‘লালমোহন গাঙ্গুলি’ বা ‘জটায়ু’ মানেই–সন্তোষ দত্ত। কিন্তু সত্যজিৎ কেন একমাত্র সন্তোষ দত্তকেই ‘জটায়ু’ চরিত্রে ভেবেছিলেন?
সত্যজিৎ রায়ের ‘ফেলুদা’ উপন্যাসের এক অসামান্য বাঙালি চরিত্র লালমোহন গাঙ্গুলি, যে ‘জটায়ু’ ছদ্মনামে লেখে ডিটেকটিভ উপন্যাস। ফেলুদা সিরিজের ‘সোনার কেল্লা’ উপন্যাসেই ফেলুদা আর তপসেকে নিয়ে ট্রেন যখন ঢুকছে উত্তরপ্রদেশ পেরিয়ে রাজস্থানে, লালমোহন ওরফে জটায়ুর আবির্ভাব হল ফেলুদা ও তপেশরঞ্জনের জীবনে, এবং বাঙালির জীবনেও। তবে সত্যি-সত্যি বাঙালির জীবনে জীবন্ত হয়ে উঠল লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ু ১৯৭৪ সালে, সত্যজিৎ তঁার ‘সোনার কেল্লা’ উপন্যাস থেকে সিনেমা করার পরে।
‘সোনার কেল্লা’ এবং ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’– সত্যজিৎ রায়ের এই দু’টি ছবিতে সন্তোষ দত্ত (Santosh Dutta) অভিনয় করলেন জটায়ুর চরিত্রে। এবং জটায়ু ও সন্তোষ দত্ত বাঙালির ঘরে-ঘরে হয়ে উঠল সমার্থক শব্দ। লালমোহন গাঙ্গুলি বা ‘জটায়ু’ বলতে বাঙালি সন্তোষ দত্তকেই ভাবে। যে-চরিত্রকে সন্তোষ দত্ত রক্তমাংসে জ্যান্ত করে তুলেছিলেন। পরবর্তী কালে ডিটেকটিভ গল্পের লেখক জটায়ুর চরিত্রে আরও অনেকেই অভিনয় করেছেন, কিন্তু জটায়ুর চরিত্রে সন্তোষ দত্ত অদ্যাবধি অবিকল্প।
১৯৮৮ সালে সন্তোষ দত্ত মারা গেলেন মাত্র ৬৩ বছর বয়সে। ৮ ফেব্রুয়ারি তঁার মৃত্যুদিনে অামহার্স্ট রো-তে তঁার বাড়ির সামনে দঁাড়িয়ে সত্যজিৎ রায় বললেন, ‘সন্তোষ চলে গেল, আমি আর ফেলুদা করব না।’ তিনি সন্তোষের কোনও বিকল্প খুঁজে পাননি। ফেলুদাও করেননি। মিলিয়ন ডলার প্রশ্নটা হল, কেন সত্যজিৎ তঁার জটায়ু চরিত্রে সন্তোষ দত্ত ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারেননি? এমনকী, তঁার গল্পের ইলাস্ট্রেশনে যখনই সত্যজিৎ এঁকেছেন জটায়ুর ছবি, তঁাকে তৈরি করেছেন সন্তোষ দত্ত-র জটায়ুর ছঁাচেই। সন্তোষ দত্ত আর জটায়ু একাকার বাঙালির মনে, আক্ষরিক অর্থে। সত্যজিৎ রায়ের জটায়ু তার গল্পের নাম দেয় ‘সাহারায় শিহরণ’ বা ‘দুর্ধর্ষ দুশমন’। উপন্যাসেও জটায়ু পদে পদে ভুল তথ্য দেয়।
যেমন, ‘সাহারায় শিহরণ’-এ লিখেছে, উট নিজের ওয়াটার সাপ্লাই নিজের পাকস্থলীর মধ্যে নিয়ে বালির সমুদ্র দিয়ে সার বেঁধে চলেছে। ফেলুদা তাকে কারেক্ট করে দিয়ে বলে, ‘জল আসে উটের কুঁজ থেকে। কুঁজের চর্বি উট অক্সিডাইজ করে জল করে নেয়।’ এ কথা শুনে ভালমানুষ জটায়ু জানায়, ‘ভাগ্যিস বললেন, নেক্সট এডিশনে ওটা কারেক্ট করে দেব।’
সাধারণ মধ্যবিত্ত অাটপৌরে বাঙালি, তাকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন সন্তোষ দত্ত তঁার অভিনয়ে, সিনেমার পরদায়। এবং সত্যজিৎ বুঝতে পেরেছিলেন, জটায়ুর চরিত্রে সন্তোষের কোনও বিকল্প নেই। ২ ডিসেম্বর সন্তোষ দত্ত-র জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হবে। সেই উপলক্ষে সন্তোষ দত্ত-র পাড়া আমহার্স্ট রো-তে তঁার একটি আবক্ষ-মূর্তি উন্মোচিত হবে। সেই আবক্ষমূর্তি যেন গেঁাফহীন জটায়ু! কারণ, সন্তোষ দত্ত-র গেঁাফ ছিল না। তবুও দু’জনের আশ্চর্য মিল। যদি ওই পাড়ার রাস্তার নামেও উদ্যাপিত হন সন্তোষ দত্ত, সেই উদ্যাপনে লালমোহন ওরফে জটায়ুর মতো এক টিপিকাল মধ্যবিত্ত বাঙালিরও উদ্যাপন হবে বইকি!
