কেন্দ্রীয় বাজেটে ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়করে ছাড় দিল্লির মধ্যবিত্ত ভোটকে নিয়ে গেল বিজেপির পক্ষে। এঁটে উঠতে পারল না ‘আপ’। তবে আর্থিক সুবিধা ও সামাজিক নিশ্চয়তা দিয়ে যে মধ্য ও নিম্নবিত্তর ভোট টানা যায়, তা তো কেজরিওয়ালই দেখিয়েছিলেন। এবার সে-অস্ত্র কাজে দিল না যদিও। লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
দিল্লির ভোটে আপ ও কংগ্রেসের তীব্র লড়াই অবশ্যই বিজেপির সহজ জয়ের অন্যতম কারণ। ১৩টি আসনে আপের পরাজয়ের ব্যবধান কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোটের থেকে কম। যদিও তার থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না যে, এই ১৩টি আসনে কংগ্রেস প্রার্থী না-থাকলে আপ জিতে যেত। এক দলের ভোট আর-এক দলের কাছে যাওয়া– তথা ভোট ট্রান্সফার– সরল পাটিগণিতের নিয়মে হয় না। এক্ষেত্রে একটি রসায়ন কাজ করে। কংগ্রেসের তরফেও দাবি করা হয়েছে– তারা যে-ভোট পেয়েছে– সেটা আপ-বিরোধী ভোট। ফলে আপ ও কংগ্রেস জোট হলে, কে কত শতাংশ ভোট পেতে পারত, সেটা একমাত্র নতুন রসায়নই বলতে পারত।
মাত্র আট মাস আগে, লোকসভা নির্বাচনে, আপ ও কংগ্রেস জোটের ভোট ছিল ৪৩ শতাংশ। বিধানসভা নির্বাচনে আপ ও কংগ্রেস আলাদা-আলাদা লড়ে ভোট পেল ৫০ শতাংশ। জোট হলে বিধানসভা নির্বাচনেও এই ভোট কমতে পারত। আপ-বিরোধী যে-ভোট কংগ্রেস পেয়েছে, সেটা বিজেপির দিকে যেতে পারত। আবার আপের কিছু কংগ্রেস-বিরোধী ভোট রয়েছে। তারা তখন জোটকে ভোট না-ও দিতে পারত। উল্টোদিকে, জোটের রসায়ন দু’-দলের ভোট বাড়িয়ে দিতে পারত। দিল্লির ক্ষেত্রে বলা হয়, ৩৫ শতাংশ ভোটার দোদুল্যমান। এই ভোটারদের উপর প্রচারের প্রভাব থাকে। আপ-কংগ্রেস জোট হলে বিজেপি-বিরোধী প্রচার অক্সিজেন পেত। এই দোদুল্যমান ভোটাররা গত তিনটি লোকসভা ভোটে বিজেপির পক্ষে ভোট দিয়েছে। কিন্তু বিধানসভা ভোটে অাপের পক্ষে ভোট দিয়েছে। এবারও প্রাথমিকভাবে দিল্লিতে তেমনটা হবে বলেই রাজনৈতিক মহলের ধারণা ছিল।
কেজরিওয়ালের হারের কারণ হিসাবে আবগারি দুর্নীতির অভিযোগ, জেলে যাওয়া, যমুনা নদী ও দিল্লির বাতাস দূষণমুক্ত করতে ব্যর্থ হওয়া, শহর পরিষ্কার রাখতে না-পারা ইত্যাদি যেসব ব্যাখ্যা সংবাদমাধ্যমে অাসছে– তা ভোটের অাগে– বিশেষ শোনা যায়নি। অথবা, শোনা গেলেও এই কারণগুলি কেজরির ভোটে হেরে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট কারণ বলে মনে করা হয়নি। কারণ, কেজরির যেটা ‘দিল্লি মডেল’ তা এবারও তঁাকে গরিব-মধ্যবিত্তর পর্যাপ্ত ভোট এনে দেবে বলে বিজেপির শীর্ষ নেতাদেরও ধারণা ছিল। কেজরির ‘দিল্লি মডেল’ হল গরিব-মধ্যবিত্তর জন্য ঢালাও কল্যাণমূলক প্রকল্পর ব্যবস্থা। একটি বিখ্যাত সমীক্ষক সংস্থার হিসাবে, গরিব মহিলাদের মাসিক ভাতা, বিনামূলে্য বিদু্যৎ, বিনামূলে্য জল, সরকারি বাসে মহিলা ও পড়ুয়াদের বিনামূলে্য পরিষেবা, মেট্রোর টিকিটে পড়ুয়াদের ৫০ শতাংশ ছাড় ইত্যাদি মিলিয়ে কেজরির সরকার প্রতিটি গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারে মাসে নূ্যনতম পঁাচ হাজার টাকা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এর সঙ্গে রয়েছে স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য পরিচ্ছন্ন মহল্লা ক্লিনিক এবং সরকারি স্কুলগুলির পরিকাঠামো ও মানের উল্লেখযোগ্য উন্নতি। গরিব ও মধ্যবিত্তর অনিশ্চিত জীবনে সরকারের এই গ্যারান্টিটার ভূমিকা বিশাল।
