রাজদীপ সরদেশাই: কম-বেশি দু’-দশক আগে একটি বেশ নামজাদা হিন্দি চ্যানেলে একটি কালজয়ী ক্রিকেট শো প্রদর্শিত হত। শো-টির নাম ছিল বেশ উসকানিমূলক– ‘ম্যাচ কা মুজরিম’, অর্থাৎ, এই ম্যাচের অপরাধী কে? এই শোয়ের দর্শক ছিল রীতিমতো উত্তেজিত। এসএমএস-এর মাধ্যমে সরাসরি ভোটদানের সুযোগ ছিল। ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়া হত এই শো-তে। সব মিলিয়ে এই শো-র উদ্দেশ্য ছিল, কিছুটা বিকৃত কায়দায়, সেদিনের ‘খলনায়ক’ কে, অর্থাৎ কোন খেলোয়াড় তাঁর টিমের পরাজয়ের জন্য দায়ী– তা নির্ধারণ করা। টিভি স্টুডিও সেখানে হয়ে উঠত মল্লযুদ্ধের প্রাঙ্গণ, ক্রিকেট-পাগল জনতা হয়ে উঠত গণপিটুনির ভিড়। ভক্তকুল আর তামাশাপিয়াসী জনগণের মধ্যে ভেদরেখাটুকু ম্লান হয়ে যেত সহজেই।
বহু বছর কেটে গিয়েছে তারপর। সেই হিংস্র দোষারোপের খেলা কিন্তু এখনও থামেনি। বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতের হারের পরের প্রতিক্রিয়াগুলি সে-কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। মনে হতেই পারে, বেশিরভাগ ভারতীয়ই জানে না, সম্মানজনকভাবে পরাজয়কে কীভাবে স্বীকার করতে হয়।
তিন কোটির বেশি বিল বকেয়া, ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের দিনও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রায়পুরের স্টেডিয়াম
পিচের ঢিলেমিকে দোষ দেওয়া থেকে শুরু করে আহমেদাবাদকে ফাইনালের জন্য বেছে নেওয়া নিয়ে নাক সিঁটকানো, বিসিসিআই-এর কর্তা জয় শাহ-কে গাল পাড়া থেকে শুরু করে কেবল সেদিন খেলা দেখতে গিয়েছিলেন বলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে (Narendra Modi) দুম করে ‘পনৌতি’ (অপয়া) বলে দাগিয়ে দেওয়া– একদল ‘মুজরিম’ বা অপরাধীকে যেন জনমতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। কিন্তু খুব কম লোকেই এই সহজ সত্যটা মেনে নিতে ইচ্ছুক যে, অস্ট্রেলিয়া সেদিন নিখুঁত একটি ওয়ান ডে ম্যাচ খেলেছে। সেই ম্যাচ পর্যন্ত দুর্দান্তভাবে অপরাজিত থাকা ভারত কিন্তু সেই খেলাটা সেদিন মোটেই খেলতে পারেনি।
একদিন একটি টিমকে অপরাজেয় ও দুর্দম বলে চিহ্নিত করেই পরের দিন তাদের অপদার্থ বলে চিহ্নিত করা– সমর্থকদের এই প্রবণতা নিতান্তই নতুন। মনে করে দেখুন, সেই ১৯৭১ সালের কথা, সাগরপারের সিরিজে সেই প্রথমবার ইংল্যান্ডকে পরাস্ত করে ফেরার পর মুম্বইয়ে রীতিমতো রংবেরঙের কাপড় উড়িয়ে স্বাগত জানানো হয়েছিল ভারতীয় দলকে (Indian Cricket Team)। এর ঠিক তিন বছর পর, ওই একই প্রতিপক্ষর কাছে ৩-০-তে হেরে সিরিজ থেকে ভারত যখন একেবারে মুছে গেল– তখন অধিনায়ক অজিত ওয়াদেকরের বাড়িতে ঢিল ছোড়া তো হলই, উপরন্তু ইন্দোরে একটি ‘ভিক্টরি ব্যাট’ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল। তখনও আমাদের দেশ ক্রিকেটজীবনের বয়ঃসন্ধিতে দাঁড়িয়ে, যারা যত না ম্যাচ জিতেছে, তার চেয়ে বেশি হেরেছে। এখন তো আমরা রীতিমতো প্রথম সারির দল। অথচ এখনও পরিণত মনে পরাজয়ের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে শিখলাম না আমরা।
সাতের দশকে আমাদের জীবনে তো সামাজিক মাধ্যম বা তৎক্ষণাৎ মেসেজ পাঠানোর কোনও ব্যবস্থা ছিল না। সে-অর্থে সেটা ছিল তুলনায় ভদ্রস্থ একটা সময়। এখন তো একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বা এক্সে দু’-লাইন লিখে বা ইনস্টাগ্রামে মিম শেয়ার করেই অনায়াসে প্রতিক্রিয়ার ঝড় তুলে দেওয়া যায়। প্রায় মনে হবে যেন, একটা গোটা দেশ আমাদের ক্রিকেট আইকনদের প্রকাশ্যে বেইজ্জত করে একরকমের পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করছে। স্মরণ করে দেখুন, ২০২১ সালে যখন পাকিস্তানের কাছে একটি টি-২০ ম্যাচে ভারত পরাজিত হয়েছিল, তখন কীভাবে একা মহম্মদ শামিকে (Mohammed Shami) কোণঠাসা করা হয়েছিল, কালি লেপা হয়েছিল তাঁর কৃতিত্বে। সেই শামি-ই কিন্তু এখন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিম বোলার হিসাবে স্বীকৃত।
[আরও পড়ুন: দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টিতেও নেতৃত্বের প্রস্তাব রোহিতকে, কেন ফেরালেন হিটম্যান?]
একটা পর্যায়ে এই আবেগের খামখেয়ালিপনা থেকে প্রতীয়মান হয়– কীভাবে আমাদের সমসাময়িক ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় ক্রিকেটের ভূমিকার সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদ সম্পৃক্ত হয়ে আছে। ক্রিকেট কেবলই আর একটি ক্রীড়ামাত্র নেই, তা আমাদের জাতীয়তাবাদী সত্তার অংশ হয়ে গিয়েছে। হয়ে উঠেছে আমাদের তামাম দুনিয়ার প্রকৃত মহাশক্তি হয়ে ওঠার অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ। রাষ্ট্র সংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের স্থায়ী সদস্য আমরা না হতেই পারি, কিন্তু বিশ্ব ক্রিকেটে ‘ভিটো’ দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের দেশ এখন রাখে। ক্রিকেট-দুনিয়ায় এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী বেতাজ বাদশার অবস্থানটাই আমাদের অহমিকা জাগিয়ে তুলেছে। আমরা যেহেতু সবচেয়ে ক্ষমতাবান ক্রিকেট-রাষ্ট্র হয়ে উঠেছি প্রায়, ফলত একটা অটুট বিশ্বাস যেন তৈরি হয়ে গিয়েছিল, ভারতই বিশ্বকাপের পূর্বনির্ধারিত বিজেতা। আমরা যেটা ভুলে গিয়েছিলাম, তা হল অপরিমিত অর্থশক্তি হয়তো আমাদের সীমানার তোয়াক্কা না করে মস্তানির অধিকার দিয়েছে, কিন্তু পুঁজি মাঠে শেষ কথা বলে না।
অন্য স্তরে যা ভাবার, মর্যাদার সঙ্গে পরাজয় মেনে নিতে নারাজ হওয়া আদতে ব্যক্তিপুজোর সংস্কৃতির ফসল, যে-সংস্কৃতি নায়ক নির্মাণে ব্যস্ত, কিন্তু খেলোয়াড়োচিত মনোভাবকে কোনওভাবেই গ্রহণে সক্ষম নয়। স্টার স্পোর্টস ছিল এবার বিশ্বকাপের অফিসিয়াল ব্রডকাস্টার। যদি সেই চ্যানেলে কেউ নজর রেখে থাকেন, তবে খেয়াল করবেন, টুর্নামেন্ট জুড়ে অজস্র অনুষ্ঠান চলেছে, যা কেবল বিরাট কোহলির প্রতি নিবেদিত। কোহলি নিঃসন্দেহে একজন আকাশছোঁয়া তারকা, এবং তর্কাতীতভাবে শ্রেষ্ঠ ওয়ানডে ব্যাটারদের একজন। কিন্তু একজন মাত্র খেলোয়াড়ের প্রতি এই উথলে ওঠা ভক্তি, যা প্রায় সামন্ততান্ত্রিক ভক্তিবাদে পর্যবসিত হচ্ছে– তা বিরক্তিকর তো বটেই, ক্ষেত্রবিশেষে বমন উদ্রেককারী। এখান থেকেই চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়ার ব্যাকরণটা খোলসা হয়।
বিরাট কোহলি (Virat Kohli) যখন মুম্বইতে তাঁর রেকর্ড-ভাঙা ৫০তম শতরানটি করলেন, তখন তাঁকে প্রায় ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ফাইনালে নেমে যখন তিনি লড়াই করছেন, অমনি বড় ম্যাচের চাপ সহ্য করতে না পারার দায় তাঁকে কাঁধে নিতে হল।
এই নায়ক তৈরির খেলাটা ক্রিকেট থেকে রাজনীতি– সর্বত্র ব্যাপৃত। যেখানে এমনকী ঐতিহাসিক ‘চন্দ্রযান ৩’ চাঁদে নামলেও তা সরকারের অবিরত প্রচারযন্ত্রের কাছে আয়ুধ হয়ে ওঠে, যেখানে খোদ প্রধানমন্ত্রীকেই দেখা যায় মহাকাশ-বিজ্ঞানীদের কৃতিত্ব ভাগ করে নিতে– সেখানে ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি অনভিপ্রেত মনোযোগ আকর্ষণ করবে, এ তো অবধারিত। যেমন, চন্দ্রযানের অর্জনের জন্য হাততালি একাই মহাকাশ-বিজ্ঞানীদের প্রাপ্য– তেমনই একটি ক্রিকেট ম্যাচে হারের ময়নাতদন্তে অহেতুক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের টেনে আনাও নিরর্থক। এখন কংগ্রেস যদি নরেন্দ্র মোদিকে ‘পনৌতি’ তকমা দিতে পিছপা না হয়, তাহলে কিন্তু বিজেপি-ও মনে করিয়ে দিতে পারে যে, নয়াদিল্লিতে, ১৯৮২ সালের এশিয়ান হকি ফাইনালে যখন পাকিস্তান ৭-১-এ হারিয়েছিল ভারতকে, তখন ইন্দিরা গান্ধীও কিন্তু সেখানে উপস্থিত ছিলেন। দল নির্বিশেষে কুসংস্কার কিন্তু নির্বুদ্ধিতার চেহারা নিতে দ্বিধা করে না।
সেই কারণেই বাস্তবের দিকে তাকানোর এটাই উপযুক্ত সময়, সে খেলাই হোক বা রাজনীতি। ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে ব্যক্তি আরাধনার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন– ‘ভক্তি বা নায়কপুজো নিশ্চিতভাবেই অধঃপতন ও ক্রমান্বয়ে একনায়কত্বর রাস্তা খুলে দেয়।’ দুঃখের বিষয়, সেই সতর্কবার্তা ইতিহাসের অতলে তলিয়ে গিয়েছে, এবং ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ অতিনায়করা আমাদের রাজনৈতিক মানচিত্রকে শাসন করে এখন। এখন ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও আমাদের একটি সতর্কীকরণ প্রয়োজন, নীল জার্সি পরা এই খেলোয়াড়রা প্রত্যেকেই যথেষ্ট প্রতিভাবান, যারা নিজেদের দক্ষতার জোরে এই অবস্থান অর্জন করেছেন। তাঁরা হয়তো যত না হারবেন, তার চেয়ে অনেক বেশি ম্যাচ জিতবেন, কিন্তু খেলাধুলোয় একটা পর্যায়ের পর হারজিতের এই সীমারেখাটা সুতোর মতোই সূক্ষ্ম। কিন্তু খেলার সহজাত বৈশিষ্ট্যই হল এই যে, তা প্রতিভা ও দক্ষতার নিরিখে উদ্যাপিত হয়। খেলাকে কখনওই হাতিয়ারবিহীন জীবনমরণ যুদ্ধ ভেবে নেওয়া, এবং খেলোয়াড়দের উর্দিপরা যোদ্ধা ভেবে নেওয়া কাম্য নয়। যুদ্ধ আমাদের মৃত্যু এবং ধ্বংসের বেদনাবিধুর দৃশ্যকল্প উপহার দেয়, কিন্তু খেলা আপনাকে ভরিয়ে তোলে আনন্দের স্মৃতিতে।
[আরও পড়ুন: দুবাইয়ে প্রধানমন্ত্রী, পা রাখতেই ‘অব কি বার মোদি সরকার’ স্লোগান, সেলফির হিড়িক প্রবাসীদের]
যে-পরিসর খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত, সেখানে ক্যামেরার অনুপ্রবেশটা কি খুব জরুরি ছিল?