জয়ন্ত ঘোষাল: যেন কোনও হলিউডি অ্যাকশন মুভির দৃশ্য! ওয়াশিংটনে ‘ক্যাপিটল হিল’ আক্রান্ত। ‘ক্যাপিটল হিল’, যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল ১৭৯৩ সালে, সেখানে কয়েক হাজার ট্রাম্প সমর্থক ঢুকে পড়ে তাণ্ডবনৃত্য চালাল। আক্রমণকারীদের কাছে ছিল বন্দুক ও বোমা। চলল পুলিশের গুলি, কাঁদানে গ্যাসও। নিহত চারজন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জিতেছেন নির্বাচনী ছলচাতুরির মাধ্যমে– ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গাকারীদের অভিযোগ এমনটাই।
[আরও পড়ুন: কেরলে সাংবাদিকের রহস্যমৃত্যুতে এত নীরব কেন মানুষ?]
হিলের বিস্তীর্ণ চত্বরেই সেনেট ও জনপ্রতিনিধি সভা, মানে পার্লামেন্টের দু’টি কক্ষ। কিছু দূরে সুপ্রিম কোর্ট। দু’-মাইলের মধ্যে হোয়াইট হাউস, যেখানে এখনও ট্রাম্প বসবাস করছেন। হোয়াইট হাউসের ব্যালকনি থেকে এখনও ট্রাম্প প্রতিদিন দেখতে পাচ্ছেন দুধ-সাদা লিঙ্কন হাউস। সেই ‘ক্যাপিটল হিল’– আমেরিকার গণতন্ত্রের প্রাচীন মন্দির। এই প্রাচীনতম গণতন্ত্রের সৌধ আক্রান্ত হল। এ কোন গণতন্ত্র? যেখানে পার্লামেন্টের কাচ ভাঙা হচ্ছে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুসারে ২০ জানুয়ারি পুরনো রাষ্ট্রপতি নতুন রাষ্ট্রপতিকে দায়িত্ব অর্পণ করবেন। অর্থাৎ, আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর হবে সেদিন। এই ঘটনার পর মার্কিন সংবাদমাধ্যমে এমন প্রশ্নও উঠেছে যে, এবার কি ২০ জানুয়ারির আগেই সংসদে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব আনার সম্ভাবনা আছে? সংসদে এমন দাবি বিরোধী শিবির থেকে উঠতেই পারে! মার্কিন মিডিয়ায় এ প্রশ্নও উঠেছে– এই ঘটনা কি কোনও ‘কু’-এর চেষ্টা? ট্রাম্পের উসকানিতেই যদি এটি ঘটে থাকে, তবে কি এটা বিদায়ী প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বেই এই ‘কু’-এর প্রয়াস?
‘কু’ অবশ্য একে বলা যায় না, কারণ অতীতে নানা দেশে যে ‘কু’ হয়েছে, তার সঙ্গে এ ঘটনার ফারাক আছে। এ ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনও সামরিক বা রাজনৈতিক অভ্যুত্থান নয়। এমনকী, এর নিন্দা রিপাবলিকান দলেরও অনেকে করেছেন। কার্যত ট্রাম্পকে এর দায় নিতে হয়েছে একাই। খুব সহজে যে ট্রাম্প ২০ জানুয়ারি ক্ষমতার হস্তান্তর করতে চাইছেন না, অবসরপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হয়ে নিরীহ জীবনযাপন করতে তিনি উৎসাহী নন– এ তো জানা কথাই। তাহলে কেন পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনী আগাম ব্যবস্থা নেয়নি? ট্রাম্প আবার এই দাঙ্গাকারীদের ‘বিদ্রোহী’ আখ্যা দিয়েছেন। ট্রাম্পের কন্যা তো আক্রমণকারীদের ‘দেশভক্ত’ পর্যন্ত আখ্যা দিয়ে ফেলেছেন! তবে কি এবার ট্রাম্পকে ঘরছাড়া করার জন্যও নতুন রাষ্ট্রপতিকে পুলিশ বা নিরাপত্তাবাহিনী ডাকতে হবে? যেমন বিধানসভায় বা ভারতীয় সংসদে মার্শাল ডাকতে হয়? প্রশ্ন অনেক। সেসব প্রশ্নের জবাব আমরা খুঁজছি। তবে সবচেয়ে বড় দুঃখের অনুভব হল, আমেরিকাই যেন আমেরিকাকে ধ্বংস করতে উদ্যত। হায়! এখন যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রণম্য সংবিধান-প্রণেতা টমাস জেফারসন এসে হাজির হতেন, তবে তিনি দেখতেন, পৃথিবী একসময় যে-দেশের নাম দিয়েছিল ‘মেল্টিং পট’, তার এ কী অবস্থা! আব্রাহাম লিঙ্কন থেকে বারাক ওবামা– সাদাকালোর সমন্বয়সাধনের চেষ্টাও দেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে আজ এরকম ঘটনা কেন? জো বাইডেন ৪৬তম প্রেসিডেন্ট। ১৭৮৯ সালে প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। এই দীর্ঘ সময়ে ক্যাপিটল হিলে ঢুকে কেউ আক্রমণ করেছে– এমনটা হয়নি।
