shono
Advertisement
Protest

প্রতিবাদ ও কয়েকটি প্রশ্ন

দলিত, সংখ্যালঘু, চা-শ্রমিকদের নিয়ে অখণ্ড নীরবতা!
Published By: Kishore GhoshPosted: 07:37 PM Sep 16, 2024Updated: 07:37 PM Sep 16, 2024

আর. জি. কর কাণ্ড সংক্রান্ত বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব জুড়ে। এই অপূর্ব অভ্যুত্থান দেখেও প্রশ্ন উঠতে পারে, এর নেপথ্যে কি কোনও ভদ্রবিত্ত চেতনা অন্তঃসলিলা? ভদ্রলোক, মধ‌্যবিত্তর আঁতে ঘা লাগলে তবেই প্রতিবাদ; দলিত, সংখ‌্যালঘু, চা-শ্রমিকদের নিয়ে অখণ্ড নীরবতা– এই কি আমাদের ধর্ম? লিখছেন পরিমল ঘোষ

Advertisement

মাসখানেকের উপর কলকাতা টালমাটাল। আর. জি. কর হাসপাতালে গত ৮-৯ আগস্টের হত‌্যাকাণ্ডের পর থেকে এখনও পর্যন্ত কলকাতা রাত জাগছে, মোমবাতি মিছিলে হঁাটছে, গান বঁাধছে, রাস্তায় আলপনা এঁকে রাখছে। এমনটা শেষ দেখা গিয়েছিল নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর নিয়ে যখন প্রতিবাদ হয়েছিল। আর তখনও মহিলাদের উপস্থিতি এমন বিরাট সংখ‌্যায় ছিল না। লিঙ্গসামে‌্যর প্রশ্নটি এমনভাবে কখনও মিছিলের বিষয় হয়েও ওঠেনি। এই আন্দোলনের অভিঘাত পশ্চিমবাংলার সীমানার বাইরে দেশের অন‌্যান‌্য রাজে‌্যও দেখা গিয়েছে, এমনকী, বিদেশেও। সংবাদপত্রে, দৃশ‌্যমাধ‌্যমে, সামাজিক মাধ‌্যমে– এটাই যেন প্রধানতম খবর। দেশের বাইরেও মানুষে রাস্তায় নেমেছে।

আমার এই লেখার বিষয় কিন্তু অন‌্য। ভাবতে চাইছি, আমাদের নিজেদের নিয়ে, ভদ্রলোক নাগরিক সমাজকে নিয়ে। এই জঘন‌্য ঘটনাকে আমরা কীভাবে নিলাম, কেন-ই বা সেইভাবে নিলাম। উচ্চকিত এই আন্দোলন দেখে ও শুনে মনে হতেই পারে, মানুষ সচেতন হয়েছে, তাই তারা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে।

আমার মনে হয়েছে এই আন্দোলনের অন‌্য আর-একটি দিকও আছে। গোড়াতেই বলে নিই, প্রতিবাদী মানুষকে বিন্দুমাত্র অসম্মান করার কোনও উদ্দেশ‌্য আমার নেই। খুনি(রা) শাস্তি পাক, হাসপাতালগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক, সর্বত্র মহিলাদের সুরক্ষা প্রতিষ্ঠিত হোক, লিঙ্গসাম‌্য ও সমস্ত তৃতীয় লিঙ্গের স্বাধিকার রক্ষিত হোক– এসব আমারও দাবি। কিন্তু তারপরেও কয়েকটা বেসুরো কথা মনে আসছে।

আন্দোলন যত এগিয়েছে, তত মনে হয়েছে, এই প্রতিবাদের এমন দেশ ও বিশ্বজোড়া প্রসার ঘটল কেমন করে? অতীতে ধর্ষণ, বা হত‌্যার প্রতিবাদে রাস্তা রোকো, রেল রোকো, থানা ঘেরাও অনেক হয়েছে এলাকা পর্যায়ে। কিন্তু রাজে‌্যর সীমানা ছাড়িয়ে, এমনকী, দেশের বাইরে ইংল‌্যান্ডে, আমেরিকায়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল‌্যান্ড, কোথায় পড়লাম এমনকী জাপানেও– সোজা কথায় উন্নত বিশ্বের সর্বত্র এই ঘটনার প্রতিবাদ দেখা গিয়েছে, যা বিরল। লক্ষ‌ করুন, প্রতিবাদীদের প্ল‌্যাকার্ডে ইংরেজি ভাষায় লেখা– ‘We want Justice’ বাক‌্যাংশটি। এত বড় দাবি– ‘বিচার চাই’– লিখতে অসুবিধা কোথায়! সব মিলিয়ে মনে হল, এই প্রতিবাদকে স্বতঃস্ফূর্ত যেমন বলা যায়, তেমনই এতে হয়তো চিকিৎসকদের ভাই-বেরাদরির এখানে একটা ভূমিকা আছে। আমাদের ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই অন‌্য পেশায় থাকা মানুষদের মতোই বিদেশে কর্মরত আছেন, সেই সূত্রেই এই প্রসার।

