হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব তলানিতে। বিরোধী দেশগুলির প্রতিপত্তি বাড়ছে। ভারত বুঝছে, এভাবে চললে পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। তার উপর উত্তরে ঘোমটার মতো ঝুলে রয়েছে এদের মুরুব্বি চিন। বাড়ছে দিল্লির অসহায়তা। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভারতের ‘চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ’ (সিডিএস) জেনারেল অনিল চৌহান সম্প্রতি বড় এক চিন্তার কথা সরাসরি প্রকাশ করেছেন। দিল্লিতে এক বেসরকারি অনুষ্ঠানে তিনি কবুল করেছেন– চিন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নিজেদের স্বার্থে একে-অন্যের কাছাকাছি আসছে। তারা একটি ‘অক্ষ’ তৈরি করতে চলেছে ভবিষ্যতে, যা ভারতের চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে জেনারেল চৌহান বুঝিয়েছেন, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলির আর্থিক অবস্থা তেমন একটা ভাল না-হওয়ায় চিন প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা অনেক দিন ধরেই করে চলেছে। তঁার ভাষায়, এটা তাদের ‘ঋণ কূটনীতি’। অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য করে চিন এই দেশগুলোকে তাদের তঁাবে আনতে চায়। অনেক দিন থেকেই তারা বিভিন্ন দেশে এই কাজটা করছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রবল উপস্থিতির দরুন কখনও কখনও বাধা পেয়েছে। ঋণের ফঁাদে পড়ে বহু দেশের হঁাসফঁাস হাল অনেক দেশকে সতর্কও করে দিয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীরা ভারতের চাপ ও প্রভাব কখনও পুরোপুরি অগ্রাহ্য করতে পারেনি। ভারতের কূটনীতি এবং ওই সব দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অনেক ক্ষেত্রে চিনকে সেভাবে ডানা মেলতে দেয়নি। ইদানীং সেই ছবি অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে।
রাজনৈতিক পালাবদলের পর সে-দেশের বর্তমান শাসকের কাছে চিন ও পাকিস্তান এখন ভারতের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনার ১৫ বছরে বাংলাদেশের চিনপ্রীতিতে যেটুকু রাখঢাক ছিল, এখন তা হা হা উন্মুক্ত। ’৭১-এর বিষাদস্মৃতিও এখন তাদের কাছে বেদনার, গ্লানির বা অসম্মানেরও নয়। পাকিস্তান তাই নতুন পিরিত। মুখ দেখাদেখি, হাত ধরাধরি আগেই শুরু হয়েছে। কুনমিং বৈঠকের পর ত্রিদেশীয় অক্ষ তৈরির কথা এখন প্রকাশ্যেই আলোচিত।
জুন মাসের ৯ তারিখে কুনমিংয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সঙ্গে চিনা কর্তৃপক্ষের বৈঠকের পর এই মুহূর্তের জোর চর্চা, ‘সাউথ চায়না অ্যালায়েন্স’ বা ‘সাকা’ নামে চিন একটা নতুন জোট তৈরি করতে চাইছে। সেই জোটে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানকেও শামিল করার চেষ্টা চলছে। সবকিছু ঠিকঠাক এগলে আগস্টে ইসলামাবাদে ‘সাকা’-র প্রথম বৈঠক হতে পারে।
জেনারেল চৌহান তিন দেশের নামোচ্চারণ করলেও ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরবর্তী ভূ-রাজনীতি এই অক্ষের কাছাকাছি চতুর্থ এক দেশকেও টেনে এনেছে– তুরস্ক। দিল্লি-আঙ্কারার দূরত্ব এই ক’-দিনে যতটা বেড়েছে, ততটাই কাছাকাছি এসেছে ঢাকা-আঙ্কারা। সম্প্রতি, তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প সংস্থার সচিব হালুক গরগুন ঢাকা ঘুরে গেলেন। তুরস্ক থেকে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই সীমান্ত নজরদারির ড্রোন কিনেছে। সেগুলি কাজও শুরু করে দিয়েছে। চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে তুরস্ক প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরির কারখানা করতে চাইছে। কথাবার্তা অনেকটা এগিয়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন নিগমের শীর্ষকর্তা চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন তুরস্ক সফরও করেছেন এই লক্ষ্যে। হালুক গরগুন দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
এতে বাংলাদেশের সামরিক শক্তি বাড়ল কি কমল– তা নিয়ে ভারতের দুশ্চিন্তা নেই। দিল্লির চিন্তা দুটো। এক, হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব তলানিতে ঠেকা, এবং দুই, চিন-পাকিস্তান-তুরস্কের মতো ভারতবিরোধী দেশের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি। ভারত বুঝছে, এভাবে চলতে থাকলে পশ্চিমে পাকিস্তানের মতো পুবে বাংলাদেশও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। তার উপর উত্তরে ঘোমটার মতো ঝুলে রয়েছে এদের মুরুব্বি চিন।
এই ত্র্যহস্পর্শে হাত বাড়িয়েছে তুরস্ক। মনে রাখতে হবে, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময় চিন ও আজারবাইজানের মতো রিসেপ তাইপ এরদোগানের তুরস্ক খোলাখুলি পাকিস্তানের পক্ষে দঁাড়িয়েছিল। ক্ষুব্ধ ভারতের চাপে মুম্বই, আহমেদাবাদ ও দিল্লি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তুরস্কের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সংস্থা ‘সেলেবি’-র সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে। সেলেবি আদালতে গিয়েছে। ‘টার্কিশ এয়াললাইন্স’-এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলা হয়েছে বেসরকারি বিমান সংস্থা ‘ইন্ডিগো’-কে। ভারত যত তুরস্ককে কোণঠাসা করছে, এরদোগানও তত বাংলাদেশকে কাছে টানছেন। চিন ও পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক অনেক দিনের।
হাসিনার পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের বাংলাদেশকে যতটা নড়বড়ে মনে হচ্ছিল, এখন দেখা যাচ্ছে হাল ততটা খারাপ নয়। ইউনূসও বেশ গুছিয়ে খেলছেন। পহেলগঁাও কাণ্ড ও ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি নিয়ে ভারতের ব্যস্ততা ইউনূসের কিছুটা সুবিধাই করে দিয়েছে। কেননা, বাংলাদেশকে ভুলে ভারত ব্যস্ত থাকছে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে। সেই সুযোগে ইউনূস সাহেব এগিয়ে চলেছেন তঁার ‘মাইনাস টু’ ফরমুলা সফল করতে। হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে পগার পার করানোর পর এখন তিনি ব্যস্ত খালেদা জিয়ার বিএনপির টুঁটি চেপে ধরতে। দ্বিতীয় এই কাজটি কতটা সারতে পারবেন– তার উপর অনেকটাই নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভাগ্য। ভারতেরও।
বিএনপিকে কোণঠাসা করতে ইউনূসের দোসর ‘বৈষম্যবিরোধী’ ছাত্র সমাজ, তাদের রাজনৈতিক দল এনসিপি, জামায়াত ইসলামি ও ইসলামি জোট। অর্থাৎ, বিএনপি এবং ছোট-ছোট কিছু নেতা– সর্বস্ব দল একদিকে, অন্যদিকে রাষ্ট্রশক্তি ও বাকিরা। দ্রুত ভোট করানোর দাবিও স্রেফ বিএনপি ও তার সহযোগীদের। কিছু দিন আগেও দেশের সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ্জামান ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট করানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করছিলেন। ইদানীং তিনি বিস্ময়করভাবে নীরব! এই অবস্থায় জুন মাসে ইউনূসের লন্ডন সফর, সেখানে বিএনপি-র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক, সেই বৈঠকে ফেব্রুয়ারিতে ভোট করানোর ইঙ্গিত দেওয়ার পর একমাস কেটে গেলেও ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভোট নিয়ে ইউনূস একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। অবাক কাণ্ড, বিএনপির আন্দোলনেও দেখা যাচ্ছে ভাটার টান। মায়ানমারের ‘মানবিক করিডোর’ ও চট্টগ্রামের নিউ মুরিং কন্টেনার টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে দেওয়ার বিরোধিতায় যে-দল আদাজল খেয়ে নেমেছিল, তারা কেমন যেন মিইয়ে গিয়েছে! ভোট নিয়ে তাদের আন্দোলনও হঠাৎ যেন শিকেয় উঠেছে।
তুলনায় মাথাচাড়া দিয়েছে বিএনপি-র বিরুদ্ধে এনসিপি-র আন্দোলন। ছাত্রনেতারা রাস্তায় নেমে পড়েছেন। শুরু করেছেন জেলাসফর। বিএনপি-র ‘তোলাবাজি ও চঁাদাবাজি’-র বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে তীব্র প্রচার। আক্রান্ত হচ্ছে বিএনপির অফিস। আরাকান প্রদেশের এক সময়কার ‘মগের মুলুক’ এখন বাংলাদেশের আনাচকানাচে পরিচিতি পেয়েছে ‘মবের মুলুক’ নামে। ‘মবক্রেসি’ বা ‘মবতন্ত্র’ এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বড় বিপদের নাম। মবের সামাল দিতে রাষ্ট্র চূড়ান্ত ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার কতটা ইচ্ছাকৃত আর কতটাই-বা অসহায়তা, তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। দ্রুত নির্বাচন যারা চায় না, মবতন্ত্রকে খাড়া করে তারা
বলছে, আইন-শৃঙ্খলার এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কখনও সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অবাধ হতে পারে না।
বাংলাদেশে ভোট দ্রুত হোক কারা চায় না? সহজ উত্তর, যারা ক্ষমতাসীন ও যারা জানে এখন ভোট হলে একমাত্র সুবিধে বিএনপির। আওয়ামী লীগ ছাড়া এটাই দ্বিতীয় দল সারা দেশে যাদের সংগঠন আছে। সমর্থন আছে। ভোট করানোর অভিজ্ঞতা আছে। জনভিত্তি আছে। ক্ষমতা যারা ভোগ করছে তারা কেন চাইবে অন্য কারও হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে সন্ন্যাস নিতে? তাছাড়া ভোটের দাবিতে উত্তাল আন্দোলনই বা কোথায়? সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করানোর জন্য নেতাদের সাহসী হতে হয়। ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ তার প্রমাণ।
সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারের নিরাপদ ও নিরুপদ্রব জীবনের ঘেরাটোপে থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্তির স্বপ্ন দেখা যেতে পারে কিন্তু কুর্সি ছিনিয়ে নেওয়া যায় না। সে জন্য অকুতোভয় জননেতা হতে হয়। নির্ভয়ে ঝুঁকি নিতে হয়। বাংলাদেশের আঙিনা থেকে ভারত দিন-দিন আরও পিছলে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতোই বেড়ে চলেছে দিল্লির অসহায়তা। বাংলাদেশে পালাবদলের এক ছর হতে চলল, ভারত এখনও দূরের দর্শক মাত্র।