‘দ্য সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিজ’-এর (সিএসডিএস) হিসাবে, দিল্লির প্রায় সাড়ে তিন কোটি বাসিন্দার ৬০ শতাংশই গরিব ও মধ্যবিত্ত। এর অাগের তিনটি বিধানসভা ভোটে কেজরিওয়াল এই গরিব ও মধ্যবিত্তর ৬৮ শতাংশের সমর্থন পেয়েছেন। এবারও তার ব্যত্যয় হওয়ার কোনও কারণ দেখছিল না রাজনৈতিক মহল। বিজেপিও যে প্রচারপর্বে কেজরির এই দৃঢ় সমর্থনভিত্তির সামনে অসহায় ছিল, তা বোঝা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণে এবং বিজেপির তিন পর্বে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইস্তাহার ঘোষণা থেকে। মোদি তঁার ভাষণে দিল্লির গরিব ও মধ্যবিত্তকে বারবার এই বলে অাশ্বস্ত করেছেন যে, তঁারা ক্ষমতায় এলেও অাপের কোনও কল্যাণমূলক প্রকল্প বন্ধ হবে না। উলটে অতিরিক্ত দেওয়া হবে। যেমন গরিব মহিলাদের মাসিক ভাতা বিজেপি ২১০০ থেকে বাড়িয়ে ২৫০০ টাকা করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে। বিজেপি অতিরিক্ত অারও কী-কী দেবে তা তিন খণ্ডে প্রকাশ করেছে।
কিন্তু তাতেও চিঁড়ে ভিজছিল না। কেন্দ্রীয় বাজেটে আয়কর ছাড়ই বিজেপির তুরুপের তাস হল। বলা যেতে পারে, দিল্লির ভোটে জয় দিয়ে কেন্দ্রীয় বাজেটের প্রথম লাভ ঘরে তুলল বিজেপি। ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়করে ছাড় যে একেবারে শেষ মুহূর্তে ম্যাচটা কেজরিওয়ালের হাতছাড়া করে দিল, তা নিয়ে সংশয় নেই। বিজেপি নেতারাও স্বীকার করছেন যে, ১ ফেব্রুয়ারির আগে পর্যন্ত বিভিন্ন সমীক্ষাতে দিল্লিতে তঁাদের আসন সংখ্যা ৩০-৩২ এর উপর উঠছিল না। বাজেটের পরমুহূর্ত থেকে খেলা ঘুরতে শুরু করে। ভোটের নির্ঘণ্ট তৈরির ক্ষেত্রে কেন্দ্রের শাসক দলের একটা অলিখিত ভূমিকা থাকে। দিল্লির ভোট নির্ঘণ্ট থেকেই স্পষ্ট ছিল যে, বাজেটকে হাতিয়ার করবে বিজেপি। বাজেটের চার দিন পরেই ভোট। ফলে সেই হাতিয়ারকে মোকাবিলা করার সময় পাবে না অাপ। অায়করে ছাড় ঘোষণা করে সেই অস্ত্রটাই খেলে দিয়েছে বিজেপি। কেজরির বিভিন্ন প্রকল্প যদি দিল্লির গরিব ও মধ্যবিত্তর ঘরে মাসে হাজার পঁাচেক টাকার সুবিধা পৌঁছে দেয়, তাহলে অায়করের ছাড়ও কম-বেশি একইরকম সাশ্রয় এনে দিয়েছে মধ্যবিত্তর ঘরে।
কেজরি, বিজেপির কাছে, ১০ হাজারের কম ব্যবধানে, হেরে গিয়েছেন ১৬টি অাসনে। লড়াই যে সমানে-সমানে হয়েছে, তা বলা বাহুল্য। কংগ্রেসের ভোট কাটাকুটির পরেও হয়তো কেজরি কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতেন। কিন্তু নির্মলা সীতারমণের বাজেট কফিনে শেষ পেরেক মেরে দিয়েছে। বিজেপির থেকে মাত্র ২.২৯ শতাংশ ভোট কম পেয়ে হেরে যেতে হল কেজরিকে। অাপের বিরুদ্ধে বিরাট প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া থাকলে হারের ব্যবধান অারও বেশি হতে পারত। সেটা ঘটেনি। যদিও গত বিধানসভা ভোটের হিসাব ধরলে অাপের ভোট ১০ শতাংশ কমেছে। অাবার এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, আট মাস অাগে লোকসভা ভোটে কংগ্রেস ও অাপ জোট ৪৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।
আট মাসের ব্যবধানে অাপের ভোট অন্তত তার চেয়ে বেড়েছে। বিধানসভায় অাপ ও কংগ্রেসের ভোট কাটাকাটি না-হলে বিজেপির হার নিশ্চিত ছিল। ভোট কাটাকাটির পরেও বিজেপির হারের সম্ভাবনা ছিল, যদি না অায়কর ছাড়ের বিষয়টি না অাসত। বোঝাই যাচ্ছে, এবার থেকে বিজেপি অন্য রাজে্যর ভোটেও কেন্দ্রীয় বাজেটকে এইভাবে হাতিয়ার বানানোর চেষ্টা করবে। অার্থিক সুযোগ-সুবিধা ও নিশ্চয়তা প্রদানই যে মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষের ভোট টানার এখন সবচেয়ে বড় অস্ত্র, এটা তো কেজরির রাজনীতিরই শিক্ষা। ফলে, কেজরি হেরে গেলেও, তঁার রাজনীতি কিন্তু থাকছে।