সবার এক পা ’২৪-এ। অন্য পা ’২৫-এর দিকে এগিয়ে। নববর্ষ নেমে এল মহাজাগতিক এক বর্শার ফলার মতো। হঠাৎই, সবার ফোনে বেজে উঠল এক কলার টিউন। হাড় হিম করা সংগীত। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে ঝিমিয়ে এল আলোগুলো। বিস্ফারিত চোখে, আতঙ্কিত মুখে জনগণ ঢুকে পড়ল অজানা ভবিষ্যতের সাম্প্রতিক গ্যালাক্সিতে। লিখছেন শুভময় মিত্র।
‘নব আনন্দে’ লিখে কেটে দিলাম। ‘আজি শরৎ তপনে...’, শিট! এখন চলবে না। ডিসেম্বরি ঋতু নিয়ে বাংলায় কিছু নেই? আসলে নতুন কিছু একটা লিখে ‘পোস্ট’ করার তালে ছিলাম। নিউ ইয়ারি উচ্ছ্বাসমাখা হাসি-খুশি কিছু পজিটিভ ভাইব। পারলাম না। শব্দঠাকুর আর টিএক্সকে টানাটানি করে আর কত দিন? তেমন বলার মতো, লেখার মতো, কিছু আছে কি? আবার এটাও ঠিক যে, বছরের-পর-বছর একই নববর্ষ হাজির হচ্ছে, তা নিয়ে নতুন লেখা হবে না-ই বা কেন? আমি পারছি না কারণ– রাতে এসব বেরয় না। প্রাতঃকালে অন্য কৃত্যের সমস্যা থাকে। কিন্তু লিখতে হবে। এখনই। নতুন প্ল্যান করলাম। চকোলেট মোমো বানাব। চমকাতে হবে, লিখলাম, ‘অবাক পৃথিবী’। তারপর বেরিয়ে পড়লাম।
একটা জ্যান্ত পৃথিবী গমগমিয়ে, গুজগুজিয়ে চলছে। বুঝতে পারছি। অথচ তাকিয়ে দেখছি না। বিগ মিসটেক। সারাক্ষণ মেজাজ খারাপ। কীসের যেন একটা ভয়। একজনকে চিনি, নববর্ষ ঘনিয়ে এলে সে খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়ত। তার আরও এক বছর বয়েস বেড়ে গেল বলে। তাকে বোঝানো হল, ‘৩১ ডিসেম্বর তো তোমার জন্মদিন নয়।’ শুনে বেজায় নিশ্চিন্ত হয়ে সে বো ব্যারাকের পাশে বড়ুয়ার দোকানে কেক কিনতে চলে গেল। আমিও নিজেকে বোঝালাম। সিনে নামতে হবে। স্ক্রিন ঘেঁটে লাভ নেই। চলে গেলাম পার্ক স্ট্রিট। সঠিক সিদ্ধান্ত। আলো কিশমিশ করছে। চলছে খ্রিস্টমেলা। বর্ষবরণ পালা। কিছু একটা হচ্ছে। কী, তা দেখতে সবাই চলেছে কনুইয়ের গুঁতো খেতে খেতে, বেলুন, ভেঁপু বাজাতে-বাজাতে, আলোয় লাল হয়ে ওঠা সিং নেড়ে। নতুন কিছু আছে নিশ্চয়ই, বা হবে, সেই বিশ্বাসে। সবাই সান্টা ক্লজ। অথবা বান্টা সিং। বা জিনত আমন। কিন্তু কৌশিকী নন। গণধাক্কা আর সম্ভাব্য নব আনন্দের চুম্বক আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকল।
কাউকে চিনি না। আমি সবাইকে দেখতে পাচ্ছি। কেউ আমাকে নয়। কানে এল, ‘পয়লা থেকে সব বদলে যাচ্ছে কিন্তু।’ কান খাড়া হল। ‘সমস্ত মাল্টি-স্টোরিডের নির্মাণ এবার শুরু হবে ছাদ থেকে। তারপর নামতে থাকবে। রিভার্স টেকনিক। এতে সুবিধে হল, ইললিগাল কনস্ট্রাকশন হলে কর্পোরেশন মাঝপথে টপ ফ্লোর কখনওই ভাঙতে পারবে না। রেডি বাড়িটা ল্যান্ড করবে ভিতের জমিতে।’ গুড আইডিয়া। ‘ট্রাম প্রায় উঠে যাচ্ছিল। এখন ট্রাম চালানো হবে তারে ঝুলিয়ে। তলায় থাকবে কার পার্ক। হকার। সুলভ। যদিও খসে পড়ার ভয়ে কেউ-ই সেখানে এসে জুটবে না। বাগান করা যাবে। যাই হোক, কলকাতার একটা সেন্টিমেন্টাল হেরিটেজ বলে কথা। মাটির তলায় ঝিনচ্যাক মেট্রো দেখতে পাবে না, ভাবতেও পারবে না যে, সম্মান ছিনিয়ে নেওয়া ট্রামের মাটিতে আর পা-ই পড়ছে না।’ রিকশার কোনও খবর আছে? ‘সব রিকশা হয়ে যাচ্ছে প্রাইভেট। তবে লিমিটেড। সেল্ফ ড্রিভেন। বাজার যাবেন? নিজের রিকশা টেনে চলে যান। যেভাবে এয়ারপোর্টে ট্রলি স্যুটকেস নিয়ে হঁাটেন। পার্কোম্যাটে নয়, রাখবেন রিস্কোম্যাটে।’ রিকশাচালকদের কী হবে?
সে কী! জানেন না? ওরা পার্কে বেলুন ওড়াবে। উঠবে-নামবে, এদিক ওদিক চলে যাবে না। নাগরদোলা স্টাইল। বুঝতে হবে যত গোলমাল নিচে, ওপরে তো দেদার গড়ের মাঠ।
নতুন এন্টারটেনমেন্ট।’ ভাগ্যিস বেরলাম! কত কী হচ্ছে। অটোগুলো খুব অসভ্য। এনি স্টেপ বিয়িং টেকেন? ‘ইয়েস ইয়েস, কোনও অটো আর অটো থাকবে না। ম্যানুয়ালি চালাতে হবে। বাধ্যতামূলক।’ আগের ব্যাপারগুলো জলের মতো সহজ। এইটা বুঝতে পারলাম না। ফান্ডার এই ফ্লুইড আইডিয়াটা মাথার উপর ঝুলে রইল শীতের কুয়াশার মতো। উপরে তাকালাম। আকাশ দেখা যাচ্ছে না। ঢাকা পড়েছে লক্ষ-লক্ষ ভ্যানগঘি নীল-সাদা আলোর চুমকিতে। লাল আলো মঙ্গল স্পট। তা-ও আছে।
ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটে পৌঁছে আর এগতে পারলাম না। ব্যারিকেড নেমেছে। পুলিশ যেতে দেবে না। এটা নাকি ডাউন ফুটপাথ। রাস্তার উল্টোদিকে আপ। বুঝলাম, অপর দিকে আমোদ পেতে হলে ফিরে যেতে হবে সাপ-লুডোর প্রথম ঘরে। রাস্তা পেরিয়ে ফের শুরু করতে হবে। নতুন কনসেপ্ট। বেজায় খাপ্পা হয়ে পুলিশকে ‘রাস্তা কি আপনার বাপের?’ এসব বলে কিছু লোক চেঁচামেচি করে আনন্দের স্রোতে চোনা ফেলার চেষ্টা করছিল। শান্ত, মার্জিত স্বরে রাত রাস্তার আসল মালিক সানগ্লাস পরা সার্জেন্ট বললেন, ‘আপনাদের সুবিধার্থেই এই ব্যবস্থা। মনে রাখবেন, আমরা আপনাদেরই একজন। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, ভীষণ চাপ।’ অগত্যা বঁা দিকে ঘুরলাম। সুবেশ, সুবেশা, মেক-আপের আড়ালে বিষণ্ণ মোনালিসা, স্যুট-বুটের উপর লাল-সাদা মাঙ্কি ক্যাপ পরা সম্পন্ন অথচ নিশ্চিতভাবে শোকার্ত মানুষজন দঁাড়িয়ে আছে অসহায়ভাবে।
বছরের শেষ রাতে দু’টি ভাল খাবে, পিবে, তাই এসেছে। ঔরঙ্গজেবি মেজাজের দ্বাররক্ষীর কৃপা হলে মিলছে রেস্তোরঁায় প্রবেশের অনুমতি। কাচের জানালার ভিতর ভিনিশিয়ান রেখা পর্দার আড়ালে দেখতে পাচ্ছি, যারা একবার ঢুকে পড়েছে, তাদের বেরনোর কোনও ইচ্ছে নেই। দাম খাবারের। সময়ের কোনও দাম নেই। এই ধরনের জায়গায় ঢুকে সাহেবি খাওয়াদাওয়ার ব্যাপার নেই আমার। কিন্তু আজ, থার্টি-ফার্স্টে, আমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে লাগলাম অস্থির রাজপথে কিছু এলিট দুর্ভাগার মর্মান্তিক স্থবিরতা।
হঠাৎ আমার কোমরে তুমুল খোঁচা। সেলুদা! চেনা লোক। খোঁচাটা সে-ই দিয়েছে নিজের
ফোন দিয়ে। দিয়েই আমাকে স্ক্রিনটা দেখাল। দেখি আমার প্রোফাইল পিক। সেলুদার নতুন ইনভেনশন। আইটি-র প্রথম আমলের ওস্তাদ। টেলি কমিউনিকেশনের অবসরপ্রাপ্ত বস। ‘আমার ফোন আইডেনটিটি সেন্স করতে পারে। তোরা পারিস না। এজন্যই তোদের এত ক্রাইসিস। তোরা নিজের ব্যাকডেটেড বুদ্ধিতে মানুষ চেনার বৃথা চেষ্টা করিস। অথচ আমরা কেউই আর মানুষ নেই।’ কথায় কথা বাড়ে। দৌড়ে পালিয়ে যাব তার উপায় নেই। বলতে গেলাম ‘যাই হোক, ভাল দিনে দেখা হয়ে গেল, আচ্ছা, হ্যাপ্প...’। কথা শেষ করার সুযোগ পেলাম না। সেলুদা তার ফোন দিয়ে আমার মুখটা চেপে ধরেছে। ‘এখনও হয়নি সময়। হবে।’ ভিড়, পুলিশের মধ্যে দিয়ে মাখন কাটা ছুরির মতো সে এগিয়ে গেল আমাকে নিয়ে। রাস্তা পেরিয়ে গেলাম। ‘সারা জীবন মনে রাখবি আমাকে। ভুলবি না যে দেখা হয়েছিল, বুঝলি।’
কথাগুলো হুমকির মতো শোনাচ্ছিল। এটা সত্যি যে, এসব সহ্য করা শক্ত, কিন্তু ভীষণ ইন্টারেস্টিং লোক। সবসময় নতুন ব্যাপার। অভাবনীয় সব চমক। আজ কী করবে, কী বলবে কে জানে। একগাদা গোলাপ ফুল এনে বিক্কিরি করার চেষ্টা করছিল একটা বাচ্চা। অনেকেই কিনছিল। ফিল্মি কায়দায় পোজ দিচ্ছিল। আমার কাছে এসে কেউ ঘ্যানঘ্যান করল না। ‘তোরা ভাবিস এরা ড্রাগ অ্যাডিক্ট। ডোপ্ড। ভুল জানিস। এই যে চারপাশে যত লোক দেখছিস, তারা নেশায় ডুবে আছে। সব গিলছে। কিন্তু খাচ্ছে না। স্ক্রোল করার চেষ্টা করছে, সময়কে রিফ্রেশ করার তাল, বিলিভিং, পরের মুহূর্তে অন্য কিছু হবে। অ্যামেজিং কিছু।’
সেলুদা ফোনের মতো দেখতে আর-একটা কী যেন বের করে কী সব করতে লাগল। উঁকি মেরে দেখলাম, প্রোগ্রাম লিখছে। স্বগোতক্তির মেজাজে বলল, ‘ছুটিয়ে দেব নেশা। নতুন বছরটা পড়তে দে। গদাম করে পড়বে মাথায়। ইমপ্যাক্টে বিগ ব্যাং থিওরি ঢুকে যাবে ঘিলুতে।’ সত্যি বলতে কী বর্ষশেষ ও শুরুর সন্ধিপুজোয় সুখের কারণ নেই। রাগেরও কিছু নেই। চুপ করে রইলাম।
আশপাশের লোকজন ফোনে ঘড়ি দেখছে। তার মানে সময় হয়ে গিয়েছে। ঘণ্টা বাজবে। হ্যা-হ্যা হি-হি হ্যাপ-পিহ নিউ ইয়ার বলে জড়ামড়ির কারবার চলবে। উত্তাল জনসমুদ্রের মধ্যে পার্ক স্ট্রিটের এক অদৃশ্য দ্বীপে আমরা দু’জন দঁাড়িয়ে আছি একজোড়া নারকেল গাছের মতো। এল সেই প্রতীক্ষিত সময়। যে-মুহূর্তের জন্য সারা বছর এত মানুষ উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করে আছে। সবার এক পা ’২৪-এ। অন্য পা ’২৫-এর দিকে এগিয়ে রেখেছে। নববর্ষ নেমে এল মহাজাগতিক এক বর্শার ফলার মতো। সেলুদা একটা বোতাম টিপল। হঠাৎই, একসঙ্গে সবার ফোনে বেজে উঠল একই কলার টিউন। হাতের মুঠোয় হাড় হিম করা এমন হর্র সংগীত কেউ শোনেনি আগে। কোনওভাবে, কেউ-ই থামাতে পারল না তাকে। নিজেই থামল। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। ঝিমিয়ে আছে আলোগুলো। বিস্ফারিত চোখে, আতঙ্কিত
মুখে জনগণ ঢুকে পড়লো অজানা ভবিষ্যতের সাম্প্রতিক গ্যালাক্সিতে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড। আবার ঝিকমিক করে উঠল সমস্ত আলো। ঝুমঝুমিয়ে উঠল সময়ের সাক্ষী আপ্লুত মানুষজন। ‘টেরিবলি বিউটিফুল সারপ্রাইজ ইট ওয়াজ। ওয়াও!’