‘প্যারিস জলবায়ু চুক্তি’ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ছেদের ঘোষণা করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টিকে বরাবরই ‘ধাপ্পাবাজি’ বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু এতে কি আমেরিকারও ক্ষতি হচ্ছে না? লিখছেন কৌশিক ভৌমিক ও মৌসুমী দত্ত।

ওভাল অফিসে ঢুকতেই বিভ্রাট। মার্কিন এগজিকিউটিভ অর্ডারে সই করে ‘প্যারিস জলবায়ু চুক্তি’ (Paris Climate Agreement) থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ছেদের ঘোষণা করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অবশ্য সদ্য নির্বাচিত মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিশ্ব জলবায়ু সংকট নিয়ে যে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন, তা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন প্রাক্-নির্বাচনী প্রচারেই।
তিনি এমন এক সময় মার্কিন মসনদে বসলেন, যখন সারা বিশ্ব ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সদ্য সমাপ্ত মার্কিন নির্বাচনের প্রাক্-নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প তঁার দেশে তেল ও গ্যাস উত্তোলন সংক্রান্ত কার্যকলাপকে ইন্ধন জুগিয়ে অকপটে মন্তব্য করেছিলেন: ‘ড্রিল বেবি ড্রিল’। অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় খনিজ পদার্থের জ্বালানিতে উষ্ণায়নের ফলে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধির বিপদ নিয়ে যখন সতর্কবাণী শোনাচ্ছেন, তখন ট্রাম্পের কটাক্ষ: সমুদ্রের জলস্তর বাড়লে সৈকতমুখী ভূসম্পত্তির চাহিদা বাড়বে।
অথচ, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কার্যত যা ঘটে চলেছে দ্রুত হারে, পরিণতি– পরিবেশ ক্রমশ ধ্বংসের দিকে এগচ্ছে। আফ্রিকা, আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘন-ঘন সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, অসম বৃষ্টি, হিমবাহ গলন, দাবানল, অসহনীয় তাপমাত্রা, কৃষিজাত পণ্যের অপর্যাপ্ত উৎপাদন, বিবিধ রোগ, মহামারীর প্রাদুর্ভাব ভয়ঙ্করভাবে সামাজিক ভারসাম্য ব্যাহত করছে।
রেহাই পাচ্ছে না আমেরিকাও। বিশ্ব বায়ুমণ্ডলীয় এবং মহাসাগরীয় তথ্যের মার্কিন সরকারি সংরক্ষণাগার, ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল ইনফরমেশন’ জানিয়েছে ২০২৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, হিউস্টন, ফিনিক্স-সহ বিভিন্ন প্রদেশ ২৭টি ভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত হয়েছে। আহত ও মারা গিয়েছে বহু মানুষ। ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। জলবায়ুর প্রতিকূল প্রভাবের জেরে সেই দেশে শুরু হয়েছে ‘ক্লাইমেট মাইগ্রেশন’। প্রকৃতির রোষ যেসব জায়গায় বেশি, সেখানকার বাসিন্দারা সরে যাচ্ছে টেক্সাস, মায়ামির মতো তুলনামূলক কম দুর্যোগপ্রবণ স্থানে।
পৃথিবীর সব দেশ-ই ভয়ংকর জলবায়ু পরিবর্তনের দুর্যোগে ভুগছে। পরিবেশের ক্রমবর্ধমান অবক্ষয় নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে একাধিক আন্তর্জাতিক চুক্তি– যেমন: ‘মন্ট্রিল প্রোটোকল’, ‘রিও কনভেনশন’, ‘কিয়োটো প্রোটোকল’, ‘প্যারিস চুক্তি’ প্রভৃতি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ১৯৯৫ থেকে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ‘কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিস’ (সিওপি) সম্মেলন। মূল উদ্দেশ্য– কীভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্পযুগের পূর্বের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা, বা আরও ভাল, ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তা সীমাবদ্ধ করা।
এজন্য ‘লক্ষ্যমাত্রা’ হিসাবে ঠিক করা হয়েছে, প্যারিস চুক্তির অন্তর্গত দেশগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন-সহ অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমাবে ৪৫ শতাংশ আর ২০৫০ সালের মধ্যে নেট শূন্য করবে। এই লক্ষ্যে প্রতি পঁাচ বছর অন্তর সব দেশ নিজেদের ‘জাতীয় নির্ধারিত অবদান’ (এনডিসি) সংক্রান্ত রিপোর্ট সিওপি সম্মেলনে পেশ করে। সরকারিভাবে জানায়, নিজের দেশে দূষণকারী গ্যাস নির্গমন হ্রাসে তাদের গৃহীত পরিকল্পনার রূপরেখা।
অথচ, এত দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন মেরামতির বিশ্বব্যাপী কর্মকাণ্ডের পরও পরিস্থিতি ভয়াবহ। দেশগুলোর ২০২০-র ‘এনডিসি’ রিপোর্ট মূল্যায়ন করে দেখা গিয়েছে, দূষিত গ্যাস নির্গমন বর্তমান ধারায় বজায় থাকলে ২০৩০ সালে ২০১৯ সালের মাত্রার তুলনায় মাত্র ২.৬ শতাংশ নির্গমন কমবে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা যেখানে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার কথা, তা এখনই ১.৩। ‘বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা’ (ডব্লিউএমও)-র তথ্য বলছে– ২০২৪ সালে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা সাময়িকভাবে ১.৫৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ছুঁয়েছিল। আর জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টনিও গুতেরেস তো জানিয়েছেনই, ২০২৪ ছিল বিশ্ব উষ্ণতার ইতিহাসে উষ্ণতম বছর।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যদিও পৃথিবীর জলবায়ুর এই সংকটজনক সময় প্যারিস চুক্তি থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে নিলেন। যুক্তি দিয়েছেন, চিন যেখানে বেশি দূষণ ছড়াচ্ছে সেখানে জলবায়ুর অর্থায়ন খাতে তার দেশ কোনও আর্থিক দায় ঘাড়ে নেবে না, কারণ তা হতে পারে মার্কিনিদের স্বার্থের পরিপন্থী। উল্লেখ্য, চিন যদিও গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনে আমেরিকাকে ছাপিয়ে প্রথম স্থানে এবং ভারত তৃতীয়, তবুও আমেরিকার কার্বন নির্গমনের ঐতিহাসিক অবদান সর্বোচ্চ।
কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস কয়েক শতাব্দী ধরে বায়ুমণ্ডলে থেকে যায় আর বাতাসে তাপ আটকে রাখে। গ্লোবাল কার্বন প্রোজেক্ট জানাচ্ছে, ১৯৫০ সাল থেকে বায়ুমণ্ডলে থাকা মোট কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রায় ২২ শতাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবদান, যা বিশ্ব উষ্ণায়নের বড় কারণ। অতএব, জলবায়ু খাতে যেমন অনুদান বন্ধ করতে মরিয়া ট্রাম্প প্রশাসন, তেমনই তঁার দেশের নাগরিকদের দুর্যোগহীন সুস্থ যাপনের স্বার্থে দূষণ বৃদ্ধিকারী যে কোনও কার্যকলাপ বন্ধের বিষয়েও সচেতন হওয়া উচিত তঁার সরকারের।
তবে ট্রাম্পের আমেরিকাকে প্যারিস চুক্তি থেকে বের করে আনা এবারই প্রথম নয়। ২০১৭ সালে পৃথিবীর জলবায়ু পরিস্থিতি যখন বর্তমান বিপদসীমার দিকে ধাবমান, সেই সময়ও তিনি বিশ্বকে চমকে দিয়ে একই পরিবেশ-ঘাতক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টিকে বরাবরই ‘ধাপ্পাবাজি’ মনে করে এসেছেন, টুইট করেছেন, প্রচারে পরিবেশ বিমুখ বক্তব্যও রেখেছেন। প্রথম মেয়াদকালে ট্রাম্প প্রশাসন জলবায়ু বিজ্ঞানকে গুরুত্বের লেশমাত্র দেয়নি। তঁার সরকার শুধু যে প্যারিস চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিরত রেখেছিল তাই নয়, জাতীয় স্তরে বাতিল করেছিল শতাধিক পরিবেশমুখী বিধি-বিধানও। যেমন, ‘ক্লিন পাওয়ার প্ল্যান’, যার লক্ষ্য ছিল, বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কার্বন নির্গমন কমানো।
মার্কিন পরিবেশ সংস্থা, ‘এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি’ (ইপিএ), যা একসময় যুক্তরাষ্ট্রে জলবায়ু সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে অগ্রগণ্য ভূমিকা নিয়েছিল, এই সংস্থাটির অর্থায়নে ট্রাম্প সরকার বড়সড় কাটছঁাট করেছিল। দেশের মাটিতে তেল ও গ্যাস উত্তোলনের ঢালাও অনুমতি দিয়েছিল। যানবাহনের জ্বালানির উপর বিধিনিষেধ শিথিল করেছিল। জীবাশ্ম জ্বালানির পরিকাঠামোমূলক উন্নয়নকে ইন্ধন জুগিয়েছিল। অতএব, প্রথম ট্রাম্প সরকার মার্কিন অর্থনীতি থেকে পরিচ্ছন্ন ও পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিকে ব্রাত্যই করে রেখেছিল।
দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসন, প্যারিস চুক্তি থেকে সরে গিয়ে, পরিবেশ-বৈরী বিভিন্ন নীতিই যে অব্যাহত রাখবে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল। ২০২৪ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ট্রাম্পের রিপাবলিকান দল বিপুল জনসমর্থন নিয়ে পুনর্নির্বাচিত হয়েছে। ফলে, কোনও নীতি প্রণয়নে সরকারের উপর রাজনৈতিক চাপ বা সীমাবদ্ধতা নেই। ট্রাম্প সরকার এবার জো বাইডেন প্রশাসনের প্রণীত যাবতীয় পরিবেশবান্ধব আইন যে বাতিল করতে উঠেপড়ে লাগবে, সন্দেহ নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস চুক্তি থেকে প্রথমবার বিচ্যুত করার পর, ড্যামেজ কন্ট্রোল হিসাবে, জো বাইডেন প্রশাসন ২০২১ সালে আমেরিকাকে প্যারিস চুক্তিতে পুনর্সংযুক্ত করে সারা বিশ্বকে পরিষ্কার বার্তা দিয়েছিল– এবার মার্কিন সরকার আন্তর্জাতিক জলবায়ু বিষয়ে বিশেষভাবে দায়িত্বশীল ও জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে সবরকমের সহযোগিতা করবে। বাইডেন প্রশাসন ২০৩৫ সালের মধ্যে আমেরিকার গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ২০০৫ সালের নির্গমনের তুলনায় ৬০ শতাংশের বেশি হ্রাস ও ২০৫০ সালের মধ্যে নেট শূন্য করার প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রণয়ন করেছিল ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট’, যার অন্তর্গত রয়েছে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে একাধিক আর্থিক সুবিধা ও পরিচ্ছন্ন শক্তির প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ৩৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের অনুদান এবং পূর্ব মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার চালু করা গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের অর্থায়নও জারি রেখেছিল।
প্যারিস চুক্তি থেকে আমেরিকা সরে যাওয়ার পর বিশ্ব জুড়ে পরিবেশবান্ধব শক্তির উন্নয়নের প্রচেষ্টা যে ধাক্কা খাবে, বলা বাহুল্য। তবে এটাও অনস্বীকার্য যে, ২০২৪ সালের আজারবাইজানে ‘সিওপি ২৯’-এর সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে যেখানে ১৩০০ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক অনুদান দাবি করেছিল, সেখানে প্রথম বিশ্বের দেশগুলি মিলিতভাবে সাকুল্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিতে রাজি হয়। যা আফ্রিকার দেশগুলি-সহ ভারত ও অন্যান্য উন্নয়নশীল রাষ্ট্র একেবারেই ‘অপর্যাপ্ত’ বলে বিরোধিতা করে। তখন ট্রাম্প নির্বাচিত হলেও, আমেরিকার ক্ষমতায় কিন্তু ছিলেন জো বাইডেন।
প্যারিস চুক্তি থেকে আমেরিকার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ফলে ভারতের উপরও পড়তে পারে নেতিবাচক প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব মোকাবিলা করতে ভারত প্যারিস চুক্তি ও বিভিন্ন সিওপি-র নিদান মেনে সবুজ শক্তিতে রূপান্তরের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ভারত সরকার পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি প্রচলনের লক্ষ্যে ৫০০ গিগাওয়াট অ-জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তির উৎপাদন, ও ২০৭০-এর মধ্যে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন নেট শূন্য করতে বদ্ধপরিকর। ট্রাম্পের তৈরি করা সমস্যায় পিছপা না হয়ে এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে ভারত নিজেই উদ্যোগী হতে পারে। প্রয়োজনে হাত মেলাতে পারে অন্যান্য সম-সদিচ্ছাপূর্ণ উন্নত দেশের সঙ্গেও।
বর্তমানে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতি। নরেন্দ্র মোদীর সরকার-সহ মার্কিন আর্থিক তথ্য বিশ্লেষণকারী সংস্থা ‘এসএন্ডপি গ্লোবাল’-এর বক্তব্য ২০২৮ সালেের মধ্যে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছোঁবে ভারতের জিডিপি। অতএব, আন্তর্জাতিক আর্থিক অনুদানের মুখাপেক্ষী না-হয়ে ভারত নিজেই জাতীয় রসদ, উদ্ভাবনী প্রযুক্তি, উন্নত মানের গবেষণা, পোক্ত আর্থিক পরিকাঠামোর সাহায্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করে ‘বিকশিত ভারত’ হয়ে উঠতে পারবে, ধরাই যায়।
(মতামত নিজস্ব)