shono
Advertisement

সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন খোদ সিজার! রহস্যময়ী ক্লিওপেট্রা যেন মর্ত্যের ‘ভেনাস’

এত যুগ পেরিয়ে এসেও রহস্যে মোড়া ক্লিওপেট্রার জীবন।
Posted: 05:32 PM Aug 19, 2022Updated: 04:34 PM Aug 21, 2022

বিশ্বদীপ দে: ‘চোখে তার যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!… এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।’ জীবনানন্দ দাশের লেখা বিখ্যাত এই পঙক্তি কাকে নিয়ে তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। কিন্তু লেখার সময় একবারও কি কবির মনে ভেসে ওঠেনি সুদূর অতীতের ছায়া? দু’হাজার বছরেরও আগের এক সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে যে অবিকল মিলে যায় এই বর্ণনা। বিশেষ করে রোমান লেখক প্লুটার্কের লেখায় যেভাবে আঁকা হয়েছে ক্লিওপেট্রাকে তা এমনই অতুলনীয় এক নারীর কথা তুলে ধরে। হ্য়াঁ, ক্লিওপেট্রা। সত্যিই কি মিশরের এই রানি ছিলেন ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ সুন্দরী? নাকি তাঁর নিছক শারীরিক সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে বুদ্ধিমত্তা ও ব্যক্তিত্বের মিশেলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনন্যা? তাঁর মৃত্যুর মতো এই প্রশ্নও অমীমাংসিত। এত যুগ পেরিয়ে এসেও রহস্যে মোড়া ক্লিওপেট্রার (Cleopatra) জীবন।

Advertisement

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক এরিক গ্রুয়েন তাঁর ‘ক্লিওপেট্রা: এ স্ফিংকস রিভিজিটেড’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ক্লিওপেট্রা কোনও যৌন শিকারী ছিলেন না। সিজারের কোনও খেলনা বিশেষও ছিলেন না। তিনি ছিলেন ইজিপ্ট, সাইরিন ও সাইপ্রাসের রানি। গৌরবময় টলেমি বংশের প্রতিনিধি। একজন আবেগপ্রবণ কিন্তু খুব চতুর মহিলা, যিনি রোমকে চালনা করতেন।’ প্রথম থেকেই তিনি নিজেকে মিশরের কোনও দেবীর জাতিস্মর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এরপর যত সময় গড়িয়েছে ততই ক্লিওপেট্রাকে ঘিরে জন্ম নিয়েছে নানা মিথ।

এ পৃথিবী একবার পায় তারে…

[আরও পড়ুন: ‘গায়ে কাদা লাগানোর চেষ্টা, সম্মানের ব্যাপার’, সম্পত্তিবৃদ্ধি মামলা নিয়ে মন্তব্য দিলীপ ঘোষের]

বাবা দ্বাদশ টলেমি ছিলেন তিনশো বছরের টলেমি বংশের এক গুরুত্বপূর্ণ শাসক। কিন্তু ‘বন্ধু’ রোমের উত্থানের পরে ধীরে ধীরে তাঁরা গরিমা হারাচ্ছিলেন। নিয়মিত শক্তিশালী রোমের চাপে ক্ষমতা ধরে রাখাই হয়ে উঠছিল বড় চ্যালেঞ্জের। ৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্বাদশ টলেমি সিংহাসনচ্যুত হলে সাম্রাজ্যের রানি হন ক্লিওপেট্রা ট্রিফেনা। ইনি আরেক ক্লিওপেট্রা। তবে তিনি বেশিদিন বাঁচেননি। তাঁর পরে আরেক মহিলার হাতে যায় ক্ষমতা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৫৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমানদের সাহায্য়েই ক্লিওপেট্রার বাবা ক্ষমতা ফিরে পান। কিন্তু এবার তিনি একা নন, তাঁর সপ্তদশী কন্যাও বসেন সিংহাসনে। বছর চারেকের মধ্যেই মৃত্যু হয় দ্বাদশ টলেমির। এবার রাজসিংহাসন নিয়ে ক্লিওপেট্রার সঙ্গে সংঘাত বাঁধে তাঁর ভাই ত্রয়োদশ টলেমির। ক্লিওপেট্রাকে রাজক্ষমতা দিতে তীব্র আপত্তি ছিল তাঁর ভাই ও তাঁর পরামর্শদাতাদের। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পালাতে হয় ক্লিওপেট্রাকে। শেষ পর্যন্ত জুলিয়াস সিজারের সাহায্যে নিজের সিংহাসন ফেরত পান ক্লিওপেট্রা।

বয়সে ক্লিওপেট্রার থেকে তিরিশ বছর বড় ছিলেন সিজার। তাঁর ইজিপ্টে আসা ছিল নিতান্তই এক দুর্ঘটনা। রোমান গৃহযুদ্ধে রোমের সেনাপতি পম্পেইয়ের সঙ্গে তখন তাঁর লড়াই চলছে। হারতে হারতে ইজিপ্টে আসেন পম্পেই। উদ্দেশ্য ত্রয়োদশ টলেমির কাছে আশ্রয় পাওয়া। কিন্তু টলেমি বুঝেছিলেন পম্পেইয়ের থেকে সিজার অনেক বেশি ‘দামি’। তাই সোজা তাঁর মাথা কেটে উপহার দিলেন অল্প সেনা নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় পা রাখা সিজারকে। কিন্তু সিজার উপহার পেয়ে গললেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ভাইবোনের বিরোধ মেটানোর। আসলে শস্যের জন্য ইজিপ্টের উপর নির্ভরশীল রোমান সাম্রাজ্যের কাছে সেখানকার শাসনক্ষমতার স্থিতিশীল থাকা খুব প্রয়োজনীয় ছিল।

ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্যের মিথ তাঁর স্ট্যাচুতে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী

[আরও পড়ুন: ধর্ষণের অভিযোগে আরও বিপাকে বিজেপি নেতা শাহানওয়াজ হুসেন, মামলার অনুমতি আদালতের]

এদিকে টলেমি চাইছিলেন সিজারের হাতেই রাজক্ষমতা তুলে দিতে। যে করে হোক ক্লিওপেট্রাকে সম্রাটের থেকে দূরে রাখাই তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু নিজের ব্যক্তিত্বের প্রতি চরম আত্মবিশ্বাসী ক্লিওপেট্রা জানতেন, তিনি যদি একবার সিজারের সামনে এসে দাঁড়ান তাহলেই সব কিছু তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তাই হল। একটি বিখ্যাত মিথ রয়েছে, ক্লিওপেট্রা নাকি একটি কার্পেটের মধ্যে (মতান্তরে কম্বল) লুকিয়ে সটান হাজির হন সিজারের সামনে।

তারপর? ইজিপ্ট বিশারদ জয়েস টাইলডেসলির বই ‘ক্লিওপেট্রা, লাস্ট কুইন অফ ইজিপ্ট’ থেকে পাওয়া যায়, সেই রাতে ত্রয়োদশ টলেমি মহা আনন্দে ঘুমোতে গেলেন। যাক, দিদি অনেক দূরে। সিজার হাতের মুঠোয়। আর কী চাই? কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠতেই জানতে পারলেন ক্লিওপেট্রা প্রাসাদে প্রবেশ করেছেন। এখানেই শেষ নয়। ততক্ষণে সিজার ক্লিওপেট্রার রীতিমতো ‘ঘনিষ্ঠ’ হয়ে গিয়েছেন। এর ন’মাস পরে ক্লিওপেট্রার গর্ভে জন্ম নেয় তাঁর ও সিজারের সন্তান সিজারিয়ান।

