১৯৪২-’৪৬ সালের মধ্যে ভাইসরয়ের কাউন্সিলের সদস্য (শ্রম) হিসাবে বিআর আম্বেদকর ভারত জুড়ে নারীদের জন্য খনিতে মাতৃত্ব-সুবিধা বিল আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই আইনের অধীনে, খনিতে কাজ করা একজন নারী, আট সপ্তাহের জন্য মাতৃত্বকালীন সুবিধা পাবে। ‘আরবিআই’ স্থাপন থেকে কর ব্যবস্থা– বিবিধ সংস্কারের মূল হোতা তিনি। আজ তাঁর জন্মদিন। লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।

ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের কথা বললে মূলত ভারতের সংবিধান প্রণয়ন এবং দলিত বা পিছিয়ে পড়া মানুষের অধিকারের ব্যাপারে তাঁর অগ্রণী ভূমিকার কথাই উঠে আসে। আলোচনায় থাকে না আম্বেদকরের অর্থনৈতিক ভাবনার দিকটি। তবে দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে তঁার অবদানের কথা ভুলে যাওয়া অনুচিত।
তিনি বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ এলফিনস্টোন কলেজে ভর্তি হন, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের মতো মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। আম্বেদকর প্রথম ভারতীয়– যিনি বিদেশে– অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর ডক্টরাল থিসিস ‘ভারতের টাকা’ (The Indian Rupee) যা ১৯২২-’২৩ সালে লেখা হয়েছিল, পরে ‘টাকার সমস্যা: এর উৎস এবং এর সমাধান’ (The Problem of the Rupee: Its Origin and its Solution) নামে বই হিসাবে প্রকাশিত হয়। সেই সময় সোনার বিনিময়-হারের অস্থিরতার নিয়ে জন মেনার্ড কেইন্স এবং অন্যান্য অর্থনীতিবিদের মতের বিপক্ষে গিয়েছিলেন তিনি। স্বর্ণ বিনিময়-মান ধার্য করা ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য ব্যয়বহুল। তিনি তথ্য সহযোগে তুলে ধরেছিলেন, কীভাবে ভারতীয় টাকার মূল্য হ্রাস হচ্ছে এবং ফলস্বরূপ ক্রয়ক্ষমতা কমছে। তাঁর পরামর্শ ছিল– বিনিময় হার স্থিতিশীলতার চেয়ে মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতার উপর অধিক নজর দেওয়া উচিত।
ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গঠনের ধারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল আম্বেদকরের। তিনি ভারতীয় মুদ্রা ও অর্থ-সংক্রান্ত রয়্যাল কমিশনের (হিল্টন ইয়ং কমিশন) কাছে তাঁর মতামত উপস্থাপন করেন, যেখানে তিনি দেশের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সপক্ষে যুক্তি দেন। তাঁর মতামত কমিশনের সুপারিশগুলিকে প্রভাবিত করেছিল, যার ফলে পরে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের (আরবিআই) প্রতিষ্ঠা হয়। আম্বেদকরের ধারণা হয়েছিল, জাতিভেদ ব্যবস্থা ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। দক্ষতার সামাজিক গতিশীলতা নিষিদ্ধ করার ফলে অনেক দক্ষ পেশাদারের উন্নয়ন বাধাপ্রাপ্ত হয়। অন্যদিকে, জাতিভেদ ব্যবস্থা শুধু শ্রমের বিভাজন নয়, শ্রমিকদেরও বিভাজিত করে। পেশাগত দিক থেকে স্বাধীনতার অভাব বেকারত্বের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জাতিগত পেশা না পেলে বেকারত্বের বশ্যতা স্বীকার করতে হত বেশিরভাগকে। শ্রম, পুঁজি এবং উদ্যোগের মধ্যে জাতিভিত্তিক আন্তঃপেশাগত প্রবাহের উপর নিষেধাজ্ঞার কারণে শ্রম ও পুঁজি– এক পেশা থেকে অন্য পেশায়– প্রবাহিত হয়নি। ফলে, আম্বেদকর যুক্তি দিয়েছিলেন– ভারতে মানব পুঁজির ধারণাটি একপ্রকার অকার্যকর– যত দিন না গরিব ও অত্যাচারিত অব্যবহৃত দলিতদের– অন্য শ্রেণিরা– সমান সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসাবে স্বীকৃতি না দেয়।
আম্বেদকরের মতে, ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে আর-একটি ক্ষতিকর দিক ছিল, নারীদের দারিদ্র্যপূর্ণ অর্থনৈতিক অবস্থান। নারীদের সামাজিক অবস্থানের উন্নতি না হলে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে পারে না বলে তিনি নিশ্চিত করেছিলেন। তাদের সমান অধিকার ও পেশার স্বাধীনতা প্রদান করার পক্ষে ছিলেন বাবাসাহেব। ছিলেন নারীদের মাতৃত্বের সুবিধা এবং সমান মজুরি প্রাপ্তির সমর্থক। ১৯৪২ থেকে ’৪৬ সালের মধ্যে ভাইসরয়ের কাউন্সিলের সদস্য (শ্রম) হিসাবে তিনি ভারত জুড়ে নারীদের জন্য খনিতে মাতৃত্বকালীন সুবিধা বিল আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই আইনের অধীনে, খনিতে কাজ করা একজন নারী, আট সপ্তাহের জন্য মাতৃত্বকালীন সুবিধা পাবে। ওই পদে থাকাকালীন আম্বেদকর কাজের সময় কমিয়ে অাট ঘণ্টার কর্মদিবস করার প্রথম প্রস্তাব রাখেন।
অবশেষে, আইন প্রণয়নের মাধ্যমে তা সম্পূর্ণ হয়। ১৯৪৮ সালের ফ্যাক্টরি আইনের ৫৪ ধারায় শ্রমিকদের ৯ ঘণ্টা কাজ এবং মাঝখানে বিশ্রামের জন্য আধ ঘণ্টা বিরতির সময় ধার্য করা হয়েছিল– যেখানে ৫১ ধারায় সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজের সময়সীমা সীমাবদ্ধ করা হয়। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পকর্মীদের জন্য ‘লিঙ্গ নির্বিশেষে একই কাজের সমান বেতন’ এমন ধারণাটি এনেছিলেন।
আবার দেশের উন্নয়নে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতির ভূমিকাও কল্পনা করেছিলেন আম্বেদকর, যা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক প্রমাণিত হয়। বিশ্বাস করতেন, নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পরিবার পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, কারণ খেতে কাজ করা নারীদেরও অনেক সন্তান থাকে। বাবাসাহেব ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে শোষণের বহুমাত্রিক প্রভাবের উপর গুরুত্ব দেন। সুতরাং, শোষণ নির্মূলকরণ ছিল আম্বেদকরের দেশের অর্থনৈতিক কৌশলের প্রস্তাবনার কেন্দ্রীয় বিষয়।
১৮৩৩ থেকে ১৯১৯ সালের মধ্যে ব্রিটিশ উপনিবেশে (রাজকীয় ব্যবস্থার অধীন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) ভারতের কর কাঠামো, জনব্যয় এবং জনসাধারণের ঋণ– যা দেশের ফেডারেল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য একটি ‘মডেল’ হিসাবে কাজ করেছিল এবং তাত্ত্বিক ও কার্যকর উভয় দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল– তা নিয়ে ছিল আম্বেদকরের স্বাধীন গবেষণা। ভারতীয় অর্থ কমিশন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ছিল তঁার অনুপ্রেরণা। আম্বেদকর ১৯৩৬ সালে ‘স্বাধীন শ্রমিক পার্টি’-র ম্যানিফেস্টোতে করের বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি জমি রাজস্ব ব্যবস্থা এবং করের বিরুদ্ধে ছিলেন– কারণ এগুলি সমাজের সবচেয়ে দুর্বল গোষ্ঠীগুলির উপর ভারী বোঝা চাপিয়ে দেয়। প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ব্যক্তিগত কর, নাগরিকের কর দেওয়ার ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত, তার মোট আয়ের উপর নয়। করের হারগুলো প্রগতিশীল হওয়া উচিত যাতে ধনীদের উপর বেশি এবং দরিদ্রদের উপর কম কর আরোপ করা যায়।
বাবাসাহেবের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সামাজিক সংস্কারের উপর নির্ভরশীল। মোটের উপর খানিক মিল থাকলেও তিনি নেহরুর সমাজতন্ত্রের আদর্শ থেকে বেশ কিছুটা ভিন্ন মত পোষণ করতেন। আবার, গান্ধীজির সঙ্গে বিস্তর মতপার্থক্য ছিল। গ্রামকেন্দ্রিক অর্থনীতির কুটিরভিত্তিক শিল্পের উপর অতিরিক্ত জোর দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন আম্বেদকর। নগরকেন্দ্রিক এক্সপোজার এবং যন্ত্রচালিত কারখানার আকারে শিল্প উদ্যোগকেই সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জন্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উপায়
হিসাবে দেখেছিলেন।
শিল্পায়ন ও নগরায়নের পক্ষে কথা বললেও পুঁজিবাদের কুফল সম্পর্কেও সতর্ক করেছিলেন তিনি। যুক্তি দিয়েছিলেন যে, অবাধ পুঁজিবাদ নিপীড়ন ও শোষণের শক্তিতে পরিণত হতে পারে। নিজের সমসময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। তঁার নজরে পড়েছিল– সরকারের অর্থনৈতিক অদক্ষতা সমাজের দরিদ্র অংশকে যেমন প্রভাবিত করে, তেমনই মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে মুদ্রার অস্থিতিশীল অবস্থা অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রাস্ফীতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। আম্বেদকর অনুভব করেছিলেন, গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় জনগণকে তাদের তহবিল এবং তার ব্যবহার সম্পর্কিত বিধান সম্পর্কে জ্ঞাত থাকতে হবে। আমাদের দেশে এটাই সময়ের দাবি, বিশেষ করে যখন ভারতে জনসাধারণের অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিতর্ক এবং দুর্নীতি প্রচুর।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
sidmukh12@gmail.com