চণ্ডীগড়ের মেয়র নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ যে-বার্তা দিচ্ছে, তা বেশ অশুভই বলা চলে। চণ্ডীগড় হয়ে উঠল সামগ্রিক রাজনৈতিক অবক্ষয়ের এক আয়না। নৈতিকতার অধঃপতন, দাঁত-নখ বের করা প্রতিযোগিতা, এবং ‘জোর যার মুলুক তার’ গোছের মূল্যবোধহীন রাজনৈতিক শাস্ত্রবিধান রয়েছে এর মূলে। এই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন। প্রয়োজন স্বাধীন, বৈধ এবং অবশ্যই স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার। লিখলেন রাজদীপ সরদেশাই
চণ্ডীগড়ের (Chandigarh) মেয়র নির্বাচন তো নেহাতই একখানা অকিঞ্চিৎকর ভোট, কিন্তু তাতেই ভারতের সংসদীয় ভোটকেন্দ্রিক গণতন্ত্রের ফাটলগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল। একজন প্রিসাইডিং অফিসারকে খোদ ক্যামেরার সামনেই ব্যালটে ‘কারচুপি’ করতে দেখা গেল। প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ সুপ্রিম কোর্ট সেই প্রিসাইডিং অফিসারকে শাস্তি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তঁার এই কাজকে গণতন্ত্রকে ‘হাসির খোরাক’ করা ও ‘গণতন্ত্রের হত্যা’ বলেও অভিহিত করেছে।
এই তীক্ষ্ণ মন্তব্যগুলি আপাতত হয়তো কেবলই বিচারবিভাগীয় পর্যবেক্ষণ হিসাবে গণ্য হবে, কিন্তু আদালত কড়া পদক্ষেপ করতে তৎপর বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু এই ন্যায্য ক্রোধের পরও থেকে যাচ্ছে একটা গুরুতর প্রশ্ন: যদি সামান্য মেয়র নির্বাচনেই এমন বেনিয়মের ঘনঘটা দেখা যায়, তাহলে বৃহত্তর ক্ষেত্রে কী ঘটবে?
[আরও পড়ুন: ক্ষোভে ফুঁসছে সন্দেশখালি, এবার শাহজাহান ঘনিষ্ঠ শিবু হাজরার ৩ টি পোলট্রিতে আগুন]
এক অর্থে, চণ্ডীগড় হয়ে উঠল সামগ্রিক রাজনৈতিক অবক্ষয়ের আয়না। নৈতিকতার পরাকাষ্ঠার অধঃপতন, দাঁত-নখ বের করা প্রতিযোগিতা এবং ‘জোর যার মুলুক তার’ গোছের মূল্যবোধহীন রাজনৈতিক শাস্ত্রবিধান রয়েছে এর মূলে। যদি ঘটনাক্রম একটু বোঝার চেষ্টা করা যায়, দেখা যাবে, তা মোটেই বিশেষ স্বস্তিদায়ক নয়।
১৮ জানুয়ারি ভোট হওয়ার কথা ছিল, শেষ মুহূর্তে তা পিছিয়ে গেল। কারণ, প্রিসাইডিং অফিসার হঠাৎই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। এবার আদালত নামল ময়দানে, বলা হল চটজলদি ভোট সম্পন্ন করতে। শুরু হল আসল খেলা। যেভাবে নির্বাচন হল, তাতে প্রভূত সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। আটটি ভোট রহস্যজনকভাবে অবৈধ হয়ে গেল, যার সবক’টিই আম আদমি পার্টি-কংগ্রেস জোটের ভোট ছিল। তাদের পোলিং এজেন্টদের সেইসব বাতিল ব্যালট দেখতেও দেওয়া হল না। এই চূড়ান্ত নৈরাজে্যর মধে্যই বিজেপির প্রার্থী সর্বসম্মতভাবে নতুন মেয়র হিসাবে কুর্সিতে বসে গেলেন। উল্লেখ্য, অভিযুক্ত প্রিসাইডিং অফিসার অনিল মাসিহ বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার সদস্য, এই পরিচিতির ফলে তঁার ভূমিকা নিয়ে অবধারিতভাবে প্রশ্ন আরও বাড়ে।
[আরও পড়ুন: কিশোর পড়ুয়ার সঙ্গে দিনের পর দিন সঙ্গম শিক্ষিকার, জেরায় কবুল করলেন বিবাহিতা তরুণী]
নিতান্তই গড়পড়তা স্থানীয় ক্ষমতাতন্ত্রের অলাতচক্রর পরিণাম বলে চণ্ডীগড়ের এই ঘটনাকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না বোধহয়। দেশজুড়ে যে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোট দানা বাঁধছে, তার অংশ হিসাবে আপ-কংগ্রেসের সন্ধির প্রেক্ষাপটেই এই নির্বাচন ঘটেছে। বস্তুত, এই নির্বাচন ছিল আপ-কংগ্রেসের এই প্রাথমিক স্তরের জোটের কাছে প্রথম হাতেকলমে পরীক্ষা, যেখানে এই বৃহত্তর জোটের পাটিগণিত পরিষ্কার হত। ভিতর ভিতর চিড় ধরে থাকা সত্ত্বেও এই জোট শক্তিশালী শাসক পক্ষের উপর নিজের দাপট কায়েম করতে পারে কি না, তা বোঝা যেত এর ফলে। অন্যদিকে বিজেপির (BJP) কাছেও সুযোগ ছিল সাধারণ নির্বাচনের আগেই বিরোধী জোটের বাসরঘরের ছিদ্রটা আরেকটু প্রতীয়মান করে তোলার।
সেই কারণেই চণ্ডীগড়ের এই ভোট যে-বার্তা দিচ্ছে, তা বেশ অশুভই বলা চলে। আপ-কংগ্রেস জোটের পক্ষে এই মুহূর্তে ২০ জন কাউন্সিলর রয়েছেন, যেখানে বিজেপির পক্ষে ১৬। অর্থাৎ, বিরোধী জোট যেখানে সংখ্যার নিরিখেই এগিয়ে, সেখানেও যদি নির্বাচনে এমন জুয়াচুরি হয় নির্বিচারে– তাহলে ভবিষ্যতের ভোটযুদ্ধে এমনটা ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? তার চেয়েও বড় কথা, প্রিসাইডিং অফিসারের বিরুদ্ধে তঞ্চকতার এই অভিযোগকে একটা ছকে ফেলা যাচ্ছে প্রায়, যার দরুন সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি ক্রমশ আতশকাচের তলায় আসতে বাধ্য। রাজ্যপালরাও দলীয় রাজনীতির আবর্তে পড়ে গিয়েছেন, এমনটাও অনেকেই মনে করছেন, ঝাড়খণ্ডের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিই তার দৃষ্টান্ত। বিভিন্ন আইনরক্ষক প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধেও নিয়ত অভিযোগ আসছে শাসক দলের আয়ুধ হিসাবে কাজ করার। এমনকী, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতাও এখন প্রশ্নের মুখে।
চলতি প্রতর্কটা হল, এসবই প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহারের দীর্ঘলালিত ঝেঁাক থেকে ঘটছে, যার সূত্রপাত মোটেই ২০১৪ সালে হয়নি, বরং বহুকাল যাবৎ এই দেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে এমনটাই ঘটে আসছে। ইন্দিরা গান্ধী কি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে, তঁার সমস্ত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে গ্রেফতার করে, ৩৫৬ ধারা প্রবর্তন করে বা পঞ্চাশ বার রাষ্ট্রপতি শাসন ঘোষণা করে রেকর্ড গড়েননি? রাজীব গান্ধী সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করতে একটি মানহানির বিল আনেননি সংসদে? কংগ্রেসের ভিতরে ও বাইরে তঁার বিরোধীদের পরাস্ত করতে পি. ভি. নরসিংহ রাও কি ‘হাওয়ালা’ তদন্তকে ব্যবহার করেননি? পশ্চিমবঙ্গে যখন যে কেন্দ্রবিরোধী সরকারই থাকুক, তাদের বিরুদ্ধে কি পঞ্চায়েতে ছাপ্পা ভোট দেওয়ার অভিযোগ ওঠেনি? এ-ও তো মনে রাখতে হবে, মোদি সরকারের প্রিয় নন্দ ঘোষ– জওহরলাল নেহরুও কম যাননি! তিনি গণতন্ত্র নিয়ে যতই ঔদার্য দেখান না কেন, প্রথম সংবিধান সংশোধনীতেই কি বাক্স্বাধীনতার উপর কোপ ফেলেননি? কেরলে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বামপন্থীর সরকার তিনি ফেলে দেননি?
কিন্তু এই কে কবে কী করেছে, তা নিয়ে যুক্তি-পালটা যুক্তির খেলাটা নিছকই ক্ষমার অযোগ্য কাজগুলির পক্ষে সওয়াল করার জন্য বাজে অজুহাতমাত্র। সর্বোপরি, ২০১৪ সালে মোদি সরকার যখন ক্ষমতায় এল, তখন তারা ‘অচ্ছে দিন’-এর নিশ্চয়তা নিয়েই এসেছিল। দাবি করেছিল, কংগ্রেসি ব্যবস্থার থেকে বিজেপির কার্যক্রম আলাদা হবে। যেসব বিজেপি নেতা জরুরি অবস্থার কালো দিনের শিকার হয়েছেন, তঁাদের কাছে একটা সংখ্যাগুরু সরকারই সুবর্ণ সুযোগ ছিল এই ক্ষতবিক্ষত রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার ঘটানোর।
তার বদলে কী হল? শেষ দশকে বিজেপি ভয় আর প্রলোভনের রাজনীতিকে হাতিয়ার করে অন্তত চার রাজে্যর নির্বাচিত সরকার ফেলে দিয়েছে এবং দু’টি রাজে্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা ‘আদায়’ করে ছেড়েছে যেনতেন প্রকারে। তদন্তকারী সংস্থাকে শিখণ্ডী খাড়া করে ত্রাসের রাজনীতির জমি পোক্ত করেছে বিজেপি। যদিও, বিরোধী রাজ্যগুলিতে অতি-সক্রিয় থেকে বিজেপি-শাসিত রাজ্য অথবা বিজেপির সঙ্গে সমঝোতায় আসা রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে ঢিলেমি দেখানো এসব সংস্থার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। সংসদ, আদালত বা সংবাদমাধ্যম– কোথাও-ই যে এসব রাষ্ট্রীয় আধিপত্যকামিতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠছে না, এতেই বোঝা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলোর কী হাল!
লোভ দেখানোর কৌশলটা আরও তাক লাগিয়ে দেওয়া। দলত্যাগ করাতে খুড়োর কলে অর্থ ঝুলিয়ে রাখার ঘটনাকে যদি গল্পকথা বলেও ধরে নিই, তাহলেও ক্ষমতার লোভকে অস্বীকার করতে পারে কে? মন্ত্রিত্ব থেকে শাস্তির হাত থেকে বঁাচার রাস্তা পরিষ্কার হওয়া– এসবই লোভের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অন্যদিকে, তথে্যর অধিকার আইনের সরকারি নথির উপর ভিত্তি করে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে একটি সংবাদপত্রে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, মুম্বইয়ের সিভিক বডি– যেখানে দু’বছর ধরে কোনও নির্বাচন হচ্ছে না– বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য বিজেপি-শিবসেনা জোটের বিধায়কদেরই কেবল ৫০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, বিরোধীপক্ষের কপালে সেখানে জুটেছে কঁাচকলা। করদাতাদের টাকা যেখানে এমন সরাসরি বেছে বেছে বিলি করা হচ্ছে রাজনৈতিক লাভের কথা মাথায় রেখে, সেখানে সমানাধিকারের প্রশ্ন তো ওঠেই না!
এই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন। প্রয়োজন, স্বাধীন, বৈধ এবং অবশ্যই স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার। অর্থ ও ক্ষমতার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ইতিমধে্যই নির্বাচনী ব্যবস্থার ভিতরে ঘুণ ধরিয়েছে। অস্বচ্ছ ইলেক্টোরাল বন্ড, দঁাড়িপাল্লায় যার ওজন কিছুটা ঝুঁকেই থাকবে শাসকের দিকে, যে কোনও প্রতিযোগিতাকেই প্রকটভাবে বৈষম্যমূলক করে তুলেছে। নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ হয়ে উঠেছে সমস্যাজনক। ইলেকট্রনিক ভোটযন্ত্র বা ইভিএম নিয়েও কারচুপির অভিযোগ বিস্তর, যদিও সেসবের কিছুই প্রমাণ করা যায়নি এখনও। সঠিক, যথাযথ নির্বাচনী ব্যবস্থায় আরও নজরদারি প্রয়োজন, এবং যেখানে দরকার, প্রয়োজন বিচারবিভাগীয় তত্ত্বাবধানও।
শেষত, সুপ্রিম কোর্ট যেখানে এই নির্বাচনী অন্যায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে চণ্ডীগড়ের মেয়র নির্বাচনের ওই প্রিসাইডিং অফিসারের বিরুদ্ধে শাস্তি ঘোষণা করছে, সেখানে একটি উসকানিমূলক জিজ্ঞাসা চলে আসেই। একজন অফিসার, যিনি একজন সাধারণ দলীয় কর্মী মাত্র, তিনি নিজে থেকেই এমন একখানা অপরাধমূলক কাজে প্রবৃত্ত হলেন, এমনটা সতি্যই কি মেনে নেওয়া যায়? যদি তা না হয়, তাহলে আসলে কাকে বা কাদের দায়ী করা হবে এক্ষেত্রে?