গত ৫ আগস্ট একটি বিজ্ঞাপনও বেরিয়েছে একটি ইংরেজি দৈনিকে কলকাতার মেডিক‌্যাল কলেজের বিদেশে কর্মরত প্রাক্তনীদের এই প্রতিবাদকে সমর্থন জানিয়ে। আর, তঁাদের যে অান্তর্জাতিক পরিমণ্ডল, সেখানে ইংরেজি ভাষায় দাবি তোলা যুক্তিগ্রাহ‌্য মনে হতেই পারে। আন্দোলন শিলিগুড়ি, কি বর্ধমানে ছড়িয়েছে বললে তার যে ভার তৈরি হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়, যদি বলি খাস সাহেবদের দেশেও মানুষ পথে নেমেছে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ কিন্তু এগিয়ে এসেছেন তঁাদের সমর্থন নিয়ে, সে তঁারা ইংরেজি ভাষায় সড়গড় হ’ন কি না-ই হ’ন। ভাল লেগেছে, আবার একটু কষ্টও পেয়েছি। এই সাধারণ মানুষ যঁাদের বললাম– এই টোটো-চালক, এমনকী, রিকশাচালকরাও, তঁাদের ঘরে এমন ঘটনা হলে তঁাদের সম-শ্রেণির মানুষরা রাস্তায় নামবেন জানি, কিন্তু আমরা ভদ্রলোকরাও নামব তো! মোমবাতি মিছিল, ধরনা বা বিদেশেও কি তার প্রতিবাদ হবে?

আমাদের কোরপান শাহ-র নামটা কি আর মনে পড়ে! ২০১৪-য় ১৬ নভেম্বর এনআরএস মেডিক‌্যাল কলেজের হস্টেলের ছাত্ররা এই আধ-পাগলা মানুষটিকে পিটিয়ে খুন করে। পুলিশ তদন্তে এসে সমস‌্যায় পড়েন, কারণ হস্টেলের অন‌্য আবাসিকরা নাকি কিছুই দেখেননি। শেষে আটজন ছাত্র-সহ ১০ জনকে ধরা হয়, সবাই এখন জামিনে মুক্ত। যতদূর জানি, চিকিৎসক মহল তখন কোনও সংগঠিত প্রতিবাদ করেননি, অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের তো কোনও প্রশ্নই ছিল না।

‘ইন্ডিয়ান মেডিক‌্যাল অ‌্যাসোসিয়েশন’-ও কিছু করেছিল বলে শুনিনি। আর কোরপানের পরিবার? একটি দৈনিকে গত ১১ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানলাম, কোরপানের হত‌্যার সময় তঁার আর অারজিনার চার সন্তান, পঞ্চমটি মায়ের পেটে। আরজিনা জরির কাজ করতেন আর মানসিক প্রতিবন্ধী যুবক কোরপান সময়-সময় কলকাতা যেতেন ভিক্ষা করতে। বর্তমানে আরজিনা ডোমজুড়ে একটি বোতলের কারখানায় কাজ করেন। পঁাচ সন্তান নিয়ে মায়ের কাছে চলে এসেছেন, বৃদ্ধা মা ভিক্ষা করেন, নইলে সবার মুখে ভাত জোটানো যাবে না। কোরপান হত‌্যার সময় কিছু অর্থসাহায‌্য পাওয়া গিয়েছিল, কিছুই তার অবশিষ্ট নেই, সামান‌্য কিছু রাখা আছে দুই মেয়ের নামে।

একেবারে হাল আমলের সমগোত্রীয় আর একটি ঘটনার কথা মনে আসছে। এই বছরের ২৮ জুন বউবাজারের একটি ছাত্রদের হস্টেলে ইরশাদ আলম নামের এক টেলিভিশন মেকানিককে পিটিয়ে মারে ছাত্ররা। জনা পনেরোকে পুলিশ ধরেছে, এমনই খবর। এই সূত্রে আরও একটি খবরের কথা মনে আসছে। গত ২৬ আগস্ট একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা গেল কলকাতার একটি লিঙ্গ বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান– ‘সংহিতা’– উত্তর বাংলায় জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও দার্জিলিং জেলার ২৪টি চা-বাগানে– ‘Creating Safe Workplaces: An Engagement with Tea Gardens in West Bengal’– এই গবেষণা প্রকল্পটির সূত্রে কিছু খেঁাজ নিতে গিয়েছিল। দেখা গেল, ‘যৌন হয়রানি’ বলতে কী বোঝানো হয়, তা চা-বাগানের মহিলা শ্রমিকরা জানেনই না, কারণ বিষয়টি তঁাদের কাছে রোজকার ব‌্যাপার, অতএব স্বাভাবিক!

আমরা জানি যে, কোনও ধর্ষণ ও হত‌্যাকাণ্ড একটি ভয়ংকর ঘটনা। আমাদের দেশে কি বিদেশে এমন ঘটনার খবর অহরহ আসে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে যখন অত‌্যাচার ঘটে নিম্নবর্গের বা সংখ‌্যালঘু কোনও সম্প্রদায়ের কোনও মানুষের উপর, আমরা নড়ে বসি না, বলে ফেলি– এমন তো কতই ঘটে! কী করে বলি, সেটাই একটা আশ্চর্যের বিষয়। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে বিদ‌্যা দ্বিবেণী ও সাজ মোহনের লেখা– ‘Indian Philosophy, Indian Revolution: On Caste And Politics’– বইটার কথা। বইটা সম্পাদনা করেছেন মায়েল মন্তেভিল। তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, অতীতের দু’টি একই প্রকৃতির ঘটনা, যা দু’টি পৃথক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। প্রথমটি ২০১২ সালে দিল্লিতে বর্ণহিন্দু একটি মেয়ের উপর যে ভয়ংকর অত‌্যাচার হয়েছিল– যাতে মেয়েটি মারা যায়। আর, দ্বিতীয়টি ২০২০ সালের, উত্তরপ্রদেশের হাথরসে ঠাকুর (ক্ষত্রিয়) সমাজের চারজন একটি দলিত মেয়েকে ধর্ষণ ও হত‌্যা করে। প্রথম ঘটনায় দেশ যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, ধর্ষকদের মৃতু‌্যদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, ও পরের নির্বাচনে কেন্দ্রের শাসক দলের পরাজয়েরও অন‌্যতম কারণ হয়ে দঁাড়িয়েছিল তা। অন‌্যদিকে, হাথরসের ঘটনার তুলনায় প্রায় কিছুই ঘটেনি, ধর্ষক-খুনিদের জামিন পেতে অসুবিধা হয়নি, রাজ‌্য সরকারের পতনেরও কোনও সম্ভাবনা তৈরি হয়নি।

আমাদের পশ্চিমবঙ্গে জাতের লড়াইয়ের চেহারাটা তেমন স্পষ্ট নয়, এখানে ফারাকটা বেশি নজরে পড়ে ভদ্রলোক-অ-ভদ্রলোক (বা ছোটলোকের) মধে‌্য। কোরপান শাহ-রা বা চা বাগানের মহিলা শ্রমিকরা কোনও দিনও ভদ্রলোক সামাজিক বৃত্তের মানুষ হিসাবে গণ‌্য হননি, ফলে তঁাদের ভাল-মন্দ নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। যঁারা ডাক্তারি ছাত্রছাত্রী অধিকাংশই আমাদের মতো ভদ্রলোক/ মধ‌্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়ে। তঁাদের নিয়ে উচাটন তো হবই আমরা, সেটাই তো স্বাভাবিক।

কিন্তু তাহলে নিম্নবিত্ত মানুষদের এই আন্দোলনে অংশগ্রহণের ব‌্যাখ‌্যা কী? তঁারা যোগ দিয়েছেন বিপুল সংখ‌্যায় তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, সে তঁারা ‘Justice’ শব্দটির মানে জানুন কি না-ই জানুন। হতে পারে কিছুটা হুজুগ, আরও হতে পারে একটা ত্রাস– বাবুদের মেয়ের উপর যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের মেয়েদের না জানি কী হতে পারে।

আরও একটি কারণ সম্ভবত সব স্তরের মানুষের মধে‌্য জমে থাকা বিপুল ক্ষোভ, যা এই উপলক্ষে‌ বেরিয়ে আসছে। কোনও সন্দেহ নেই, রাজ‌্য সরকারের নানা জনকল‌্যাণমূলক প্রকল্পের সুবিধা এক বড় সংখ‌্যার মানুষ পেয়েছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে প্রায় সব পর্যায়ের নেতাদের লাগামছেঁড়া লোভও মানুষ দেখেছেন, ও পছন্দ করেননি। যেমন করেননি বিভিন্ন নির্বাচনে জবরদস্তি, যার ফলে দলের সমর্থকরা পর্যন্ত অনেক সময়েই ভোট দিতে পারেননি। মানুষের চোখের সামনেই মন্ত্রীদের বাড়ি থেকে নোটের বান্ডিল বের হচ্ছে, বা তঁাদের নানা রঙের কীর্তিকাহিনি মানুষ মনে রেখেছে। হয়তো এখন তার জবাব দিচ্ছে। এমনটা হয়ে থাকলে তা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রশ্নটা তাও রয়ে যাবে– জনতা এগিয়ে এসেছে, কিন্তু জনতার প্রয়োজনে আমরা, ভদ্রলোকেরা এগব তো!

(মতামত নিজস্ব)
লেখক অবসরপ্রাপ্ত অধ‌্যাপক. কলকাতা বিশ্ববিদ‌্যালয়
parimalghosh52@gmail.com

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • এই বছরের ২৮ জুন বউবাজারের একটি ছাত্রদের হস্টেলে ইরশাদ আলম নামের এক টেলিভিশন মেকানিককে পিটিয়ে মারে ছাত্ররা।
  • আমাদের পশ্চিমবঙ্গে জাতের লড়াইয়ের চেহারাটা তেমন স্পষ্ট নয়, এখানে ফারাকটা বেশি নজরে পড়ে ভদ্রলোক-অ-ভদ্রলোক (বা ছোটলোকের) মধ্যে।
Advertisement