shono
Advertisement

আপনি আচরি ধর্ম, পুতিনকে যুদ্ধ থামানোর বার্তা দিলেও মোদি কী করছেন?

পুতিনকে দেওয়া জ্ঞান দেশের রাজনীতিতে মনে রাখা দরকার মোদির।
Posted: 11:08 AM Sep 22, 2022Updated: 11:08 AM Sep 22, 2022

রাশিয়া ও ইউক্রেন নামক দুই নৌকায় পা দিয়ে কূটনৈতিক স্তরে ভারত ভারসাম্যের যে-খেলা দেখাচ্ছে, তা চমৎকার। জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী মোদিকে দশে দশ দিতেই হয়। কিন্তু যুদ্ধ না-করার যে-জ্ঞান পুতিনকে তিনি দিয়ে এলেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সেই ধর্ম তাঁরও পালন করা দরকার। কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

শ্চিমি দুনিয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কেননা, ইউক্রেন আক্রমণকারী রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে তিনি বলেছেন, ‘এটা যুদ্ধর সময় নয়। কোভিড ও ইউক্রেন পরিস্থিতি সারা বিশ্বে খাদ্য, সার, জ্বালানির অভূতপূর্ব সংকট সৃষ্টি করেছে। এসবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় কাজ।’

উজবেকিস্তানের ঐতিহাসিক শহর সমরখন্দে ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’ (এসসিও)-এর শীর্ষ সম্মেলনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় প্রধানমন্ত্রী মোদির  (Narendra Modi) এই সহজ-সরল অথচ গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, যা তিনি যুদ্ধবাজ পুতিনের মুখের উপর বলার সাহস দেখিয়েছেন। পশ্চিমি মিডিয়া গত কয়েক বছর ধরে নানা বিষয়ে মোদির সমালোচনা করে ভারত সরকারের বিরাগভাজন হয়েছে। কখনও ‘মুক্ত গণতন্ত্র’ থেকে ‘আংশিক মুক্ত গণতন্ত্র’-য় নেমে যাওয়ার খবর ছেপে, কখনও ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’য় উপনীত হওয়ায় কটাক্ষের দরুন, কখনও ‘হেট স্পিচ’-এর বিরামহীন লাভাস্রোতের উল্লেখ করে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পশ্চিমি মিডিয়াকে ভারত সরকারের রক্তচক্ষু সহ্য করতে হয়েছে। এবার তাদের প্রশংসা প্রধানমন্ত্রীর ছাতি প্রশস্ত করেছে। ফলাও করে তা প্রচারিতও হচ্ছে।

তাতে অবশ্য রাজনৈতিক তরজা থেমে থাকেনি। থেমে থাকবেই-বা কেন? ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম যেমন মোদি-পুতিন মুখোমুখি, তেমনই লাদাখ সংঘর্ষের পর একই মঞ্চে সশরীর শি জিনপিং-মোদিও এই প্রথম। কিন্তু যতটা সাহস তিনি পুতিনকে দেখাতে পারলেন, তার কিঞ্চিৎ শি-র ক্ষেত্রে দেখা গেল না। এই এড়ানো কি ইচ্ছাকৃত? প্রশ্ন উঠছে।

[আরও পড়ুন: স্তালিনকে মনে করাচ্ছেন পুতিন?]

এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে মোদির যোগ দেওয়া নিশ্চয়ই হুট করে ঠিক হয়নি। লাদাখে চিনের জমি দখল নিয়ে দেশীয় রাজনীতিও সরগরম অনেক দিন ধরে। চিনা (China) ফৌজের সংঘর্ষ-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অবস্থান নিয়েও বিতর্কের অন্ত নেই। এই সেদিন গোগরা-হট স্প্রিং থেকে দু’-দেশের সেনা সরানোর খবরে সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ যাঁরা করেছেন, তাঁরা লাদাখের শাসক সমর্থিত রাজনীতিক। তাঁদের বক্তব্য, এত বছর ধরে যে-অঞ্চলে পশুপালকরা স্বচ্ছন্দে যেতে পারত, লড়াইয়ের পর থেকে সেই অধিকারে তারা বঞ্চিত। যে-এলাকায় ভারতীয় সেনা-টহলের গতিবিধি অবাধ ছিল, সেখানে যাওয়ার অধিকার আর নেই। দু’বছর ধরে বিরোধীরা লাদাখের জমি দখল নিয়ে যে যে অভিযোগ করে আসছে, একটি ক্ষেত্রেও সরকার তার কোনও বিশ্বাসযোগ্য জবাব বা প্রমাণ দিতে পারেনি। সংসদের ভিতর-বাইরে কোথাও নয়।

এই প্রথম ভারতের অসন্তুষ্টির কথা জানানোর একটা সুযোগ এসেছিল। কিন্তু সেটাও ব্যবহার করা হল না। শি-র সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের উদ্যোগ কি নেওয়া যেত না? না কি নেওয়া হলেও ভারতের আগ্রহকে চিন আমল দেয়নি? এর উত্তর কারও জানা নেই। ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’ (এলওসি) বরাবর সেনা পশ্চাদপসরণের যে-বিষয়টি নিয়ে এখনও বিতর্ক অব্যাহত, অর্থাৎ যতটা তারা এগিয়েছিল, ততটা পিছোয়নি, তা নিয়ে ভারতের অসন্তোষ কি জানানো যেত না? নিশ্চিতভাবে এই ধরনের বহুপাক্ষিক বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক বিষয়ের অবতারণা কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নয়। কোনওভাবে কি প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে অসন্তোষের উল্লেখ করতে পারতেন না? বিশ্বশান্তি তো দূরের বিষয়, অন্ততপক্ষে সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে শান্তি, সদ্ভাব ও সৌভ্রাতৃত্ব রক্ষা এবং বিশ্বাস অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কথা তো তিনি তঁার মতো করে জানাতেই পারতেন। বিশেষ করে তিনি যখন স্বঘোষিত ‘বিশ্বগুরু’! শি-কে বুঝিয়ে দিতে পারতেন, এলওসি-তে যেভাবে তারা শান্তি ও সুস্থিতির ব্যাখ্যা করছে, ভারতের সংজ্ঞা তার চেয়ে আলাদা।

অতীতে বহু ক্ষেত্রে বহুপাক্ষিক আসরে ভারতও তার দ্বিপাক্ষিক অবস্থানের উল্লেখ করেছে। এবারেও চাইলে করা যেত। সেই বিচারে মোদি ব্যর্থ। গত দু’-বছর ধরে লাদাখ পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর সরকার সত্য গোপন করে চলেছে বলে বিরোধীরা সম্মিলিতভাবে অভিযোগ করে আসছে। সংসদে একটি দিনের জন্যও সরকার এই বিষয় আলোচনা করতে দেয়নি। এমন কোনও প্রমাণও দিতে পারেনি যাতে বোঝা যায়, এলওসি-র স্থিতাবস্থা অপরিবর্তিত। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যদের লাদাখ যাওয়ার অনুমতিও দেওয়া হয়নি। যখনই কেউ সরব হয়েছে, শাসক দল ও সরকার সামনে এনেছে ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পুরনো ইতিবৃত্ত। তাতে অতীতের ব্যর্থতা প্রকট হলেও নিজেদের সাফল্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। প্রতিষ্ঠিত হয় না সত্যও।

ব্যাখ্যাটা তাহলে কীরকম? এটাই যে, ‘মিত্র’ পুতিনকে যে-কথা বলা যায়, ‘অ-মিত্র’ শি জিনপিং-কে সে-কথা সাহসে ভর দিয়ে বলা মোদির পক্ষে কঠিন। তা সে তিনি যতই শি-র সঙ্গে সবরমতি আশ্রমে দোলনায় দুলুন কিংবা তামিলনাড়ুর মমল্লাপুরমের পাহাড়ে খোদাই প্রাচীন ভারতীয় ভাস্কর্য ও সংস্কৃতির ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে দু’দেশের চিরায়ত যোগাযোগের কথা প্রচার করুন।

রাশিয়া ও ইউক্রেন নামক দুই নৌকায় পা দিয়ে কূটনৈতিক স্তরে ভারত ভারসাম্যের যে-খেলা দেখাচ্ছে, এককথায় তা চমৎকার। জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী মোদিকে দশে দশ দিতেই হবে। তা সত্ত্বেও বলতে হবে, পুতিনকে ‘এটা যুদ্ধের সময় নয়’ বলার ক্ষেত্রে মোদির মননে যেসব ভাবনার উদয় হয়েছিল, বৈশ্বিক পরিস্থিতির মতো দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থাতেও তা সমভাবে প্রযোজ্য। হানাহানি, রেষারেষি, মারামারি, কাটাকাটি বা রক্তক্ষয়ী শত্রুতা কোনও দিন কোনও জাতি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা দেশের পক্ষে মঙ্গলদায়ক হতে পারে না। গৃহযুদ্ধও সর্বনাশা। ইতিহাসের শিক্ষা এটাই। অতএব, মোদি যা বলেছেন, পুতিনের রাশিয়ার জন্য তা যেমন সত্য, তেমনই তা সত্য ভারতের জন্যও। যুদ্ধ না-করার যে-জ্ঞান বন্ধু পুতিনকে তিনি দিয়ে এলেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সেই ধর্ম তাঁরও পালন করা দরকার। অথচ, নিজ দেশে তাঁর দল, সংঘ পরিবার ও সরকার নিয়মিত যা করে চলেছে, তাঁর ঔদাসীন্য যেভাবে সেই হানাহানি-কাটাকাটি ও নাগরিক বৈষম্য সৃষ্টিতে উৎসাহ জোগাচ্ছে, তা জন্ম দিয়েছে এক গভীর অসুখের। এই ঘরোয়া ‘যুদ্ধ’ থেকে পরিত্রাণের কোনও পরামর্শে প্রধানমন্ত্রী আজ পর্যন্ত কর্ণপাত করেননি। দুঃখের বিষয় এটাই।

এই দুঃখ বা গৃহযুদ্ধ-র অবসান আদৌ ঘুচবে কি না, কারও জানা নেই। ঘৃণার আবহ দিন দিন যেভাবে বিস্তারলাভ করছে, আমরা-ওরায় যেভাবে বিভাজিত হচ্ছে সমাজ, সব শালীনতার আগল যেভাবে দ্রুত ভেঙে যাচ্ছে, তিক্ত হচ্ছে শাসক ও বিরোধীদের স্বাভাবিক সামাজিক-নাগরিক সম্পর্ক, তাতে দেশের অভ্যন্তরে সৃষ্টি হচ্ছে ছোট ছোট ইউক্রেন। সর্বনাশের পথে দ্রুত ধাবমান বৈচিত্রময় ভারত। অথচ শাসকদের মধ্যে নজরকাড়া এমন কেউ নেই যিনি সাহসী হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে তাঁরই কথা শোনাতে পারেন। বলতে পারেন, ‘এটা যুদ্ধের সময় নয়!’

বরং গোটা দেশ শুনছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান বিরোধী দল বুক বাজিয়ে বলছে, “আপনি একজন ‘প্যাথোলজিকাল লায়ার’।” তথ্যপ্রমাণ দাখিল করে বলছে, ‘আপনি জন্মগত মিথ্যেবাদী।’ একবার নয়, দু’বার নয়, মিথ্যাচারিতার গুরুতর অভিযোগ বারবার রাজনীতির আসর গরম করেছে। তা সে অতীত পেশা অথবা শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা প্রতিবেশী দেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে সত্যাগ্রহী হয়ে গ্রেপ্তার বরণড- যা-ই হোক না কেন। গণতান্ত্রিক ভারতের নেতৃত্বের মধ্যে তীব্র মতবিরোধের প্রকাশ বহুবার হয়েছে। কিন্তু একে অন্যের প্রতি এত তীব্র ঘৃণা, হলাহলের এমন অনর্গল উদ্‌গিরণ আগে দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর অন্তরাত্মাকেই অগ্রণী হয়ে বলতে হবে, ‘ওহে, সংযত হও। এটা যুদ্ধের সময় নয়।’

[আরও পড়ুন: আশা জাগিয়েও কি ব্যর্থ হবে কংগ্রেসের ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement