিটা দেখতে হবে!
মৃত্যুঞ্জয় কর কি ইউথানেশিয়ার মানুষরূপী অবতার?
- হতেও পারে, ১১ এপ্রিল উত্তর পাবে।
আপনার ছবিতে ক্রাইম খুব বেশি থাকে...
- ‘পদাতিক’, ‘অতি উত্তম’-এ ক্রাইম ছিল না।
হ্যাঁ, মানে দশটা ছবির মধ্যে তিনটে ছবিতে যদি ক্রাইম না থাকে তাহলে কি সেটা ধরা হবে?
- (হা হা হা হা) আসলে যারা থ্রিলার বানাতে ভালোবাসে তাদের ছবিতে ক্রাইম থাকে। আর আমি মনে করি, সব ছবিই এক ধরনের থ্রিলার, প্রেমের ছবিও আসলে থ্রিলার।
আপনার নায়ক প্রধান জনপ্রিয় ছবিগুলো নায়িকা কেন্দ্রিক ছবি করা যেত বলে আপনার মনে হয়?
- আসলে ফিমেলসেন্ট্রিক ছবির বাজেট সবসময় পাওয়া যায় না। খানিকটা ব্যবসায়িক সাফল্য এর সঙ্গে জড়িত। যেদিন সেই দিক থেকে গ্রিন সিগন্যাল পাব, না করার তো কিছু নেই।
তাহলে ধরে নিলাম পেলেন, সেক্ষেত্রে ‘অরুণ চ্যাটার্জি’, ‘প্রবীর রায়চৌধুরি’, ‘অভিজিৎ পাকড়াশি’ এবং আনন্দ-মৃত্যুঞ্জয়-এর চরিত্রে কাদের কাস্ট করতেন?
- হুমম, এটা ভাবতে হবে। ‘অরুণ চ্যাটার্জি’ অবশ্যই ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, ‘প্রবীর রায়চৌধুরি’ একমাত্র হতে পারে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, ‘অভিজিৎ পাকড়াশি’ আমি পাওলিকে কাস্ট করতাম। এবং আনন্দ-মৃত্যুঞ্জয়ের চরিত্রে সোহিনী সরকার।