বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচন আগামী জানুয়ারির শুরুতেই। সেই ভোট কীভাবে হবে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি না, দেশজোড়া জল্পনা তা নিয়ে। কোভিড সত্ত্বেও সে-দেশের প্রবৃদ্ধি স্লথ হয়নি। মাথাপিছু আয়ও ভারতের চেয়ে বেশি। অথচ, এত কিছুর পরেও হাসিনার প্রতি একাংশের রোষ প্রবল। কীভাবে সামাল দেবেন তিনি? নজর সেদিকেই। কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
নির্বাচনী আবহে বড় হচ্ছে এক অন্য কৌতূহল। যেখানেই যাচ্ছি শুনছি, ‘ইন্ডিয়া কী ভাবছে? ইন্ডিয়া কী করবে?’ যেন ভারত যা চাইবে ভোটে সেটাই হবে! জনপ্রিয় বিশ্বাস, হাসিনার পাশে ভারত আছে। কারণ, ভারত কিছুতেই চাইবে না উত্তর-পূর্বাঞ্চল ফের অশান্ত হোক।
দেড় বছর পর বাংলাদেশ এলাম। এলাম এমন একটা সময়, যখন গোটা দেশ হন্যে হয়ে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে, অথচ পাচ্ছে না। ফলে কেউ বুঝতে পারছে না বাংলাদেশের নির্বাচনী চরিত্রের রূপ কেমন হতে চলেছে। দেশটার ভাগ্যই-বা কোন খাতে বইতে চলেছে!
হালের বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এককথায় চমৎকার। দুই দেশের সরকারি ভাষ্যে তা ‘সোনালি অধ্যায়’। এর ভিত খোঁড়া হয়েছিল ২০০৯ সালে, শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে। পোক্ত হয়েছে বাঁধন। বর্তমানে ভারতের চোখে বাংলাদেশ ‘অকৃত্রিম বন্ধু ও বিশ্বস্ত প্রতিবেশী’। এই স্বীকৃতি ভারত এমনি-এমনি তাদের দেয়নি। দিতে বাধ্য হয়েছে। হাসিনা তা অর্জন করেছেন। উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে ভারতের মাথাব্যথার স্থায়ী নিরসন তিনি করেছেন। স্থল ও সমুদ্র সীমান্ত নির্ধারণ চুক্তি সম্পাদনে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন। সব ধরনের যোগাযোগ স্থাপনে শরিক হয়ে বাণিজ্য-বৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশের জল-জমি ব্যবহারের বাধা ধীরে ধীরে কাটিয়ে তুলেছেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান রেল যোগাযোগ ফিরে আসছে। ক্ষমতায় আবার এলে তিস্তা-সহ অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ হবে, এমন আশা করা যেতেই পারে।
[আরও পড়ুন: ৩১ বছরের জেল, ১৫৪ ঘা চাবুক খাওয়া নার্গিসের নোবেল জয় নিয়তির মুচকি হাসি]
দেড় দশক আগে বাংলাদেশে সবচেয়ে ঘৃণিত শব্দ ছিল ‘ট্রানজিট’। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ত্রিপুরা, অসম বা মেঘালয়ে পণ্য সরবরাহের ভাবনা ‘আকাশকুসুম কল্পনা’ ছিল। প্রচার হত, ‘ট্রানজিট’ দিলেই বাংলাদেশ ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে যাবে। হাসিনার দৌলতে ‘ট্রানজিট’-এর স্থান নিয়েছে ‘কানেক্টিভিটি’। জল, স্থল, অন্তরিক্ষ কোথাও আজ যোগাযোগের অভাব নেই। এটা সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার সদিচ্ছা, দৃঢ় নেতৃত্ব ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার কারণে। উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা কতটা জরুরি, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ তার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত।
সেই ধারবাহিকতা হাসিনা কি বজায় রাখতে পারবেন? বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় জিজ্ঞাসা এটাই। সংসদীয় নির্বাচন আগামী জানুয়ারির শুরুতেই। সেই ভোট কীভাবে হবে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি না, দেশজোড়া জল্পনা তা নিয়ে। বিরোধীরা নিজেদের দাবিতে অনড়, সরকার পক্ষও নিশ্চল। এই টানাপোড়েনের মুখে কী হয়-কী হয় একটা ভাব হিচককীয় সাসপেন্সের মতো ঝুলে রয়েছে। নির্বাচন ঘিরে এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশে আগে আসেনি।
হাসিনার প্রতি বিরোধীদের আস্থা বিন্দুমাত্র নেই। তারা মনে করে, সরকারের নেতৃত্বে ভোট হলে তা কিছুতেই সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হবে না। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে ২০১৪ সালে বিরোধীরা ভোট বয়কট করে। সেবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামি লিগ ১৫০ আসনে জয়ী হয়। বাকি আসনগুলোয় ভোট হয়েছিল নাম-কা-ওয়াস্তে। ভারত সেই ভোট সমর্থন করেছিল ‘সাংবিধানিক সংকট’ এড়ানোর যুক্তি দেখিয়ে।
পাঁচ বছর আগের ভোটও ছিল ‘প্রহসন’। সেবার বিরোধীরা ময়দান ছেড়ে যায়নি ঠিকই, কিন্তু ভোটও হয়নি! আগের রাতে একের-পর-এক কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ছাপ্পা ভোটে ভরে গিয়েছিল। মোট ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামি লিগ ২৮৮টি জেতায় সংসদ বিরোধীশূন্য হয়ে পড়ে। দিকে দিকে প্রশ্ন উঠেছিল সে নিয়ে। এবার তার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সেজন্য বিরোধীদের সমস্বর দাবি, ভোটের আগে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা সর্বদলীয় সরকার গড়া হোক। কিন্তু সরকার তা মানতে নারাজ। তাদের যুক্তি, সংবিধানে সেই বিধান নেই। তাছাড়া, ভারত-সহ অন্যত্রও ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই ভোট হয়। এখানেও তেমনই হবে। সরকার নিশ্চিত করবে ভোট হবে সুষ্ঠু ও অবাধ।
সরকার ও বিরোধী কোনও পক্ষই দাবি থেকে এক চুল সরার ইঙ্গিত এখনও দেয়নি। চলছে স্নায়ুর লড়াই। এই লড়াইয়ে কে পিছু হটবে কে হটবে না, সেই কৌতূহলের মাঝে প্রবল জল্পনা, সরকার অটল থাকলে বিরোধীরা কি আরও একবার ভোট বয়কটের রাস্তায় যাবে? বয়কট করলে ক্ষতি বিরোধীদেরই। তা জেনেশুনেও কি তারা নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারবে? বিশেষ করে যখন এমন একটা ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে যে, মানুষ ভোট দিতে পারলে আওয়ামি লিগ খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে!
‘ভোট’ যাতে ‘মানুষ দিতে পারে’ সেজন্য পশ্চিমি দুনিয়া তৎপর। অন্যবারের চেয়ে এবারের পরিস্থিতি তাই আলাদা। আগ্রহও প্রবল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বারবার পর্যবেক্ষক পাঠাচ্ছে। সুষ্ঠু, অবাধ ভোটের জন্য চাপ দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। তাতে বলা হয়েছে, সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট না হলে যারা দায়ী থাকবে, তাদের ভিসা দেওয়া হবে না। সেই তালিকায় রাজনৈতিক নেতা, আমলাশাহি, পুলিশ, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সংগঠন, বিচারবিভাগ সবাই রয়েছে। নতুন ভিসা নীতির প্রয়োগও তারা শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রর প্রতি বাংলাদেশের এক বড় অংশের আকর্ষণ দুর্নিবার। বাইডেন প্রশাসন মনে করছে, এই নতুন নীতি ‘ডেটারেন্ট’ হিসাবে কাজ করবে। ভিসা না পাওয়ার শঙ্কা নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ হতে সাহায্য করবে।
ঘটনা হল- এই হুঁশিয়ারি হাসিনা, তাঁর সরকার ও আওয়ামি লিগকে আদৌ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করেনি। হাসিনার পাশাপাশি শীর্ষ নেতারা নিয়মিত বলছেন, আমেরিকার বিরোধিতা সত্ত্বেও দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমেরিকা ভিসা না দিলেও বাংলাদেশের কিছু যায়-আসে না। অতএব, মাভৈ।
কিন্তু সত্যিই কি কিছু যায়-আসে না? এই প্রশ্নের পাশাপাশি বড় জল্পনা ‘ক্ষিপ্ত’ আমেরিকা শেষ
পর্যন্ত কী করবে বা করতে পারে, তা ঘিরে। ভিসা না-দেওয়া একটা ব্যাপার। কিন্তু তাদের চোখে ভোট সুষ্ঠু, অবাধ না হলে তারা কি তাদের বন্ধুদেরও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চালিত করবে? কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে কি চাপ দেবে এমন ব্যবস্থা গ্রহণে? কিংবা তারা কি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে?
[আরও পড়ুন: সাংবাদিকরা আক্রান্ত হলে নড়বড়ে হয়ে ওঠে সত্যি-মিথ্যের ভেদরেখা]
বিশেষ করে বাংলাদেশের গার্মেন্টস বা তৈরি পোশাকের রফতানির উপর? রাষ্ট্র সংঘকে প্রভাবিত করবে শান্তি বাহিনীতে বাংলাদেশের সেনাদের না নিতে? দেশের যে কোনও মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি হলে এই প্রশ্ন অবধারিতভাবে শুনতে হচ্ছে। নির্বাচন ঘিরে এত প্রশ্ন, এমন টানটান উত্তেজনা আগে দেখিনি।
কয়েকটি বিষয় যদিও তর্কাতীত। যেমন, উন্নয়ন। ১৫ বছরের স্থিতিশীলতার দরুন বাংলাদেশের উন্নয়ন ও প্রগতি ঈর্ষাজনক। পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। মঙ্গলবার হাসিনা চালু করলেন সেই সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল। তিন দিন আগে চালু হল ঢাকা বিমানবন্দরের অত্যাধুনিক টার্মিনাল। রাজধানী জুড়ে ডানা মেলেছে একাধিক উড়ালপুল। চালু হয়েছে মেট্রো রেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। উদ্বোধনের অপেক্ষায় কর্ণফুলি নদীর তলদেশে তৈরি দীর্ঘ টানেল। কোভিড সত্ত্বেও এ দেশের প্রবৃদ্ধি স্লথ হয়নি। মাথাপিছু আয়ও ভারতের চেয়ে বেশি। অথচ, এত কিছুর পরেও হাসিনার প্রতি একাংশের রোষ প্রবল।
‘মাত্রাছাড়া দুর্নীতি ও আইনের শাসনের অনুপস্থিতি’-র অভিযোগে বিরোধী মহল ও নাগরিক সমাজের বড় অংশ সরব। কীভাবে তা সামাল দেবেন হাসিনা? প্রশ্ন সেটাও।নির্বাচনী আবহে বড় হচ্ছে এক অন্য কৌতূহল। যেখানেই যাচ্ছি শুনছি, ‘ইন্ডিয়া কী ভাবছে? ইন্ডিয়া কী করবে?’ যেন ভারত যা চাইবে ভোটে সেটাই হবে! জনপ্রিয় বিশ্বাস, হাসিনার পাশে ভারত আছে। কারণ, ভারত কিছুতেই চাইবে না
উত্তর-পূর্বাঞ্চল ফের অশান্ত হোক। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত বিরোধিতা লাগামছাড়া হয়ে উঠুক। বিচ্ছিন্নতাবাদ, মৌলবাদ আবার মাথাচাড়া দিক। তারা-ই হয়ে উঠুক বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক। বিস্ময় এই যে, হাসিনার পক্ষে ভারতের অবস্থানের ধারণা যত দৃঢ় হচ্ছে, তত বাড়ছে ভারত-বিরোধিতার তীব্রতা। এবারের নির্বাচন বাংলাদেশের কাছে এক অন্য সন্ধিক্ষণ হতে চলেছে।