কেরলের নব সাংসদ কে. রাধাকৃষ্ণন গণতান্ত্রিক মতৈক্যে নতুন শব্দ আমদানি করে ঠেকাতে চেয়েছেন দেশজ অন্ত্যজ ব্রাত্য মানুষের অসম্মান। তাঁর উদ্দেশ্য মহৎ। তবে, এই পোড়া দেশে আরও কিছু প্রশ্নের মোকাবিলা করতেই হবে। লিখছেন অভিক মজুমদার।
আমাদের ছাত্র-বয়সে শুনেছিলাম কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত নাকি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ‘কলোনিয়াল হ্যাং-ওভার’ শব্দবন্ধের অনুবাদ করেছিলেন– ‘ঔপনিবেশিক ঝুলনমায়া’। বৎসর বৎসর গেল, তবু এই জুতসই শব্দবন্ধ ভোলা গেল না। ‘ঝুলনমায়া’-র মধ্যে ঢুকে আছে এক নিহিত মদিরতা, এক নিরালম্ব দোদুল্যমান অনুভব, এক মনোরম মায়াবী বায়ুবিহার। সেই অনাবিল স্মৃতিমেদুরতা যেন ছায়ার মতো অনুসরণ করে চলল প্রজামনস্তত্ত্ব।
কবি বিষ্ণু দে আবার দীর্ঘশ্বাসে আর বিদ্রুপে লিখলেন, ‘চলে গেছে ইংরেজি ঘোড়া/ রেখে গেছে হাজার সহিস’। দুই কবির এই ইঙ্গিত-ইশারা আমাদের ক্রমাগত মনে করিয়ে দিতে লাগল, ‘মুক্তি, ওরে মুক্তি কোথায় পাবি, মুক্তি কোথায় আছে?’
এসব নানা প্রসঙ্গ মাথায় স্রোতের মতো আসতে শুরু করল একটি সাম্প্রতিক ঘটনায়। কেরলের জনৈক এমএলএ এবারের লোকসভা নির্বাচনে সাংসদ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে বিধানসভায় পদত্যাগ করতে হল। এই ব্যক্তি, নাম– কে. রাধাকৃষ্ণণ, আলাথুর কেন্দ্রের নবনির্বাচিত সাংসদ, শেষদিন এক জবরদস্ত ঘোষণা করেছেন। মনে রাখতে হবে, এই রাধাকৃষ্ণন কোনও সাধারণ সদস্য নন, তিনি কেরলের ক্যাবিনেট মন্ত্রী। তফসিলি জাতি-জনজাতি এবং পশ্চাৎবর্তী অন্যান্য বর্ণের উন্নয়ন দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। তো, এহেন রাধাকৃষ্ণন তাঁর মন্ত্রকে শেষদিন ঘোষণা করেছেন, ‘কলোনি’-সহ বিভিন্ন শব্দ– যা অভ্যন্তরে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি বহন করছে, তাকে বর্জন করতে। তিনি জানিয়েছেন, “কলোনি– এই শব্দটার সঙ্গে মিশে আছে দাসত্ব। এছাড়া মনে রাখতে হবে ‘কলোনি’ শব্দের নির্মাতা হল অত্যাচারীরা, এই শব্দ দাগিয়ে দেয় হীনমন্যতা, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে অসম্মান প্রদর্শনের মনোভাব। বেশ কিছু অঞ্চলকে নির্দিষ্ট নামে ডাকার মধ্যেও সেই দৃষ্টিভঙ্গি প্রকট। ফলে, সেই পল্লিনামগুলিও বদলাতে হবে। এই বসতির মানুষদের কাছে আবেদন, আপনারা নিজেরাও বিকল্প নামের সন্ধান করতে পারেন।”
রাধাকৃষ্ণন কেরল বিধানসভার বহুকালের সদস্য। পঞ্চমবারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন চেল্লাক্কারা কেন্দ্র থেকে। একসময় বিধানসভার অধ্যক্ষ বা স্পিকার হিসাবেও কাজ করেছেন। মেয়াদের শেষদিনে তাঁরই নির্দেশে ‘তফসিলি জাতি-জনজাতি’ উন্নয়ন দফতরের বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট জানানো হল, তফসিলি জনজাতির
বসবাসের এলাকাগুলির নাম ‘কলোনি’, ‘সংকেতম’ বা ‘উরু’ নামে চিহ্নিত। এই নামগুলির গভীরে লুকনো অসম্মান-কে অনুধাবন করে, অন্য কোনেও পরিচয়ে উল্লেখ করা সংগত। ‘নগর’, ‘উন্নতি’, ‘প্রকৃতি’ বা ওই অঞ্চলের নাগরিকবৃন্দ প্রস্তাবিত কোনও নামের মাধ্যমে আগামী দিনে এসব তল্লাটকে ডাকা সমীচীন।
স্বাধীনতার ৭৭ বছর পর, কে. রাধাকৃষ্ণনের এই উপলব্ধি এবং ঘোষণা মনে যথেষ্ট তরঙ্গ তোলে। শুধু ভাষা কিংবা বাক্যই নয়, শব্দ বা পদের থাকে বহুস্তরিক ইতিহাস। বাংলা, মলয়ালম বা মারাঠি নয়, আন্তর্জাতিক ভাষা-ব্যবহারের রূপরেখা জুড়েও এমন বহু ইতিহাস-সমাজনীতি-রাজনীতি শব্দের সঙ্গে, বাচনের সঙ্গে, প্রবাদের সঙ্গে মিশে থাকে।
কয়েকশো বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রভাবে এবং অভিঘাতে শব্দসমূহ মসৃণ ধারায় প্রবেশ করেছে ভারতীয় ভাষা-সমূহে। আমার মাস্টারমশাই স্বনামধন্য মানবেন্দ্র বন্দে্যাপাধ্যায় একদা আমাকে তর্জনী উঁচিয়ে নিষেধ করেছিলেন ‘টু কল স্পেড আ স্পেড’ প্রবচনটি ব্যবহার করতে। তিনি জানিয়েছিলেন, এই বাগ্ধারার মধে্য লুকনো আছে ‘শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ’। কথাটি বলা হত কালো নিগ্রোদের সম্পর্কে। ‘স্পেড’-এর রং তো কালোই! জাতিবিদ্বেষ কত নিপুণ কৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে বাগ্ধারার ‘নিরীহ’ চলনে। এই ‘স্বাভাবিক’ ব্যবহারবিধি রাধাকৃষ্ণনের মতো আমাদের প্রত্যেককেই অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। দীর্ঘ দিন চোখের সামনে লেখা আছে ‘Chinsurah’ স্টেশন। ‘চুঁচুড়া’ উচ্চারণ করতে পারত না সাহেবরা। ঠিক যেমনভাবে ‘মুম্বাই’ হয়ে গিয়েছিল ‘বম্বে’। তবে এসব হয়তো তত অসম্মানকর নয়।
ক্রমশ, শব্দ এবং তার ব্যবহার, এমনকী উৎপত্তি-প্রয়োগের ঔপনিবেশিক পটভূমি বিচার করলে বেশ কয়েকটি চিহ্নকের হদিশ আমরা পেতে পারি। সন্দেহ নেই– ‘শিক্ষিত’, বিশেষত ইংরেজি শিক্ষিত ‘এলিট’ সমাজে ওসব শব্দ বেশ অহরহ কথন-লেখনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অথচ, সেই সমাজের কাছে পরিপ্রেক্ষিত বা শব্দব্যবহারের চালচিত্র আদৌ অজানা নয়। এমন হতেই পারে, তাঁরা মনে-মনে নিজেদের ওই সাহেবি ধারণার ‘কালো’ উত্তরসূরি ভাবতে পছন্দল করেন। মেকলে-র বিষবৃক্ষজাত এই ফল এবং ফলস্রোতে ভেসে যায় সাধারণ, প্রান্তিক, হা-ঘরে নেটিভের জীবনযৌবন-ধনমান! এমনকী আত্মপরিচয়! রবিনসন ক্রুশো তথা শ্বেতাঙ্গ
প্রভু যেদিন খুঁজে পেলেন দ্বীপের আদি বাসিন্দাকে, সে-ই তো পরম লগন! তার নাম তথা আত্মপরিচয় নির্ধারিত হয়ে গেল প্রভুর ভাষায়, প্রভুর নিরিখে, প্রভুর মানদণ্ডে– সপ্তাহের সেই দিনের স্মারক হয়ে ‘ফ্রাইডে’!
আমরা হয়তো খেয়ালই করি না, ব্যবহৃত বহু শব্দ আর বাক্যবন্ধ কত ভয়ানক সব পশ্চাৎপট আর ইতিহাস বুকে নিয়ে দঁাড়িয়ে আছে।
বঞ্চনা, অত্যাচার, অপমান তার অক্ষরে-অক্ষরে দীপ্যমান। শব্দ ধরে-ধরে তার ব্যবহারের ইতিহাস-ভূগোল নিয়ে চমৎকার একটি অভিধান সংকলন করেছিলেন হেনরি ইউল এবং আর্থার বারনেল, ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে। তবে, তার নাম দিয়েছিলেন ‘হবসন-জবসন’। কোত্থেকে এল এই নাম? ভূমিকায় বলা হয়েছে, গোরা সৈন্যদের কানে যেভাবে পৌঁছত এ-দেশের মানুষের ‘হায় হাসান, হায় হোসেন’ ধ্বনি, সেই বিকৃত রূপই ‘হবসন-জবসন’! মূল্যবান এই শব্দকোষের নামে কি কোথাও লুকিয়ে নেই মহরমের প্রতি কিঞ্চিদধিক শ্লেষ-তাচ্ছিল্য? শব্দের উৎস এবং পরিনামে নানা কিসিমের ‘রাজনীতি’ কি সন্ধান করব না? সতর্ক হব না?
‘বিশ্বভারতী পত্রিকা, নবপর্যায় ১’ সংখ্যায় (শ্রাবণ-আশ্বিন ১৪০১/১৯৯৪) অসামান্য একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন ইতিহাসবিদ বিনয় চৌধুরী। লেখাটির নাম ‘ঔপনিবেশিক-পূর্ব ভারতের আদিবাসী সমাজ: সাম্প্রতিক কয়েকটি ধারণার বিচার’। ওই প্রবন্ধে অধ্যাপক চৌধুরী দেখিয়েছিলেন ‘ট্রাইব’ শব্দটির নির্মাণ কীভাবে ঔপনিবেশিক ‘স্বার্থসিদ্ধি’ থেকে উৎসারিত।
নানা যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছিলেন, ১৮৭১ সালের ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব্স অ্যাক্ট’ (প্রয়োগ ১৯১৪/’১৮) এবং অন্যান্য দমনমূলক প্রক্রিয়া আসলে ব্রিটিশ শাসককুলের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র নির্মাণের বিস্তারিত প্রক্রিয়া। ফুকো যাকে বলবেন ‘গভর্নমেন্টালিটি’। এখন এসব অভিসন্ধি যে-শব্দটিকে ঘিরে আবর্তিত, সেটি হল ‘ট্রাইব’। সমকালীন ভারত এবং বাংলায় কত সহজে এবং সাবলীলতায় আমরা এই শব্দটি দিয়ে কত মানুষকে দেগে দিই। ‘এলিট’ ফুল্লতায় নজর করতে চাই না, কোথাও অপমানের বিষ তির ছিন্নভিন্ন করে গেল কি না, পুরো কোনও জনগোষ্ঠীকেই! ‘ধারণা’ এবং ‘চিন্তাচর্চা’-য় এলিট গোষ্ঠী প্রতি শ্বাসে ব্রিটিশ প্রভুদের সার্থক উত্তরাধিকারী। শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি ধাপে-সোপানে সেই ‘শ্বেতাঙ্গ’ দৃষ্টিভঙ্গির সম্ভার থরে-থরে সাজানো রয়েছে। এও এক ধরনের ‘মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র’, এক অনবদ্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।
সাম্প্রতিক কালে, এই নতুন সহস্রাব্দে, উপনিবেশের হাল-হকিকত তথা প্রভাব-প্রতিপত্তির হিসাবনিকাশ সংক্রান্ত বেশ কিছু অবস্থান, পরিভাষা, বিশ্লেষণ দুনিয়াজুড়ে সারস্বত ক্ষেত্রে এবং জনপরিসরে যথেষ্ট প্রতিপত্তি নিয়ে আবির্ভূত। মনে রাখা ভাল, গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই নানা লেখাপত্র সেই নবনিরীক্ষায় উদ্ভাসিত হয়েছিল। এই ধরনের তিনটি পরস্পর সম্পর্কিত শব্দ হল– ‘অ্যান্টি-কলোনিয়াল’, ‘পোস্ট-কলোনিয়াল’ এবং ‘ডিকলোনাইজেশন’। এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বিস্তৃত এলাকা জুড়ে উপনিবেশের দাপট এবং লুণ্ঠন এখনকার দুনিয়ায় অবিদিত নয়। সেই লুণ্ঠনের ধনরত্নই এখনও উত্তর গোলার্ধের দেশসমূহের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চালিকাশক্তি।
ইতিহাসের পাঠক মাত্রেই জানেন, বিশ শতকে বিশ্বজুড়ে উপনিবেশ বিরোধী নানা আন্দোলনের কথা। স্বাধীনতাপ্রাপ্তি এবং মুক্তি সাধনার বিচিত্র মত এবং পথের কথা। প্রশ্ন উঠতে থাকে, স্বাধীনতা প্রাপ্তি মানেই কি আমূল পরিবর্তন? ঔপনিবেশিকতার হাত থেকে মুক্তি? এসব রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর হয়তো একটা প্রতীকমাত্র। কেননা, অনেক দূর পর্যন্ত শিকড় চারিয়ে দেয় উপনিবেশের কর্তৃত্ব এবং প্রভাব। গ্রামশি কথিত ‘হেজিমনি’, যা রক্তের গভীরে খেলা করে। ‘আপনি যখন গভীর ঘুমে বিভোর, বোরোলীন আপনার ত্বকের ভিতরে কাজ করে।’
সেই অন্তঃশীলা আবর্তের নানা অভিমুখ সন্ধান শুরু করে প্রকৃত ডিকলোনাইজেশনের। তবু সেই অনন্ত সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক চিহ্ন এবং চিহ্নকের সামনে দঁাড়িয়ে পোস্ট-কলোনিয়াল বাস্তবের গভীর প্রদেশে হাত ঢুকিয়ে তুলে আনে প্রশ্ন আর অনুমান। সংস্কৃতি নির্মাণ। অস্তিত্ব নির্মাণ। সামাজিক প্রতিষ্ঠান আর ভাষার বিশদ অন্তর্লোক। প্রাত্যহিকতার ফুলকি আর বহমানতার অবয়ব খুঁড়ে-খুঁড়ে তার তাৎপর্য সমীক্ষা করা চলছে দুনিয়া জুড়ে। মুক্তি এবং বিকল্পের খেঁাজ শুরু করতে গেলে প্রথম সোপানে চাই সমস্যাপটের যথার্থ নকশাকে বোঝা। উপনিবেশের ক্রিয়াকর্ম এবং বিশাল পরিধিকে বুঝতে গেলে কোনও সরল সমীকরণ নেই।
বরঞ্চ স্থান-কাল ভেদে বহুবিশিষ্ট তার অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ। বিভিন্ন কিসিমের উপনিবেশ আমরা দেখেছি। ইউরোপের একেকটি দেশ রেনেসঁাস-উত্তর সময়ে একেক প্রকার উপনিবেশের জন্ম দিয়েছে। লাতিন আমেরিকায় যেমন উপনিবেশের যুগ কেড়ে নিয়েছে ওই ভূখণ্ডের ভাষা। আফ্রিকাতেও ফরাসি এবং ইংরেজ এই ভাষা-বিনাশের প্রকল্পে সক্রিয় ছিল। অথচ, এশিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশ কিছু শব্দ বা
শব্দবন্ধ চাপিয়ে দিয়েছে মাত্র, প্রজাবর্গের ভাষা আমূল নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারেনি।
তবে, কলোনাইজেশনের পর নানা ছদ্মবেশ এবং মুখোশে আসে ‘নিও-কলোনাইজেশন’ বা ‘কোকো-কোলোনাইজেনশন’। আধুনিক এবং উত্তর-আধুনিক যুগে নতুন-নতুন প্রশ্ন উঠে আসতে থাকে। তৈরি হয় অভূতপূর্ব সব পরিস্থিতি। দক্ষিণ গোলার্ধ, তৃতীয় বিশ্ব থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা, পাগলামি, সভ্যতা এবং ক্ষমতাতন্ত্র, শৃঙ্খলা আর শাস্তি নানা প্রান্তিক দেশকাল লিঙ্গ ভাষা ভূগোল পরিচয় সামনে আসতে শুরু করে। সমতা, গণতন্ত্র, শাসনকাঠামো, অর্থনীতি, শ্রেণি, জাতি, নৃতত্ত্ব নিয়ে নতুন প্রশ্ন তৈরি হয়। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, ১৯৯০ সালে প্রথম ব্যবহার করেন ‘পোস্ট-কলোনিয়াল’ শব্দবন্ধটি। অন্যদিকে, কেনিয়ার প্রখ্যাত লেখক এনগুগি ওয়া থিয়ংগো তঁার ‘ডিকলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’ (১৯৮৬) বইয়ে দেশীয় ভাষার গুরুত্ব এবং আফ্রিকায় উপনিবেশের প্রভাবমুক্তি নিয়ে গভীর, বিকল্পসন্ধানী আলোচনা করেন।
ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে যেমন– উপনিবেশের শোষণ-মুক্তির বিষয়ে দুই মনীষার ভিন্ন অবস্থান থেকে উন্মোচক বিশ্লেষণ ধরা পড়বে ‘স্বদেশি সমাজ’ এবং ‘হিন্দ স্বরাজ’ বই দু’টিতে। রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধী নিজ-নিজ অবস্থান থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন। আরও সাম্প্রতিকে, উত্তর-গঠনবাদী ধারণা মিশে গিয়েছে উত্তর উপনিবেশিক সন্ধানে। ফলে, এডওয়ার্ড সঈদ, সেই সূত্রে মিশেল ফুকো, হোমি ভাবা– সেই সূত্রে আলথুসার এবং লাকঁা, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক এবং সেই সূত্রে জঁাক দেরিদা নানা অবয়বে ঢুকে পড়েছেন উপনিবেশের মুক্তি এবং উপনিবেশের বন্ধন নিয়ে বিতর্কে।
মৃণাল সেন নির্দেশিত ‘ইন্টারভিউ’ ছবিটি (১৯৭১) কে. রাধাকৃষ্ণনকে দেখাতে চাইব। শব্দকে পাল্টাতে চেয়েছেন রাধাকৃষ্ণন। গণতান্ত্রিক মতৈকে্য নতুন শব্দ আমদানি করে ঠেকাতে চেয়েছেন দেশজ অন্ত্যজ ব্রাত্য মানুষের অসম্মান। তঁার উদ্দেশ্য মহৎ। তঁার দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। তবে, এই পোড়া দেশে আরও কিছু প্রশ্নের মোকাবিলা নতুন সাংসদকে করতেই হবে। ‘ইন্টারভিউ’ ছবির শুরুতে দেখা যায়, লরিতে করে ট্রাকে তুলে ক্রেনের মাধ্যমে বাতিল করে আবর্জনায় ফেলে দেওয়া হতে থাকে ব্রিটিশ শাসক/শোষক কর্তাদের মূর্তি। উপনিবেশের করাল গ্রাসের বিরুদ্ধে ‘শিকড়সন্ধানী’, ‘অস্মিতাময়’ রাষ্ট্র প্রগতির সিদ্ধান্ত! এ তো রাষ্ট্রেরই পদক্ষেপ।
নইলে ময়দান থেকে মূর্তি তো সরানো হতে পারে না। তবে, এরপর কেন্দ্রীয় চরিত্র নানা ঝামেলায়, ‘ইন্টারভিউ’ দিতে যেতে বাধ্য হয় ধুতি-পাঞ্জাবি পরে। কোট-প্যান্ট এবং সাহেবি পোশাক না-পরায় চাকরি হল না। মৃণাল সেন যেন প্রশ্নটা জটিলতা-সহ তুলে আনলেন। শুধু কি উপনিবেশ-বিরোধিতায় বাহি্যকতা, বাইরে মুক্তি-সন্ধান? আত্মসন্ধানের গভীরতর তলে যে-অসুখ জড়িয়ে আছে, তাকে কে চিহ্নিত করবে? রাধাকৃষ্ণনের সরকারি নির্দেশিকা অনেকটা লরিতে করে সাহেবের মর্মরমূর্তি ছুড়ে ফেলার উচ্চনাদ ঘোষণা। ভাল কথা। তবে, ভিতরের মেকলে-পুরুষ আর সত্তার সাহেবভজা অন্ধত্ব ঘোচাবে কে?
বাহি্যকতায় আটকে যাবে না তো রূপান্তর প্রকল্প, মুক্তি সন্ধান? বিশেষত, এ-দেশে রাধাকৃষ্ণনের রাজনৈতিক পার্টি– (অন্যান্য প্রায় সব বামপন্থী পার্টিও) তাদের নামে ইংরেজি আদ্যক্ষর আর ব্রিটিশভাষা প্রাধানে্য লালিত। তারা কি উপনিবেশের ছায়া থেকে বেরনোর কথা ভাবছে? আদৌ ভেবেছে? ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট)’ নামের বিকল্প সন্ধান কি করবেন কে. রাধাকৃষ্ণন? কিংবা ধরুন ‘পলিটবু্যরো’ বা ‘চেয়ারম্যান’?