সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: "সবাই তো গল্পের নায়ক হতে চায়। কিন্তু নীতীশের গল্পের নায়ক ওর বাবা মুত্যালা রেড্ডি"। বক্তার নাম কুমার স্বামী। নীতীশ কুমার রেড্ডির ছোটবেলার কোচ। তাঁর বয়ানে এক নতুন তারকার গল্প নয়, উঠে এল বাবা-ছেলের গল্প। বক্সিং ডে টেস্টে সেঞ্চুরি করে যখন নীতীশ 'বাহুবলি' স্টাইলে সেলিব্রেট করছেন, তখন তাঁর বাবার চোখে জল। খুব স্বাভাবিক। নীতীশের উত্থান-সাফল্যের পিছনে পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে মুত্যালার আত্মত্যাগের কাহিনি।
বর্ডার গাভাসকর ট্রফির প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই ভালো খেলেছেন নীতীশ (Nitish Kumar Reddy)। হয়তো বড় রান করতে পারেননি, কিন্তু ভারতকে একাধিকবার বিপদসীমা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছেন ২১ বছর বয়সি ক্রিকেটার। বড় রান যে আসতে চলেছে, তার পূর্বাভাস ছিলই। সেটা এল মেলবোর্নে, বক্সিং ডে টেস্টে। ভারতের লড়াই বাকি আছে এখনও, নীতীশেরও লড়াই জারি থাকবে। যেভাবে লড়াই করে দেশকে নীতীশ রেড্ডি উপহার দিয়েছেন তাঁর বাবা।
ভারতীয় টেস্ট দলে যখন প্রথম ডাক পান, তখন বিশ্বাসই হয়নি মুত্যালার। কিছুক্ষণ ভাষা হারিয়েছিলেন দুজনেই। কিন্তু স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। আর নীতীশ যে তাঁর যোগ্য, সেটা প্রমাণও করে দিলেন। যেমন করেছেন আইপিএলে। হায়দরাবাদের জার্সিতে অসাধারণ পারফরম্যান্সের পর তাঁকে ৬ কোটি টাকায় রিটেইন করেছে। কিন্তু দল ছাড়লে নিলামে কি আরও বেশি টাকা পেতেন না? নীতীশ বা মুত্যালা এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। বাবাকে পালটা প্রশ্ন করেছিলেন নীতীশ, "কারা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে? কাদের হয়ে খেলে আমার নাম হল? তাদের আমি ছাড়ব কেন?" আর ৬ কোটি টাকা পেয়ে আজও রেড্ডি পরিবার মধুরাওয়াড়ার একটি ভাড়াবাড়িতে থাকে।
এ তো গেল আবেগের কথা। কিন্তু দিনের পর দিন যে অক্লান্ত পরিশ্রম তাঁরা করেছেন, সেটাও লেখা রইল এদিন নীতিশের ব্যাটে। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরেই প্র্যাকটিস। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি, কোনও দিন নিয়ম বদলায়নি। কিন্তু ২০১৩-তে আচমকা বিপত্তি। বিশাখাপত্তনম জেলা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন থেকে তাঁর বাবাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, ক্রিকেটটা ঠিক নীতীশের জন্য নয়। ওকে বরং পড়াশোনাতেই মনোযোগ করতে বলা হোক। এখান থেকে শুরু হয় বাবা-ছেলের গল্প। মুত্যালা বুঝতে পেরেছিলেন, ছেলের অনুশীলনেই ঘাটতি আছে। বাড়ি থেকে ১৫ কিমি দূরে মিউনিসিপাল স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিস শুরু হয়। কদিন পরে সেখান থেকে চলে আসেন ৩০ কিমি দূরের আরেকটি স্টেডিয়ামে। যেখানে আরও ভালো পেসার ও স্পিনারদের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করতে পারবেন নীতীশ। অর্থনৈতিক বাধা নিয়ে কখনও ভাবেননি মুত্যালা। ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর জন্য যা করা সম্ভব সব করেছেন। এমনকী সরকারি চাকরি ছাড়তেও পিছ-পা হননি। যাতে ছেলের ক্রিকেট কেরিয়ারের জন্য তিনি সময়ব্যয় করতে পারেন।
নীতীশ নিজেই কিছুদিন আগে বলেছিলেন, “সত্যি কথা বলতে, শুরুর দিকে ক্রিকেট নিয়ে আমি অতো সিরিয়াস ছিলাম না। আমার বাবা আমার জন্য কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমার উত্থানের পিছনে বহু ত্যাগ রয়েছে। একদিন দেখি, আমার বাবা টাকাপয়সার সমস্যার জন্য কাঁদছেন। আমি তখন ভাবি, এভাবে চললে হবে না। যেখানে আমার বাবা কষ্ট করছেন, সেখানে ক্রিকেটকে শুধু মজা হিসেবে নিলে চলবে না।” আর আজ? এক মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান অস্ট্রেলিয়ার মাঠে দাঁড়িয়ে দেখছেন তাঁর বাবার চোখে আনন্দাশ্রু।
দিনের শেষে কোনও রকমে মুত্যালা বললেন, "আমাদের পরিবারের জন্য আজ একটা বিশেষ দিন। এই দিনটা কোনওদিন ভুলতে পারব না।" ভোলা সম্ভব নয়। গত ১৪-১৫ বছরের সফরের কষ্ট-পরিশ্রম সব যে সার্থকতা পেল এদিন। আর এ তো শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য নয়। দলের কঠিন সময়ে কথা বলে উঠেছে নীতীশের ব্যাট। ভারতকে লড়াইয়ে রেখেছে। সেঞ্চুরির আগের কিছু মুহূর্ত অবশ্য খুব কঠিন ছিল। ওয়াশিংটন সুন্দর আউট হয়ে যাওয়ার পর ফিরে যান বুমরাহও। কামিন্সের শেষ তিনটি বল খেলতে হত মহম্মদ সিরাজকে। সেই মুহূর্তের অভিজ্ঞতা জানিয়ে মুত্যালা বলছেন, "খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম। শেষ উইকেট বেঁচে ছিল। কিন্তু সৌভাগ্য যে সিরাজ তিনটে বল খেলে দিয়েছে।" আর ছিল অবিরাম প্রার্থনা।
তারপর বহু প্রতীক্ষিত সেঞ্চুরি। ভারত দ্রুত উইকেট হারিয়ে যতটা চিন্তায় পড়েছিল, সেই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেলেন মুত্যালাও। তাঁর গল্পটা তো শুধু ওই তিন উইকেট হারানোর নয়, সেটা বেশ কয়েক বছর পুরনো। নীতীশ পেরেছেন। কাজ শেষ হয়নি। ভারত এখনও ১১৬ রানে পিছিয়ে। চতুর্থ দিনে ভরসা বলতে নীতীশই। শুধু মুত্যালা নন, তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরাও।