সংখ্যালঘু বিরোধিতাকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিতে হিন্দি বলয়ের নবতম সংযোজন হিন্দুত্ববাদী পপ মিউজিক। সেখানে কদর্য তো বটেই, রীতিমতো হিংস্র ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে সংখ্যালঘুদের। লিখছেন অর্ণব সাহা।
এপ্রিল ২০১৭। দক্ষিণ ঝাড়খণ্ডের এক ছোট্ট শহর গুমলার সর্পিল অলিগলি বেয়ে এগিয়ে চলেছে রামনবমীর মিছিল। সমগ্র উত্তর ও মধ্য ভারতের হিন্দি বলয়ে এই ধরনের মিছিলের কয়েকটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। গুমলার মিছিলটিও তার ব্যতিক্রম নয়। মাথায় গেরুয়া ফেট্টি, কপালে তিলক, হাতে বিভিন্ন আকৃতির অস্ত্র নিয়ে উন্মত্ত মানুষের স্রোত। কিন্তু তাদের সঙ্গেই রয়েছে এক বা একাধিক ম্যাটাডর, যাতে ডিজে-সহযোগে বেজে চলা উদ্দাম গানের আওয়াজ, যা মিছিলকে উত্তেজিত রাখবে।
একটু কান খাড়া করে, খুঁটিয়ে, সেসব গানের কথার সঙ্গে পরিচিত হলে শিউরে উঠতে হয়। স্থানীয় স্টুডিওয় রেকর্ড করা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় শিল্পীদের গাওয়া এই উগ্র গানগুলিকেই বলা যেতে পারে ‘হিন্দুত্ববাদী পপ মিউজিক’। অত্যন্ত চড়া দাগের ভাষায় হিন্দুত্ব রাজনীতির সপক্ষে প্রোপাগান্ডা– যেখানে শত্রু সুনির্দিষ্টভাবে ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। গানের ছত্রে ছত্রে সংখ্যালঘু, দেশের শাসক দল ও সংঘ পরিবারের বিরোধীদের উদ্দেশে নগ্ন ঘৃণা-ভাষণ এর বৈশিষ্ট্য।
[আরও পড়ুন: ‘টুম্পা সোনা’র পর এবার ‘ডিম পাউরুটি’, ব্রিগেড ভরাতে নয়া প্যারোডিতে ভরসা বাম যুবদের]
গুমলার মিছিলটি সেদিন স্থানীয় জামা মসজিদের সামনে গিয়ে দঁাড়াতেই হঠাৎ বেজে উঠল একটি গান– যার মর্মার্থ– ‘মোল্লাদের মাথা কেটে ওদের টুপিগুলো মাটিতে মিশিয়ে দাও।’ ভিড় আকস্মিকভাবেই হিংস্র হয়ে ওঠে। মসজিদের লোকজন ত্রস্ত হয়ে ওঠে। পুলিশের দ্রুত হস্তক্ষেপে ঝামেলা সাময়িকভাবে ধামাচাপা পড়লেও পুরোটা মেটে না। ঠিক ওদিনই রামনবমীর মিছিল ফেরত কিছু হিন্দু যুবক দেখতে পায়, তাদের অত্যন্ত পরিচিত এক মুসলিম যুবক মোহাম্মদ সালিক, পাশের গ্রামের এক হিন্দু তরুণীর সঙ্গে রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছে। তারা এই দৃশ্যটিকে ‘লাভ জেহাদ’ হিসাবে চিহ্নিত করে। মুসলিম ছেলেটিকে ইলেকট্রিক পোলের সঙ্গে বেঁধে নির্মমভাবে পেটাতে থাকে। সেই রাতেই গুমলা সদর হাসপাতালে সালিকের মৃত্যু হয়।
বিগত এক দশকে এ-ধরনের অসংখ্য ঘটনার সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি। তর্ক করেছি, মতামত দিয়েছি, যে-যার নিজস্ব অবস্থানে দঁাড়িয়েই গত সাড়ে চার দশকের ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বুঝিনি– যে সাতটি রাজ্যকে আমরা ‘হিন্দি বলয়’ বলি এবং যে বিরাট অঞ্চলটিতে ভারতীয় জনতা পার্টি ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে, সেই বাস্তবের মাটিতে সংঘ-পরিবারের অসংখ্য শাখাপ্রশাখা কীভাবে জনসংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম কৌশলে ব্যবহার করে নিজেদের পক্ষে গণসম্মতি গড়ে তুলছে। এই সস্তা ইন্টারনেটের যুগে সামাজিক মাধ্যমগুলিকে ব্যবহার করে তারা মানুষের মগজে গেঁথে দিচ্ছে হিন্দুত্ববাদী পপ সংগীত, জনপ্রিয় কবিতা ও সহজতম ভাষায় লেখা একমাত্রিক গল্পের বইপত্র। আর এই জনসংস্কৃতির মাধ্যমগুলিই এখন সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ, ঘৃণাভাষণ, মিথ্যা কাল্পনিক ‘অপর’ ও ‘শত্রু’ নির্মাণের হাজারটা তরিকা সমেত গড়ে তুলেছে হিন্দুত্ব-প্রচারের এক অভিনব ইকোসিস্টেম, যার হদিশ ভারতের শিক্ষিত, নাগরিক, লিবারাল মানুষজনের কাছে সম্পূর্ণ অধরাই থেকে গিয়েছে।
[আরও পড়ুন: প্রথম স্ত্রীর সামনেই দ্বিতীয় স্ত্রী কিরণকে চুমু, মেয়ের বিয়েতে ভাইরাল আমিরের কীর্তি! হতবাক নেটপাড়া]
জনসংস্কৃতি বিষয়টা কাজ করে মানুষের ‘কমন সেন্স’ বা ‘সাধারণ বোধ’-এর জায়গাকে ব্যবহার করেই। যেমন ধরা যাক, মাত্র ২৫ বছর বয়সি হরিয়ানভি যুবতী হিন্দুত্ববাদী পপ-গায়িকা কবি সিংয়ের একটি গান– ‘অগর ছুঁয়া মন্দির তো তুঝে দিখা দেঙ্গে/ তুঝকো তেরি অওকাত বাতা দেঙ্গে/ ইধার উট্ঠি যো অঁাখ তুমহারি/ চমকেগি তলওয়ার কাটারি/ খুন সে ইস ধরতি কো নেহ্লা দেঙ্গে/ হম তুঝকো তেরি অওকাত বাতা দেঙ্গে/ বন্দে মাতরম্ গানা হোগা/ ওয়ার্না ইঁহা সে যানা হোগা/ নেহি গয়ে তো জবরান তুঝে ভাগা দেঙ্গে/ হাম তুঝকো তেরি অওকাত বাতা দেঙ্গে’।
এছাড়া সংখ্যালঘুরা ‘গরুখোর’, তারা চারটে বিয়ে করে আর গন্ডায় গন্ডায় সন্তান উৎপাদন করে দেশের জনবিন্যাস বদলে দিচ্ছে, তারা ভারতকে নিজের দেশ বলে মনে করে না, ‘ভারতমাতা’ নয়, পাকিস্তান তাদের কাছে বেশি আপন– এহেন খুল্লামখুল্লা প্রচার তো আছেই। একটি গানে সরাসরি গান্ধী-হত্যাকে সমর্থন করা হচ্ছে এবং নাথুরাম গডসেকে অমর ‘শহিদ’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। পরিষ্কার বলা হচ্ছে, ‘অগর গডসে কি গোলি উতরি না হোতি সিনে মেঁ/ তো হর হিন্দু পড়তা নামাজ, মক্কা আউর মদিনা মেঁ/ মূক অহিংসা কে কারণ ভারত কা অঁাচল ফাট যাতা/ গান্ধী জীবিত্ হোতে তো ফির দেশ দোবারা বাট যাতা’।
সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক গালগল্পকে হিন্দুর শৌর্যময় অতীতের প্রমাণ হিসাবে পেশ করে পরিবেশন করা হচ্ছে। যেমন– যোগরাজ সিং গুর্জর নামের এক হিন্দু রাজাকে নিয়ে বঁাধা হয়েছে গান, যেখানে বলা হচ্ছে, তিনি নাকি তৈমুর লংয়ের বাহিনীকে হরিদ্বারে রুখে দিয়েছিলেন। মুসলিম মানেই প্রায় দানবিক এক অস্তিত্ব, যাদের আটকে দিতে, ‘হাম বচ্চে খুব বনায়েঙ্গে/ যব সংখ্যা হুয়ি হামসে জাদা/ ফির আপনি বাত মানায়েঙ্গে’– এই সংকল্প বারবার ঘোষিত হচ্ছে এসব গানে-কবিতায়। আর সস্তা প্রিন্টে ছাপা গল্পের বইয়ে ভিড় করছে ‘লাভ জিহাদ’, ‘ল্যান্ড জিহাদ’, ইসলামিক সন্ত্রাসের হাড়হিম করা মনগড়া হাজারো কাহিনি, যা খুব সহজেই মানুষকে স্পর্শ করে।
আরও লক্ষণীয়, এই পুরো প্রক্রিয়ায় কোথাও ভারতীয় জনতা পার্টির চেনা নেতা-মন্ত্রীরা সামনে থেকে উপস্থিত নেই। উত্তরপ্রদেশে এরকমই এক কবিকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। তিনি টাকাটা সরকারকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, সরকার যেন সেই টাকায় বুলডোজার কেনে (যাতে বিরোধী মুসলিমদের ঘরবাড়ি আরও বেশি গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়)।
সেই বিশ শতকের প্রথম দিক থেকেই ইউরোপ, আমেরিকায় অতি দক্ষিণপন্থী সরকারগুলি ক্ষমতায় এসেই জনসংস্কৃতিকে ঠিক একই প্রক্রিয়ায় নিজেদের ঘৃণার ভাবাদর্শ প্রচারের কাজে ব্যবহার করেছিল। ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকার উগ্র দেশপ্রেম প্রচারের মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছিল থিয়েটারকে। জার্মানিতে নাৎসিরা সমস্ত বিরোধী লেখকের বই পোড়ানোর পাশাপাশি সিনেমা, পপ মিউজিক, শয়ে শয়ে পুস্তিকা ছাপিয়ে নিজেদের মতাদর্শ প্রচার করেছিল।মার্কিন সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সপক্ষে জনমত সংগঠিত করতে সাহায্য নিয়েছিল ‘ওয়াল্ট ডিজনি’ ও ‘ওয়ার্নার ব্রাদার্স’-এর মতো বৃহৎ ফিল্ম কোম্পানির।
অতি সম্প্রতি, নয়ের দশকে, আফ্রিকার রোয়ান্ডায় ক্ষমতাসীন হুটু উপজাতির শাসকরা সংখ্যালঘু টুটসিদের গণহত্যা করার কাজে লাগায় দু’টি রেডিও চ্যানেলকে। আট লক্ষ টুটসি মানুষ মারা যায়। মায়ানমারে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জুন্টা একইভাবে রোহিঙ্গাদের হত্যা ও দেশ থেকে বহিষ্কারের কাজে ব্যবহার করেছে পপ মিউজিককে। একই কাজ ইসলামিক স্টেট ও আল কায়দার মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনও করে চলেছে লাগাতার। রামচন্দ্র গুহ এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে বোঝাতে ‘প্যারানয়েড ট্রায়াম্ফালিজম’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। এখন হিন্দুত্ববাদী পপ মিউজিক সেই ‘বিজয়ীর মনোবিকার’ প্রকাশের অন্যতম অস্ত্র হয়ে উঠেছে ভারতে।
(মতামত নিজস্ব)