পৃথিবীর যে কোনও বই নিমগ্ন নিঃসঙ্গতার ফসল। অথচ কলকাতা শহরে, সেই নিঃসঙ্গতার ফসলের সমারোহ, অর্থাৎ ‘আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা’ প্রতি বছর তৈরি করে অবিশ্বাস্য জনপ্লাবন, যার প্রায় সবটুকুই বাঙালির হিড়িক, হুজুগ এবং হড়পা! বইমেলার ভিড় এবং তার শব্দদূষণ এমন মাত্রায় পৌঁছয়, তাকে হট্টমেলা না বলে আর উপায় থাকে না। বইমেলায় অধিকাংশ মানুষের চোখে বইয়ের সন্ধান বা তৃষ্ণার চেয়ে অনেক বেশি ধরা পড়ে দিশাহারা ভিড়ের নেশা। আমাদের সংস্কৃতির সবথেকে বড় অসুখ এখন ভিড়ের মত্ততা ও মৌতাত। তা এত দূর সর্বগ্রাসী যে, সদ্যজন্মানো, প্যারামবুলেটর-আশ্রিত বাঙালিও বইমেলার ভিড়ে আসতে বাধ্য বাবা মায়ের মেলা-উন্মাদনার তাড়নায়। এই শিশুদের দিকে তাকিয়ে শীতরাত্রির বইমেলায় দমবন্ধ করা জনারণ্য এবং মাইক-ফাটানো শব্দের মধ্যে সত্যিই মনে হল, কেন জন্ম, কেন নির্যাতন?
এ-কথা ঠিক, কলকাতার সব মেলায় এমন ভিড় হয় না, যেমন ভিড় হয় বইমেলায়। প্রশ্ন হল, এই ভিড় কি সত্যিই বাঙালির গ্রন্থপ্রেমের জন্য? না কি বইমেলার মধ্যে একটি শুকনো তঞ্চক ডাক আছে। সেই ডাক অনিবার্য। তার মূল কারণ, ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি একটি ঢাকনার কাজ করে। বইমেলায় ভিড়ের নেশাতেই যাই, কিংবা কলকাতার নানা রকম সরণিখাদ্যের স্বাদ-আহ্লাদের টানেই যাই, যাচ্ছি কিন্তু বইমেলায়! এই সাংস্কৃতিক আঁচলের আব্রু বাঙালির বড় আরামের আড়াল। এই আড়ালে ঘাপটি মেরে বাঙালি বুঁদ হয়ে থাকতে পারে তার বোধহীন ভিড়ের মৌজে। এই বই-আড়ালকে কাজে লাগিয়ে বাঙালি বইমেলায় বেশ অনায়াসে যেতে পারে শুধুমাত্র রসনার রসে আপ্লুত হতে। বইয়ের পরদা বাঙালির প্রেমচর্চাকেও দেয় হাতে হাত দিয়ে জনপ্লাবনে বিনা লজ্জায় চরে বেড়ানোর সাহস।
[আরও পড়ুন: লোকসভার জন্য কোমর বাঁধছে বিজেপি, আসরে ২১ কুশীলবের ‘টিম মোদি’]
সংস্কৃতি-প্রেমিক বাঙালিকে প্রাত্যহিক একঘেয়েমি থেকে কম খরচে মুক্তির পথও দেখায় বইমেলা। বই পড়ি না-পড়ি, বই কিনি না কিনি, বইয়ের ছুতোয় মেলায় গিয়ে সাংসারিক গণ্ডি থেকে দিনকয়েকের মুক্তি। অথচ উপরি পাওনা, কালচারাল মর্যাদা। বইমেলায় যাওয়াটা অনেক বাঙালির কাছে এইভাবে একটা স্টেটাস-সিম্বলেও পরিণত হয়েছে। প্রাত্যহিক জীবনে যে তেমন বই পড়ার চলন আছে, তা নয়। প্রতিদিন বই পড়েন, বই না হলে চলে না, বই পড়ার আনন্দ জীবনের এক তুরীয় প্রাপ্তি– এমন বইমুখো বাঙালির সংখ্যাও হয়তো বা কমেছে। কিন্তু বইমেলার ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। তা-ই বইমেলার এই থইথইয়ের সঙ্গে বাঙালির বইপ্রেমের তেমন সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না।
[আরও পড়ুন: জ্ঞানবাপী হিন্দুদের দিয়ে দিন, সমীক্ষা রিপোর্ট পেতেই মুসলিম পক্ষের কাছে দাবি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের]
সবচেয়ে মজার ব্যাপার, বই যাঁদের ব্যবসা, যাঁরা বই প্রকাশ করেন, চালান বাংলার বইবাজার, এবং যাঁরাই মূলত তৈরি করেন কলকাতার আন্তর্জাতিক বইমেলা, তাঁদেরই-বা ক’জন সত্যিকারের গ্রন্থপ্রেমী, পড়ুয়া বা স্কলার? বইকে কি তাঁরাই পরিণত করেননি সাংস্কৃতিক হুজুগে?