রুপোলি পর্দায় ক্লিওপেট্রা

সিজারের সৌজন্যে রাজপাট ফিরে পেলেন ক্লিওপেট্রা। ভগ্নহৃদয়ে মারা গেলেন ত্রয়োদশ টলেমি। তাঁর আরেক ভাই চতুর্দশ টলেমিকে খুন করিয়েছিলেন ক্লিওপেট্রাই। আয়ত চোখের সুন্দরী সিংহাসনে বসার জন্য অন্য কোনও কিছুকেই রেয়াত করেননি। ৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিজারের মৃত্যু হয়। রোমের শাসনভার বর্তায় মার্ক অ্যান্টনি ও অক্টাভিয়ানের (অগাস্টাস সিজার) উপরে। অ্যান্টনিও ক্লিওপেট্রার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। বলা যায়, নিজের মোহে তাঁকে আবিষ্ট করেছিলেন ক্লিওপেট্রাই। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই যমজ সন্তানের মা হন ক্লিওপেট্রা। বিনিময়ে দখল হওয়া সাইরেন ও সাইপ্রাস তাঁকে ফিরিয়ে দেন অ্যান্টনি। এমনকী, এশিয়া মাইনরের উপকূলীয় অঞ্চলের এক বিস্তৃত এলাকাও তিনি ‘উপহার’ দেন তাঁকে।

অক্টাভিয়ান এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জনতাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মিশরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি। অ্যান্টনি সেই যুদ্ধে পরাজিত হন। পরে অক্টাভিয়ান আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রবেশ করলে আত্মহত্যা করলেন তিনি। প্লুটার্কের লেখা থেকে জানা যায়, যুদ্ধে হারের যন্ত্রণা কিংবা অক্টাভিয়ানের হাতে বন্দি হওয়ার ভয় নয়, ক্লিওপেট্রার আত্মহত্যার ভুয়ো খবর শুনেই তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। আর এই খবর তাঁকে দিয়েছিলেন স্বয়ং ক্লিওপেট্রাই!

সম্ভবত প্রাচীন এই মূর্তিটিও ক্লিওপেট্রারই

তবে ক্লিওপেট্রার আবেদনের জাদুতে গলেননি অক্টাভিয়ান। তিনি যখন আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রবেশ করেন, নীলনয়না চেয়েছিলেন তাঁকে নিজের জাদুতে মুগ্ধ করতে। কিন্তু ক্রমেই তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় তাঁকে রোমে নিয়ে যাওয়া হবে ঠিকই। কিন্তু তাঁকে একটা ‘ওয়ার ট্রফি’র বেশি কিছু ভাবা হচ্ছে না, এটা সম্রাজ্ঞীর ‘ইগো’তে প্রবল আঘাত দিয়েছিল। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি আত্মহত্যা করেন সাপের ছোবল খেয়ে। কিন্তু তা নিয়ে রহস্য রয়েছে। বলা হয় একটি গোখরো সাপ ৫ থেকে ৮ ফুট লম্বা হয়। কিন্তু ওইরকম দীর্ঘ একটি সাপকে ফলের ঝুড়িতে লুকিয়ে রাখার তত্ত্ব ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। যদিও এ ব্যাপারে অনেকেই একমত, বিষপ্রয়োগেই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। তবে নিশ্চিত করে কিছু বলা মুশকিল।

ইতিহাসের বুকে জ্বলজ্বল করছেন ক্লিওপেট্রা। কিন্তু হারিয়ে গিয়েছে তাঁর ও অ্যান্টনির কবর। তাঁদের দু’জনকে একসঙ্গেই কবরস্থ করা হয়েছিল। বলা হয় বটে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ৫০ কিমি দূরের একটি স্থানেই নাকি রয়েছে সেই কবর। কিন্তু এই দাবিকে মান্যতা দেন না অধিকাংশ ঐতিহাসিক। ফলে সেই অর্থে ক্লিওপেট্রা আজ কেবল এক কুয়াশায় মাখা ইতিহাস। তিনি কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন কিনা এই নিয়েও তর্ক রয়েছে (যেহেতু তাঁর মায়ের বা মামাবাড়ির দিকের কোনও পরিচয় পাওয়া যায় না)। তবে একটা বিষয়ে সকলেই নিঃসংশয়। ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্যের অভূতপূর্ব সঙ্গমে নির্মিত তাঁর উপস্থিতি এমনই ছিল, মুহূর্তে আশপাশের সকলকে কার্যত সম্মোহিত করে দিতে পারতেন। জীবনানন্দের লেখায় ফিরি- ‘ এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement