দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে শোনা গেল, আম্বেদকর মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন ‘বিদেশনীতি’ পছন্দ হয়নি বলে, ‘৩৭০ ধারার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ’ করে। এটি ইতিহাসের বিকৃতি। বি. আর. আম্বেদকর ক্যাবিনেট থেকে ইস্তফা দেন হিন্দু কোড বিল ভোটাভুটিতে পাস না-হওয়ার প্রতিবাদে। লিখছেন শতাব্দী দাস।
ভীমরাও রামজি আম্বেদকর প্রশ্নে সংসদীয় তরজা যখন সপ্তমে চড়েছে, তখন মনে হচ্ছে, এসব বিবাদ-বিসংবাদের ঊর্ধ্বে আবারও একা কুম্ভ রক্ষা করছেন বাবাসাহেব। স্ব-সময়ে তিনি এমনই একা ছিলেন যে, কংগ্রেস বা বিজেপি কেউই তঁাকে পরিপূর্ণভাবে ‘নিজের লোক’ বলে দাবি করতে পারেনি, এখনও পারে না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে ঘিরে বিবাদের সূত্রপাত। সে এমন বক্তব্য, যেখানে স্বরভঙ্গি আর বক্তব্যের সার দুই বিপরীত দিকে হঁাটা লাগিয়েছে। অমিত শাহ মুখে বলছেন, ‘তোমরা যারা আম্বেদকর-আম্বেদকর করে মালা জপছ, তারা-ই তো তঁাকে প্রথম ক্যাবিনেট মন্ত্রিসভা থেকে তাড়িয়েছ।’ কিন্তু বলার ভঙ্গি বিশ্বাসঘাতকতা করছে শব্দের সঙ্গে। ‘আম্বেদকর’ নামটি যখন তিনি উচ্চারণ করছেন, প্রতিবার শুধু বিরোধীদের প্রতি নয়, যেন আম্বেদকরের প্রতিও অবজ্ঞা ঝরে পড়ছে।
ইতিহাস খুঁড়লে দেখা যায়, বিজেপি-আরএসএস এই অবজ্ঞার ঐতিহ্য বহন করছে৷ এক শূদ্রের নির্দেশনায় যে সংবিধান গড়ে উঠেছিল, তাকে যে তারা ‘বিজাতীয়’, ‘অভারতীয়’ মনে করে, তা আরএসএসের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’ ১৯৪৯ সালের ৩০ নভেম্বরই জানিয়ে দিয়েছিল। তারা চেয়েছিল ‘মনুস্মৃতি’-র আদলে সংবিধান, যে ‘মনুস্মৃতি’-কে শূদ্রবিদ্বেষী ও নারীবিদ্বেষী দাগিয়ে আম্বেদকর ১৯২৭ সালে ঘটা করে পুড়িয়েছিলেন।
১৯৪৯ সালেরই ১২ ডিসেম্বর দিল্লির রামলীলা ময়দানে সনাতনীদের এক সভায় নেহরু ও আম্বেদকরেরও মূর্তি পোড়ানো হয়। সেক্ষেত্রে কারণটি নিহিত ছিল সংবিধানে নয়, ‘হিন্দু কোড বিল’-এ। ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ তঁার ‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী’ বইতে দিনটির বর্ণনা দিয়েছেন। স্বামী কর্পর্ত্রীজি মহারাজ নামের এক ব্যক্তি, যিনি ‘অখিল ভারতীয় রামরাজ্য সংঘ’-র প্রতিষ্ঠাতা, নাকি বলেছিলেন, ‘এক অস্পৃশ্য এখন দেশের নীতি ঠিক করছে, যা হওয়া উচিত ছিল ব্রাহ্মণদের কাজ!’ সেই ঘটনার ৭৫ বছর পর, অমিত শাহকে বলতে শোনা গেল,
আম্বেদকর মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন ‘বিদেশনীতি’ পছন্দ হয়নি বলে, ‘৩৭০ ধারার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ’ করে। সব শাসকই নিজের মতো করে ইতিহাস লেখে। কিন্তু এমন ডাহা মিথ্যা বলে ইতিহাস বিকৃতি ঘটানোর সাহস সম্ভবত একটি দলই পায়!
আম্বেদকর ক্যাবিনেট থেকে ইস্তফা দেন উক্ত হিন্দু কোড বিল ভোটাভুটিতে পাস না-হওয়ার প্রতিবাদে, যা পাস হলে, তিনি বলেছিলেন, ‘সংবিধান পাস হওয়ার চেয়েও বেশি খুশি হব।’ কী সেই হিন্দু কোড বিল? আম্বেদকরের মনে করতেন, সমাজের অভ্যন্তরীণ সংস্কার না-হলে, সব সাংবিধানিক অধিকার, অ-কার্যকর ও অর্থহীন হয়ে পড়বে। তাই স্বাধীনতার ঠিক পরে, গণপরিষদের কাছে ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে, আম্বেদকর বিলটি পেশ করেন। সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার, বহুবিবাহ রোধ, বিধবার পুনর্বিবাহে স্বীকৃতি, নারীর বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার, দত্তক নেওয়ার অধিকার, অসবর্ণ বিবাহের অধিকারের মতো বিষয়গুলি সেই বিলে ছিল। উদারনৈতিক নেহরু এই বিলের সমর্থক ছিলেন। গান্ধীও তা-ই।
বস্তুত, স্বাধীনতার আগে গান্ধী ও কংগ্রেসের সঙ্গে আম্বেদকরের সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক থেকেছে। দ্বৈরথ চরমে উঠেছিল তিনের দশকে৷ আম্বেদকরকে অস্পৃশ্যদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী এবং সংরক্ষিত আসনের আশ্বাস দেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড। গান্ধী মনে করতেন, এতে হিন্দুরা বিভক্ত হয়ে পড়বে। এটা ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতিরই সম্প্রসারণ। তিনি কারারুদ্ধ অবস্থাতেই অনশন শুরু করেন। আম্বেদকর জেলে গিয়ে দেখা করেন। দীর্ঘ তর্ক-বিতর্কের এক অংশে আম্বেদকর বলছেন, ‘আপনি কখনওই আমার অবস্থান বুঝবেন না। আজ আমি যতই বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে আসি, যতই রাজনৈতিক ক্ষমতা থাক, আমাকেও এ শহরে বন্ধুর বাড়িতে নয়, হোটেলে ঠঁাই নিতে হয়, কারণ আমি অস্পৃশ্য। আমারই যদি এ-ই অবস্থা হয়, আমার বর্ণের অন্য মানুষদের কী দশা, তা কী ভেবেছেন?’
অবশেষে সে যাত্রায় দ্বিগুণ আসনে যৌথ (সবর্ণ ও দলিত উভয়েই থাকবে) নির্বাচকমণ্ডলী মেনে নেয় দুই পক্ষই, ১৯৩২ সালে পুনা প্যাক্টের মাধ্যমে। গান্ধীর তরফে হয়তো এই ‘ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল’ ছাড়া গত্যন্তর ছিল না, কিন্তু আম্বেদকরের অনুভূত করুণ সত্যটি এখনও অকরুণ রাগে বাজে: ‘আপনি আমার অবস্থান বুঝবেন না।’
একজন সবর্ণ ও একজন দলিত মানুষের দৃষ্টিকোণ এক হওয়া যেন অসম্ভব, তাই দ্বৈরথ। আবার এ-ও সত্য যে, নেহরুকে সংবিধান ড্রাফ্ট কমিটির শিরে আম্বেদকরকে বসাতে নির্দেশ দেন গান্ধী। গান্ধীর সুপারিশেই তিনি দেশের প্রথম আইনমন্ত্রী হন।
ফিরি হিন্দু কোড বিল প্রসঙ্গে। নেহরু বা গান্ধীকে পাশে পেলেও কংগ্রেসের কিছু প্রাচীনপন্থী নেতা ছিলেন বিলের বিরোধী। যেমন, ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ বা জে. বি. কৃপালনি। অতিহিন্দু মানসিকতার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়দের বিরোধিতা তো ছিলই।হিন্দু মহাসভা, ভারতীয় জনসঙ্ঘ-সহ রক্ষণশীল হিন্দুগোষ্ঠীগুলি ‘হিন্দু পার্সোনাল ল’-র সংস্কারকে হিন্দু পারিবারিক কাঠামো ও তঁাদের ধর্মের প্রতি আক্রমণ হিসাবেই দেখলেন। শঙ্করাচার্যরা ফতোয়া দিলেন।
১৯৪৮ সালে বিল সিলেক্ট কমিটির কাছে যায়।
১৯৪৯ সালের নভেম্বরে সংবিধান চূড়ান্ত হয়, এবং ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে কার্যকর হয়। তখন বিল বাতিল হয়ে যায়। আম্বেদকর ১৯৫১ সালে নেহরুর সমর্থনে সংসদে বিলটি পুনর্দাখিল করেন। এই চাপের মুখে, এবং আসন্ন প্রথম জাতীয় নির্বাচন মাথায় রেখে, নেহরু তথা কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নেয়, কোনও পার্টি হুইপ জারি করা হবে না সদস্যদের জন্য। সংসদে তারা যে-যার ইচ্ছা মতো বিলের পক্ষে-বিপক্ষে ভোট দিতে পারে। বিল সংসদে হেরে যায়। আম্বেদকর ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৫১ সালে নেহরুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
কিন্তু নির্বাচনী প্রচারে বারবার হিন্দু কোড বিলের কথা নেহরু প্রচার করেছিলেন, জনসমর্থনও চেয়েছিলেন। প্রথম লোকসভায় হিন্দু কোড বিল অনেকাংশেই পাস হয় চারটি আলাদা-আলাদা আইনের মাধ্যমে। তখন হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট, হিন্দু সাকসেশন অ্যাক্ট, হিন্দু অ্যাডপশন অ্যাক্ট ইত্যাদি নাম হয় সেগুলোর। হিন্দু কোড বিল এক নারীবাদী স্বপ্নসন্ধান। গান্ধী হয়তো দলিতের অবস্থানে নেমে এসে ভাবতে পারেননি, কিন্তু আম্বেদকর নারীর অবস্থানে নেমে এসেই বস্তুগত, আইনি ও সামাজিক পরিসরে তাদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। সেদিন বিপক্ষে ছিলেন নানা দলের সনাতনীরা। এখন তঁারা কী অবতারে আছেন, তা চিনে নেওয়ার দায়িত্ব নাগরিকদের।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক
satabdiwrites@gmail.com