সম্প্রতি, প্রকাশিত রাজ্যগুলির তুলনামূলক আর্থিক পারফরম্যান্স রিপোর্টে বলা হচ্ছে, গত ৬৩ বছরে সেই রাজ্যগুলিই জাতীয় আয়ে অবদান ও মাথাপিছু আয়ের নিরিখে পিছিয়েছে, যারা যথেষ্ট পরিমাণে শিল্পায়নকে আলিঙ্গন করেনি। কতটা যুক্তিযুক্ত? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অর্থনৈতিক উপদেষ্টামণ্ডলীর দুই সদস্য রাজ্যগুলির তুলনামূলক অার্থিক পারফরম্যান্স নিয়ে যে-রিপোর্টটি প্রকাশ করেছেন, তা যথেষ্ট অালোড়ন তৈরি করেছে। যদিও সঞ্জীব সান্যাল ও অাকাঙ্ক্ষা অরোরা নামে যে দুই অর্থনীতিবিদ এই রিপোর্টটি তৈরি করেছেন, তঁারা মুখবন্ধে জানিয়েছেন যে, তঁাদের রিপোর্টের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের দায় নেই। এটা সম্পূর্ণত তঁাদের ব্যক্তিগত উদে্যাগেই রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে। মাত্র ১৭ পাতার রিপোর্টটি ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে এটি ডাউনলোড করে পড়ে ফেলা কোনও সমস্যা নয়।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা রিপোর্টটি বাজারে এনেছেন বলে ইতিমধে্য বিরোধীরা সমালোচনা শুরু করেছে। পর পর বেশ কয়েকটি রাজে্য বিধানসভা ভোট রয়েছে। তাই ভোটের রাজনীতিকে মাথায় রেখে হঠাৎ এরকম একটি রিপোর্ট প্রকাশের প্রয়োজন হল কি না, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। রিপোর্টটিতে ১৯৬০-’৬১ সাল থেকে ২০২৩-’২৪, এই ৬৩ বছরের মধে্য দেশের রাজ্যগুলির অর্থনৈতিক পারফরম্যান্সের তুলনা করা হয়েছে। কেন ১৯৬০-’৬১-কে শুরুর বছর হিসাবে বেছে নেওয়া হল, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জানানো হয়েছে, দেশে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৭ সালে। তারাই প্রথম একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ বানিয়ে ঠিক করে যে, কোন পদ্ধতিতে রাজ্যগুলির অার্থিক অগ্রগতিকে পরিমাপ করলে পরস্পরের মধে্য তুলনা করা যাবে। তাই রাজ্যগুলির মধে্য তুলনা করা সম্ভব এমন অার্থিক পরিসংখ্যান ১৯৬০ সালের অাগে পাওয়া যায় না। এই কাজটি করতে গিয়ে তঁারা কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রক থেকেই সব তথ্য নিয়েছেন বলে দুই উপদেষ্টা জানিয়েছেন।
রাজ্যগুলির তুলনামূলক অার্থিক পারফরম্যান্স পরিমাপ করা হয়েছে দু’টি মাপকাঠিতে। একটি হল, জাতীয় অায়ের ক্ষেত্রে কোনও রাজে্যর তুলনামূলক অবদান কত। দ্বিতীয়টি হল, জাতীয় গড়ের অনুপাতে রাজ্যগুলির তুলনামূলক মাথাপিছু অায়। প্রথমটি হিসাব করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজে্যর মোট বার্ষিক উৎপাদনকে ভাগ করা হয়েছে সবক’টি রাজে্যর বার্ষিক উৎপাদনের যোগফল দিয়ে। দ্বিতীয় মাপকাঠিটি পরিমাপ করার ক্ষেত্রে রাজে্যর মাথাপিছু অায়কে ভাগ করা হয়েছে নিট জাতীয় অায়ের নিরিখে মাথাপিছু অায় দিয়ে।
দু’টি মাপকাঠি পরিমাপের ক্ষেত্রেই কোনও জটিলতায় যাওয়া হয়নি। পরিসংখ্যান তত্ত্বর কোনও জটিল ধারণার অাশ্রয় নেওয়া হয়নি। এখন অধিকাংশ রাজে্যর অসংখ্য মানুষ ভিনরাজে্য বা ভিনদেশে কাজ করে। তারা অনেকেই বাড়িতে প্রতি মাসে বা বছরে অায়ের একটা অংশ পাঠায়। জটিলতার কারণে কোনও রাজে্যর অায়ের সঙ্গেই এই প্রেরিত অর্থ তথা রেমিট্যান্সকে হিসাব করা হয়নি। যদিও কেরল, বিহার বা উত্তরপ্রদেশের ক্ষেত্রে তাদের রাজে্যর পরিযায়ী শ্রমিক বা কর্মীদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ বিপুল। রিপোর্টটির মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে যে বার্তাটি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে, সেটি যাতে সহজে দেওয়া যায়, সেই লক্ষে্যই সম্ভবত রাজ্যগুলির মধে্য তুলনার মাপকাঠিকে অত্যন্ত সরল রাখা হয়েছে।
