কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখন কতটা কমজোরি, অসহায় ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়, গোবলয়ে ভোটের ফল তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। মেরামতের দায় এখন গান্ধীদের। সঙ্গে প্রয়োজন সুচারু রণনীতি ও ‘ইন্ডিয়া’-র যথার্থ যোগদান। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
দেখে বা শুনে শেখার চেয়ে ঠেকে শেখার অনুরণন ও বোধোদয়ের স্থায়িত্ব বেশি। কেননা, বিষয়টা ওই ন্যাড়ার বেলতলায় যাওয়ার মতো। অভিজ্ঞতা মর্মে-মর্মে বেঁধে। হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যের সাম্প্রতিক নির্বাচনে যা ঘটে গেল তাতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ঠেকে শিখলে তার তো বটেই, বিরোধী জোটেরও মঙ্গল। নইলে পাঁচ মাস পর পাঁচ বছর আগের পুনরাবৃত্তি অবধারিত।
কংগ্রেসের ভুল নিয়ে গত সপ্তাহে এই স্তম্ভে কিছুটা উল্লেখ করেছিলাম। খুব সংক্ষেপে আবারও বলি, চার রাজ্যেই কংগ্রেস কম-বেশি উপরচালাকি করেছিল। দুর্দমনীয় ও দুর্বার নরেন্দ্র মোদির মোকাবিলায় ওই নির্বাচনের আগে প্রধানত তাদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ‘ইন্ডিয়া’ জোট। উচিত ছিল চার রাজ্যের ভোটে বিজেপির মোকাবিলায় ‘ইন্ডিয়া’-কে যৎকিঞ্চিৎ প্রাধান্য দেওয়া। সেজন্য বিরাট কিছু একটা ত্যাগ তাদের স্বীকার করতে হত না। দু’-চারটে আসন ছেড়ে দিলে ‘ইন্ডিয়া’-কে যেমন সম্মান দেখানো যেত, তেমনই শরিকদের কাছে নিজের বিশ্বস্ততা ও গ্রহণযোগ্যতাকেও কংগ্রেস দায়িত্বশীল বড় তরফের মতো বড় করে তুলে ধরতে পারত।
কিন্তু সে গুড়ে বালি দিল নিজেরাই। অহংবোধ, মাত্রাতিরিক্ত আশা ও উপরচালাকি মাঠে মারা যাওয়ায় এখন মাথা নুইয়ে নখদন্তহীন সিংহের মতো তারা অনুজদের অনুকম্পা প্রার্থী। গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের চোখে এটা মোটেই চমৎকার বিজ্ঞাপন নয়।
[আরও পড়ুন: ‘ডাঙ্কি বিমানে’ দেশছাড়া করণি সেনা প্রধান খুনের মাস্টারমাইন্ড!]
আরও একটা কথা বলা দরকার। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখন কতটা কমজোরি, অসহায় ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়, গোবলয়ের এই ভোটের ফল তার জ্বলন্ত প্রমাণ। রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের নেতারা ঔদ্ধত্য দেখিয়ে হাইকমান্ডকে অসাড় করে রাখলেন। এমন ঘটনা আগে খুব একটা ঘটেনি। অশোক গেহলট ১০ জনপথের হুকুম অমান্য করে দলের সভাপতিত্ব গ্রহণ করলেন না। দিল্লি চেয়েছিল অন্তত ২০ জন এমএলএকে বসিয়ে দিতে। গেহলট তা হতে দিলেন না। কারণ, দুর্দিনে তঁারা নাকি তঁাকে সঙ্গ দিয়েছিলেন। পঁাচ বছর শাসনের মধ্যে সাড়ে চার বছর পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে গেলেন শচীন পাইলটের সঙ্গে। দিল্লি বলা সত্ত্বেও রাজনৈতিক রফায় যাননি। শেষবেলায় নিজের স্বার্থে শান্তি স্বস্ত্যয়নে রাজি হলেও তত দিনে জল নাকের অনেক উপর দিয়ে বইতে শুরু করেছিল। ফলে শেষরক্ষা হয়নি।
মধ্যপ্রদেশে কমলনাথ পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এবারের মতো ‘ফ্রি হ্যান্ড’ কখনও পাননি। অথচ সদ্ব্যবহারে পুরোপুরি ব্যর্থ। অখিলেশকে চারটি আসন ছেড়ে দিলে মহাভারত অশুদ্ধ হত না। সমাজবাদী পার্টি একটা আসনও জিততে পারত না ঠিক, কিন্তু ‘ইন্ডিয়া’ একটা বার্তা পেত। অথচ হল কী? কমলনাথের ‘অখিলেশ-টখিলেশ’ মন্তব্য ‘ইন্ডিয়া’-র শরিকদের মুখ বিস্বাদে ভরিয়ে দিল। একইরকম দেমাকি গেহলট রাজস্থানে সিপিএম ও ভারতীয় আদিবাসী পার্টিকে কলকে দিলেন না। তাতে যে ক্ষতিটা হল তা না হলে বিজেপি ১০১-এ থমকে যেত, কংগ্রেস উঠে আসতে পারত ৮৩-তে। তেলেঙ্গানাতেও সিপি(আই)-কে কাছে টেনে সিপি(এম)-কে দূরে সরিয়ে রেখেছিল কংগ্রেস। তাদের বোঝা উচিত ছিল, বিন্দু বিন্দুতেই সিন্ধু হয়। অভাবের সংসারে এক টাকা সাশ্রয়ের অর্থ একটা টাকা বাড়তি রোজগার। ড্যামেজ যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। মেরামতের দায় এখন গান্ধীদের। অপরাধ ‘ইন্ডিয়া’-রও। গোবলয়ে কংগ্রেস ০-৩ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ কংগ্রেসের চোদ্দোগুষ্টি উদ্ধারে নেচে উঠল। ভেসে এল এক-একজনের এক-একরকম মন্তব্য। বোঝা
গেল ‘ইন্ডিয়া’ এখনও টিম হিসাবে গড়ে ওঠেনি। টিম গেম সবসময় দুর্বলের পাশে থাকতে শেখায়। বিপদে হাত বাড়াতে বলে। একে অন্যকে উৎসাহ দেয়। এখানে সেসব শুধু অদৃশ্যই রইল না, বোঝা গেল, কংগ্রেসের বিপর্যয়ে শরিকেরাও উৎফুল্ল। সমষ্টির বাইরে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তায় তারা মশগুল। ভাবখানা এমন, যাক গে, ভালই হয়েছে, নিজেদের খাসতালুকে কংগ্রেসকে বাড়তি আসন আর ছাড়তে হবে না।
[আরও পড়ুন: সংসদ হামলার বর্ষপূর্তির দিনই লোকসভায় হামলা! আটক দুই অজ্ঞাতপরিচয়]
এক সপ্তাহ পর, ১৯ ডিসেম্বর, ‘ইন্ডিয়া’-র নেতারা বৈঠকে বসছেন। সেই বৈঠকে কতটা কী হবে পুরোপুরি নির্ভর করবে শরিকদের উপর। কংগ্রেসের ভুলের রাজনৈতিক বদলা নেওয়ার চেষ্টায় শক্তিধর শরিকেরা নড়াচড়া করলে, কংগ্রেসকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার বাসনায় এককাট্টা হলে সেটা হবে আরও বড় ভুল। ‘ইন্ডিয়া’-র অসংলগ্নতা উদ্দীপ্ত বিজেপিকে আরও বেশি আক্রমণাত্মক করে তুলবে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতালাভের হ্যাটট্রিকের আগাম ঘোষণা করেছেন। মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধেও তিনি কয়েক কদম এগিয়ে। বিরোধীদের একে অন্যকে টেক্কা দেওয়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে তঁার পোয়াবারো। এই সরল সত্য ‘ইন্ডিয়া’ যত দ্রুত হৃদয়ঙ্গম করবে তত মঙ্গল। মঙ্গল এই কারণে যে, সবকিছু এখনও শেষ হয়নি। গোবলয়ে হারার অর্থ এই নয় যে, আর্যাবর্ত থেকে তারা কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে। বরং সত্যি এই, তাদের উপস্থিতি এখনও প্রবল।
ভোট-তাত্ত্বিক যোগেন্দ্র যাদব দু’টি তথ্য হাজির করেছেন। প্রথমত, বিজেপি চার রাজ্যে যত ভোট পেয়েছে কংগ্রেস পেয়েছে তার চেয়ে সাড়ে ৯ লাখ বেশি। দ্বিতীয়ত, বিধানসভায় প্রাপ্ত ভোট লোকসভার আসন বিন্যাস অনুযায়ী সাজালে দেখা যাচ্ছে, চার রাজ্যের ৮২ লোকসভা আসনের মধ্যে ২৮টিতে কংগ্রেস এগিয়ে। পঁাচ বছর আগে এই ৮২ আসনের মধ্যে বিজেপি জিতেছিল ৬৬, কংগ্রেস মাত্র ৬টি। এবার বিজেপি এগিয়ে ৪৬ আসনে। গতবারের তুলনায় ২০টি কম, কংগ্রেস ২২টি বেশি। কয়েকটা বিষয় মাথায় ঢুকিয়ে নিলে
‘ইন্ডিয়া’-র পক্ষে মোদি-শাহর মোকাবিলাও সহজতর হয়। যেমন, গোবলয়ে বিজেপির বাড়ার জায়গা প্রায় নেই। তাদের নজরে তাই দাক্ষিণাত্যের ১৩০ আসন। সেখানে দাঁত ফোটাতে না-দেওয়ার কাজটা প্রধানত করতে হবে ডিএমকে, কংগ্রেস ও বামপন্থীদের। তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী রেবন্ত রেড্ডির সঙ্গে টিডিপি প্রধান চন্দ্রবাবু নাইডুর সখ্য ‘ইন্ডিয়া’-র পালে বাড়তি হাওয়া জোটাতে পারে। কর্নাটকে জেডিএসকে ধরে বিজেপি চাইছে কংগ্রেসের বাড়া ভাতে ছাই ফেলতে।
মনে রাখতে হবে, এই রাজ্যের ২৮টির মধ্যে গতবার বিজেপি ২৫টি আসন জিতেছিল। তা কমাতে হলে গোষ্ঠী-কোন্দলের স্থায়ী নিরাময়ে গান্ধীদের সচেষ্ট হতে হবে। গুজরাট (২৬), রাজস্থান (২৫), দিল্লি (৭), হরিয়ানা (১০), উত্তরাখণ্ড (৫) ও হিমাচল প্রদেশ (৪)– মোট ৭৭টি আসন পুরোটাই বিজেপি ছেঁকে তুলেছিল। মধ্যপ্রদেশ (২৯), ছত্তিশগড় (১১) ও বিহারের (৪০)– ৮০ আসনের মধ্যে তারা পেয়েছিল ৭৬টি। এর বাইরে উত্তরপ্রদেশের ৮০ আসনের মধ্যে ৬৬টি। অর্থাৎ, এই দশ রাজ্যের মোট ২৩৭ আসনের মধ্যে
বিজেপি-বিরোধীদের দখলে এসেছিল মাত্র ১৮টি। সত্যি এটাই যে, এই সব রাজ্যে বিজেপির আসন একটিও বাড়বে না। মহারাষ্ট্রে (৪৮) গতবার বিজেপি জোট জুটিয়েছিল ৪১টি, পশ্চিমবঙ্গে (৪২) এককভাবে ১৮। দান ঠিকমতো চালতে পারলে কে বলতে পারে এই রাজ্যগুলোয় পাশা ওল্টাবে কি না?
সেই ঠিক দান চালার দায় কারও একার নয়। কংগ্রেস যেমন ভেবেছিল– ৩ ডিসেম্বরের ফল তার পক্ষে ৩-১ হলে লোকসভা ভোটে দর কষাকষির জায়গা প্রশস্ত হবে, ‘ইন্ডিয়া’-র অন্য শরিকেরাও তেমন ভেবেছিল– আগে সমঝোতা হয়ে গেলে বলশালী কংগ্রেসকে বাড়তি আসন ছাড়তে হবে না। টেক্কা-মানসিকতা দু’-তরফেই ছিল। কংগ্রেস ব্যর্থ হয়েছে, বাকিদের পরীক্ষা বাকি। উপরচালাকির মাশুল কংগ্রেস দিচ্ছে। তারা নতজানু। ‘ইন্ডিয়া’ পরিবারের অন্যদেরও টেক্কা-মানসিকতা ছাড়তে হবে। প্রত্যেককেই ঠিক করতে হবে দলীয় স্বার্থ না কি মোদি-অবসান, কোনটা লক্ষ্য। লক্ষ্য স্থির করতে হবে ১৯ ডিসেম্বরের আগেই। কংগ্রেস ঠেকে শিখলে ভাল, অন্যরা কংগ্রেসকে দেখে শিখলে ‘ইন্ডিয়া’-রই মঙ্গল।