সৎ, স্বচ্ছ, আদ্যন্ত বাঙালি। কেউ বলেন উদ্ধত, কেউ অভিমানী, কারও মতে অনাবিল। সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিসরে খুঁজে পেতেন তৃপ্তি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর প্রয়াণে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর শ্রদ্ধার্ঘ। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী হয়েও রাজে্য ঢালাও দেশি-বিদেশি বেসরকারি লগ্নির ডাক দিয়ে এক সময় দেশ ও বিশ্বের নজর কেড়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (Buddhadeb Bhattacharjee)। সে-সময় বণিকসভার অনুষ্ঠানে বুদ্ধবাবুকে নিয়ম করে মাও ৎসে তুং-পরবর্তী চিনের কমিউনিস্ট নেতা দেং জিয়াও পিং-কে উদ্ধৃত করে বলতে দেখা যেত, ‘বিড়াল যতক্ষণ ইঁদুর ধরছে, ততক্ষণ তার রং কালো না সাদা, তাতে কিছু যায় অাসে না’। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর চিনে বাজার অর্থনীতি প্রচলন করার সময়ে দেং এই কথাটি বলতেন। তঁার দল যখন কেন্দ্রের অার্থিক উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণের নীতির বিরোধিতা করে, তখন তিনি কেন রাজে্য শিল্পায়নের জন্য এত মরিয়া– সেই প্রশ্নের মুখে বুদ্ধবাবুকেও পড়তে হত। দেংয়ের উক্তিই ছিল তঁার হাতিয়ার।
মহাকরণে একটা সময় বুদ্ধবাবুর ঘরে দেশি-বিদেশি লগ্নিকারীদের ভিড় লেগে থাকত। সেসব লগ্নি-প্রস্তাবের কণামাত্রও বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু বুদ্ধবাবু শিল্পমহলের মধে্য একটা আগ্রহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ২০০৮ সালে একটি সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে অামার ইজরায়েল যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল।
[আরও পড়ুন: মহাপ্রস্থানের পথে ‘বুদ্ধবাবু’, শেষ যাত্রার সারথী হয়ে ‘গর্বিত’, বলছেন শববাহী গাড়ির চালক]
ইজরায়েল রওনা দেওয়ার আগে দিল্লিতে সে-দেশের অ্যাম্বাসাডর আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ওই অ্যাম্বাসাডর ইজরায়েলের এক বড় মাপের কূটনীতিক ছিলেন। দিল্লিতে অল্প দিন কাটিয়ে তঁার ওয়াশিংটনে চলে যাওয়ার কথা। পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা শুনে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘ওয়াশিংটন যাওয়ার আগে আপনাদের রাজে্যর মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সঙ্গে আমাকে সাক্ষাৎ করতেই হবে। তিনি হচ্ছেন এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম নজরকাড়া রাজনৈতিক নেতা। কমিউনিস্ট হয়েও খোলাখুলি পুঁজিবাদী উন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।’
কয়েক বছর ধরে দেশ-বিদেশের নজর কাড়তে পারলেও বুদ্ধবাবুর উন্নয়ন বা শিল্পায়নের ‘মডেল’ সফল হয়নি। চিনে দেংয়ের বিড়াল ইঁদুর মারতে পেরেছে। কিন্তু বুদ্ধবাবুকে শেষ পর্যন্ত তঁার রাজ্যবাসীর কাছেই প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছে। তঁার সরকারের পতন রাজে্য দীর্ঘ দিনের বাম রাজনীতিকেই অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে। অাসলে, বুদ্ধবাবুদের উদারপন্থা ও কট্টরপন্থার উদ্ভট ককটেল রাজ্যবাসী গ্রহণ করেনি। বুদ্ধবাবুর শিল্পায়নের চেষ্টাকে মানুষ স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু শিল্পায়ন করতে গিয়ে অগণতান্ত্রিকভাবে জোর-জবরদস্তি জমি কাড়াকে কেউ সমর্থন করেনি।
শিল্পায়ন বা উন্নয়নের প্রশ্নে বুদ্ধবাবু যতটা উদারনীতির পক্ষে হেঁটেছিলেন, রাজনীতির ক্ষেত্রে কি তিনি ততটা গণতান্ত্রিক ছিলেন? এই প্রশ্নে বিতর্ক কিন্তু থেকেই যাবে। দলে এক সময় তিনি প্রমোদ দাশগুপ্তর ঘনিষ্ঠ হিসাবে চিনপন্থী ও কট্টরপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন। প্রমোদবাবু যখন চিন সফরে গিয়ে প্রয়াত হন, তখন তঁার পাশে বুদ্ধবাবু ছিলেন। পরবর্তীকালে দলে তঁার সঙ্গে উদারপন্থী সুভাষ চক্রবর্তীর লড়াই সুবিদিত। আবার, জে্যাতি বসুর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রশ্নে বুদ্ধবাবুর অবস্থান ছিল উদারপন্থীদের সঙ্গে। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম নিয়ে মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়ের আন্দোলনে যখন রাজ্য উত্তাল, তখন একাধিকবার বুদ্ধবাবুর মন্তব্য ও অবস্থান বিতর্ক তৈরি করেছে। নন্দীগ্রামে যখন সিপিএমের ‘হার্মাদ’ বাহিনী আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে, তখন তাকে সমর্থন করে বুদ্ধবাবুকে বলতে দেখা গিয়েছে– ‘দে হ্যাভ বিন পেড ব্যাক ইন দেয়ার ওন কয়েন’। এই বুদ্ধবাবুর মুখেই ২০০৬ সালের পর শোনা গিয়েছিল– ‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩০’। উদারপন্থী, না, কট্টরপন্থী– এই ধেঁায়াশা কিন্তু তঁাকে ঘিরে কখনওই পুরোপুরি কাটেনি রাজ্যবাসীর। কোনও একটা নির্দিষ্ট অবস্থান নিতে না-পারাই কিন্তু ছিল তঁার দল ও সরকারের ব্যর্থতার মূলে। যা দেংয়ের চিনের ক্ষেত্রে ঘটেনি।
[আরও পড়ুন: আবেগের অভিঘাতে স্বেচ্ছাবন্দি! বুদ্ধবাবুর স্মৃতিচারণায় কুণাল ঘোষ]
বুদ্ধবাবুকে বাঙালি প্রাথমিকভাবে চিনেছিল সুকান্ত ভট্টাচার্যর ভাইপো হিসাবে। দিনের শেষে বাঙালির কাছে বুদ্ধবাবুর ওই সংস্কৃতিবান, সৎ, স্বচ্ছ, নিপাট ভদ্রলোক বাঙালির ভাবমূর্তিই রয়ে গেল। এক দশকের বেশি মুখ্যমন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা ইত্যাদি পরিচয়গুলি যেন এখন সতি্যই তঁার ক্ষেত্রে বাহুল্য।