কোনও সন্দেহ নেই, জো বাইডেনের সামনে এ এক মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ! কেননা এ কোনও ‘বিক্ষিপ্ত ঘটনা’ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের প্রাচীন দর্শন ভেঙে পড়ছে। পচন ধরছে আমেরিকা নামক দেশের পুঁজিবাদী, উদার-গণতান্ত্রিক ব্র্যান্ডে। কোনও কিছু যখন ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে ওঠে, তখন তার সম্পূর্ণ অবলুপ্তিতেও সময় লাগে। যে-পণ্য বলছে, এটি মাথায় মাখলে টাকে চুল গজাবে এবং উপভোক্তা কিনে চলেছে যুগ যুগ ধরে, সে-পণ্যও হারিয়ে যেতে পারে– যদি দেখা যায় তার ব্যবহারে আসলে টাকে চুল গজাচ্ছে না। তাই রোগটা গভীরে। ক্যাপিটল হিলে যা দেখা গিয়েছে, তা হল রোগের উপসর্গ। ভিতরে ভিতরে জ্বর, ত্বকের উপরিভাগে ফোড়া। আমার মনে হয়, আমেরিকাও এখন এক গভীর আর্থসামাজিক সমস্যায় পতিত। আমেরিকা তার ‘সেলস কোম্পানি’-র মাধ্যমে সৌদি আরব ও অন্যান্য বহু দেশ থেকে তেল কিনে নিজের সঞ্চয় বাড়িয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী রাষ্ট্র হতে চেয়েছিল। চিন ও রাশিয়া সম্মিলিতভাবে তার বিরুদ্ধে গোষ্ঠী তৈরি করে। যাকে বলা হচ্ছে, পৃথিবীর এক ‘নিউ ম্যাপ’। আমেরিকার মনোবাসনা পূরণে আঘাত হেনেছে বহু দেশ। এই আর্থিক প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প এক সামাজিক ফেনোমেনন। হেরে গেলেও তাই ট্রাম্পের পক্ষে শতকরা ভোটপ্রাপ্তি কিন্তু কম নয়। একেই বলা হচ্ছে ‘ট্রাম্পবাদ’। যা এই ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের কালে এক সামাজিক প্রবণতা। তাই ‘ইমিগ্রেশন’ বা অভিবাসন-বিরোধী সাদা সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিরুদ্ধে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে ট্রাম্পের রাষ্ট্র এক নতুন আখ্যান তৈরি করল। রক্ষণশীল, শুধু শ্বেতকায় আমেরিকানদের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠের রাষ্ট্রবাদ তৈরি হল। এই সামাজিক অাখ্যান কিন্তু এক ধরনের মাদক। যা মানুষকে আচ্ছন্ন করে সাময়িকভাবে, কিন্তু ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়। হিটলারের ফ্যাসিবাদের মতো প্রকাশ্য গ্যাসচেম্বারের কর্তৃত্ববাদ দেখা না গেলেও এক ধরনের গোঁড়া রাষ্ট্রবাদী একনায়কতন্ত্র তৈরি হয়, যা উদার-পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের উপরিসৌধগুলিকে খতম করে তিলতিল করে।
এ কিন্তু শুধু আমেরিকা নয়, গোটা দুনিয়াতেই হচ্ছে। রাশিয়ায় একে ‘ভেলভেট ডিকটেটরশিপ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা পুতিনের সম্প্রসারণবাদ ও শক্তিশালী রাষ্ট্রগঠনের চিৎকারে নিহিত আছে। আমরা ভারতীয়। এই পরিস্থিতিতে একটাই আশঙ্কা: ভারতে যেন গণতন্ত্রের এই সংকটজনক অধ্যায়ে আমরা প্রাচীন বৃহত্তম গণতন্ত্রের ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে পারি। করোনা অতিমারী আর্থসামাজিক পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তুলেছে। এ অবস্থায় আপ্তবাক্য একটাই: সাধু সাবধান!