বোরিয়া মজুমদার: বিরাট-রোহিতের সম্পর্ক ঘিরে জল্পনা বহু বছর ধরে। বিরাটের (Virat Kohli) টি-টোয়েন্টি টিমের অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত এবং রোহিতকে (Rohit Sharma) ৫০ ওভারের ওয়ান ডে ম্যাচের সহ-অধিনায়ক পদ থেকে সরে আসতে বলার পর এই তিক্ততা বেড়ে গিয়েছে কয়েক গুণ। অনেকেই মনে করছেন, দল এখন দুই শিবিরে বিভক্ত এবং বর্তমান অধিনায়কের সঙ্গে সহ-অধিনায়ক বা বলা যায়, দলের ভবিষ্যৎ অধিনায়কের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নেই।
এখানেই আমার মূল প্রশ্ন। এই দু’জন খেলোয়াড়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু হওয়ার প্রয়োজন কতটুকু? ভারতীয় ক্রিকেট দলের দুই অন্যতম সেরা পারফর্মার, সেরা খেলোয়াড়ের মধ্যে কি গাঢ় বন্ধুত্ব থাকা আবশ্যিক? ড্রেসিং রুমের শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি খেলার বাইরেও কি কোনও বিশেষ সংযোগ থাকা প্রয়োজন? তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বের প্রমাণ দেওয়ার জন্য কি পরিবার-সহ ডিনার খেতে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন আছে? এই প্রতিটা প্রশ্নেরই উত্তর- না। এখানে বিতর্কের জায়গা নেই যে, বিরাট এবং রোহিত একে-অপরের ‘প্রিয় বন্ধু’ নন। কিন্তু আমার মতে, তা হওয়াও অপ্রয়োজনীয়। যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা ভারতের হয়ে সেরা পারফর্ম করছেন এবং ভারতীয় ক্রিকেটের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকছেন, তাঁরা বন্ধু হন বা না-হন বা একে-অপরের সান্নিধ্য উপভোগ করুন বা না করুন- তা আমাদের কাছে উদ্বেগের বিষয় হতে পারে না। ব্যক্তিগত স্তরে বিতর্কের ঝড় তাঁদের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার, যা ভারতীয় ক্রিকেটের ক্ষেত্রে কোনওভাবেই প্রাসঙ্গিক নয়।
[আরও পড়ুন: তালিবানের শাসনে কেমন হওয়া উচিত ভারতের আফগানিস্তান নীতি?]
স্টিভ ও’ এবং শেন ওয়ার্ন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা সময়কালে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দল তখন আক্ষরিক অর্থেই অধিনায়ক ও’ এবং তাঁর ‘রেকার ইন চিফ’ ওয়ার্নের অধীনে। তবে জানা যায়, তাঁরা দু’জন ভাল বন্ধু ছিলেন না কোনও দিন। প্রকৃতপক্ষে, তাঁদের মধ্যে বনিবনা ছিল না বললেও কম বলা হবে। কিন্তু তাঁদের এই দূরত্ব অস্ট্রেলিয়া দলকে এক চোখ-ধাঁধানো উচ্চতায় পৌঁছনো থেকে বিরত করেনি। মাঠে তাঁরা রোহিত এবং বিরাটের মতোই পেশাদার ছিলেন, এবং তাঁদের একমাত্র মনোযোগ ছিল- অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ম্যাচ জেতা। ঠিক তেমনই রোহিত এবং বিরাট যখন বিশ্বকাপের মঞ্চে পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যাটিং করেন, তাঁরা কি তখন একে-অপরের ভিতরের দূরত্ব নিয়ে মাথা ঘামান? এই ধরনের ভাবনা কি আদৌ গুরুত্বপূর্ণ? বরং, তাঁরা শুধুমাত্র একটি বিষয় নিশ্চিত করার জন্য ব্যাটিং করেন, তা হল, ভারতকে পাকিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপে আরেকটা ম্যাচ জিততে হবে।
আসল সমস্যা হল বাহ্যিক। আমরা চাই, তাঁরা ‘বন্ধু’ হয়ে উঠুন, এই ধারণার বশে যে, তা না হলে তাঁরা ভারতীয় ক্রিকেটের উন্নতিসাধন করতে পারবেন না। আবার এ-কথাও সত্যি যে, যদি তাঁরা ভীষণ কাছের বন্ধু না হন, তাহলে মিডিয়াতে তাঁদের নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প লেখা যাবে। রোহিত শিবির বনাম বিরাট শিবির- নিঃসন্দেহে নজরকাড়া শিরোনাম। বাস্তবে প্রত্যেক কৃতী ব্যক্তির অহং থাকবেই। যদি না থাকে, তাহলে তা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম। বীরেন্দ্র শেহওয়াগ কি ভারতীয় অধিনায়ক হতে চাননি? অবশ্যই চেয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, তা ছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির যুগ, তাই বীরুকে তাঁর দেশের হয়ে ম্যাচ জিতেই খুশি থাকতে হয়। কিন্তু তিনি কি অধিনায়ক হতে চেয়ে কোনও ভুল করেছিলেন? অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক হওয়ার স্বপ্ন কি ওয়ার্নের দেখা উচিত ছিল না? বিরাট এবং রোহিত যদি পারফর্মার হিসাবে একে-অপরকে ছাপিয়ে যেতে চান, তাহলে তা কি কোনওভাবে ভুল?
[আরও পড়ুন: উত্তরপ্রদেশে জাঠ, মুসলিম ঐক্য কি ধাক্কা দেবে বিজেপির সিংহাসনে?]
সত্যি বলতে, বিশ্বের অন্যতম সেরা দুই খেলোয়াড়ের মধ্যে শত্রুতা কি স্বাভাবিক নয়? এই মুহূর্তে ভারতের বোলিং আক্রমণ নিয়ে আমরা প্রত্যেকে সমান উচ্ছ্বসিত। বুমরা, শামি, সিরাজ, শার্দূল, ইশান্ত- প্রত্যেকেই খুব ভাল পারফর্ম করছেন, যা ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য লাভজনক। তা বলে কি বুমরা ও শামি একে-অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন না? এটা কি ন্যায়সংগত বলে মনে হয় না যে, দুই গুণী বোলার, দলের প্রধান স্ট্রাইক বোলারের খেতাব জিতে নেওয়ার চেষ্টা করবেন? তাহলে কেন এমন একটি বিষয় অস্বাস্থ্যকর ও তীব্র জল্পনার কারণ হয়ে দাঁড়ায় বারবার?
আমি বিরাট এবং রোহিত- দু’জনকেই বহু বছর ধরে চেনার সুবাদে বলতে পারি যে, তাঁরা দু’জন একেবারে ভিন্ন ব্যক্তিত্বের মানুষ। কিন্তু তাঁদের অভিন্ন লক্ষ্য- শ্রেষ্ঠত্ব। তাঁদের সাফল্যের ভিন্ন পথ থাকতে পারে, কিন্তু চূড়ান্ত লক্ষ্য এক, ভারতের হয়ে টুর্নামেন্ট জেতা। ২০১৯ সালে বিশ্বকাপে ৫টা সেঞ্চুরি করার পর যখন আমি রোহিতের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, তখন আমার অনুমান ছিল, তিনি নিঃসন্দেহে নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে খুব খুশি। কিন্তু আদতে তিনি খুশি ছিলেন না। তিনি বলেছিলেন, কী লাভ সেঞ্চুরি করে, যদি ট্রফি অন্য ড্রেসিং রুমে চলে যায়? আসল লক্ষ্য অধরা থেকে যাওয়ায় তিনি যারপরনাই হতাশ ছিলেন। তাঁর কাছে সেজন্য ব্যক্তিগত প্রশংসার সেভাবে কোনও মূল্য ছিল না। বিরাটের ক্ষেত্রেও তাই। কারণ দলগত খেলায় চূড়ান্ত হল দলের স্বার্থ, ব্যক্তিস্বার্থ নয়।
গ্যারি কার্স্টেন একবার আমার কাছে এই বিষয়টি ভীষণ সুন্দরভাবে তুলে ধরেছিলেন। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে মোহালিতে ভারত পাকিস্তানকে পরাজিত করার পরদিনের সকাল। সবাই খুব গভীর রাত পর্যন্ত পার্টি করায় সকালে তখন চারদিক শান্ত। কার্স্টেন প্যাডি আপটনের সঙ্গে টিম হোটেলে জলখাবার করছেন, সেই সময় তাঁর আমার সঙ্গে দেখা। আমার মনে আছে, আগের দিনের জয়ের জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে আমি বলেছিলাম যে, তিনি দলের মধ্যে যে সেতুবন্ধন করেছেন-তা দুর্দান্ত এবং প্রশংসনীয়।
[আরও পড়ুন: তালিবানের উত্থানে দুনিয়াজুড়ে ফের বাড়ছে সন্ত্রাসবাদ! তবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করাটাই সভ্যতা]
তখনই গ্যারি আমাকে এই বিষয়টি বুঝিয়েছিলেন। তিনি বললেন, আপনার কি মনে হয়, দলের এই ১১ জন খেলোয়াড় প্রত্যেকে প্রত্যেকের বন্ধু? না কি তাঁদের আদৌ বন্ধু হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে? আমি শুধু এইটুকুই চেয়েছি, শূন্যে ক্যাচ ওঠার সময় দলের ১৫ জন সদস্যের প্রত্যেকেই যেন সমবেতভাবে প্রার্থনা করে, যাতে সেই ক্যাচ দেশের হয়ে আমরা নিতে পারি। এরপর তাঁরা একে-অপরের সঙ্গে খেললেন কি না, সময় কাটালেন কি না, তা আমার কাছে অপ্রাসঙ্গিক। এর থেকে খাঁটি সত্যি আর কিছু হতে পারে না। গ্যারি কর্পোরেট দর্শনের সারাংশও তুলে ধরেছিলেন নিখুঁতভাবে। এর সারমর্ম, একটি বড় কর্পোরেট বডিতে সবাই একে-অপরের বন্ধু হতে না পারলেও, প্রত্যেককে নিজের প্রতিষ্ঠানের সকলের কথা ভাবতে হবে, প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই। এটুকুই চাওয়া। রোহিত এবং বিরাটের ক্ষেত্রে এটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই, তাঁরা আসন্ন বিশ্বকাপে নিজেদের সেরাটা দিন এবং ভারতের হয়ে ময়দানে নামুন। কে কার কতটা কাছের- তা বিচার করুক ওটিটি-র চিত্রনাট্যকাররা। কারণ তা কাল্পনিক, বাস্তব নয়। আসল কথা হল, দু’জন পেশাদার খেলোয়াড় নিজের দেশের জন্য কাজ করার চেষ্টা করছেন। বিশ্বকাপের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, এখন সময় এসেছে, এই আলোচনা ও জল্পনায় ইতি টেনে ৮ বছর পর ভারতের আইসিসি বিশ্বকাপ ট্রফি জেতার প্রচেষ্টার দিকে মনোনিবেশ করার।