রিপোর্টটি অতি সারলে্যর দোষে দুষ্ট কি না, তা বিশেষজ্ঞরা ভাল বলতে পারবেন। তবে রিপোর্টটিতে চোখ বোলালে খুব সহজে গত সাড়ে ছয় দশকে দেশের কোন রাজ্য অর্থনীতির ক্ষেত্রে কেমন কাজ করেছে, তার একটা ছবি ফুটে ওঠে। অর্থাৎ কে এগিয়েছে অার কে পিছিয়েছে– তার একটা তুলনামূলক চেহারা কিছুটা পাওয়া যায়। সেদিক থেকে রিপোর্টটি উৎসাহব্যঞ্জক। ১৯৯১ সালের অার্থিক উদারীকরণকে একটা মাইলফলক হিসাবে রিপোর্টে দেখা হয়েছে। ওই সময়ের পর থেকে দেশের কোন কোন রাজে্যর অার্থিক বৃদ্ধির হার বেশি তা দেখার চেষ্টা হয়েছে। মনমোহন সিং ১৯৯১ সালে অার্থিক উদারীকরণের নীতি রচনা করার পর দেশে শিল্প ও পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে লাইসেন্স ও পারমিট রাজ উঠে যায়। বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জে্যাতি বসু সে-সময় লাইসেন্স ও পারমিট রাজ চলে যাওয়ার সুযোগ গ্রহণের ডাক দিয়েছিলেন। সিপিএম নতুন শিল্পনীতি তৈরি করেছিল। কিন্তু রিপোর্টে স্পষ্ট, এ রাজে্যর তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার অার্থিক উদারীকরণ নীতির সুযোগ নিতে পারেনি। তাদের অামলে রাজে্যর ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ার যে ধারার সূচনা ঘটেছিল, তা ১৯৯১-এর পরেও বিদ্যমান থাকে।
রিপোর্টটিতে দেখা গিয়েছে, অার্থিক উদারীকরণের সুযোগ সবচেয়ে ভালোভাবে গ্রহণ করেছে দক্ষিণের রাজ্যগুলি। ১৯৯১-এর অাগে দক্ষিণের রাজ্যগুলির মাথাপিছু অায় জাতীয় গড়ের চেয়ে কম ছিল। কিন্তু উদারীকরণের পর দক্ষিণের রাজ্যগুলির চেহারা বদলাতে থাকে। শিল্পায়ন ও নগরায়নের সুবিধা সবচেয়ে বেশি তারা গ্রহণ করে। ২০২৩-’২৪ সালে মাথাপিছু অায়ের নিরিখে জাতীয় গড়ের চেয়ে তেলেঙ্গানা ৯৩.৬ শতাংশ, কর্নাটক ৮০.৭ শতাংশ, তামিলনাড়ু ৭১.১ শতাংশ, কেরল ৫২.৫ শতাংশ এবং অন্ধ্রপ্রদেশ ৩১.৬ শতাংশ এগিয়ে। এখন মাথাপিছু অায়ের যে সর্বভারতীয় র্যাঙ্কিং, তাতে বড় রাজ্যগুলির মধে্য তেলেঙ্গানা দ্বিতীয় স্থানে এবং কর্নাটক তৃতীয় স্থানে। প্রথম দিল্লি। ১৯৬০ সালেও দিল্লি মাথাপিছু অায়ে দেশে প্রথম ছিল, এখনও তাই অাছে।
সে-সময় দ্বিতীয় স্থানে মহারাষ্ট্র, তৃতীয় স্থানে পশ্চিমবঙ্গ ও চতুর্থ স্থানে পাঞ্জাব ছিল। দিল্লির বাসিন্দাদের অধিকাংশ যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী, তাই সেখানে মাথাপিছু অায় দেশের অন্য রাজে্যর তুলনায় বেশি। তবে ছোট রাজ্যগুলি ধরলে এখন মাথাপিছু অায়ে সিকিম সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। সিকিমের মাথাপিছু অায় জাতীয় গড়ের তিন গুণের বেশি। দক্ষিণের পঁাচটি রাজে্যর সম্মিলিতভাবে জাতীয় অায়ে অবদান বর্তমানে ৩০ শতাংশ। ১৯৬০ সালে জাতীয় অায়ে অবদানের নিরিখে প্রথম পঁাচটি রাজ্য ছিল উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু এবং বিহার। এই পঁাচটি রাজ্য মিলিয়ে জাতীয় উৎপাদন ছিল ৫৪ শতাংশ। ১৭ পাতার রিপোর্টটিতে দেখানো হয়েছে গত ৬৩ বছরে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ-সহ উত্তর, মধ্য ও পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি জাতীয় অায়ে অবদান ও মাথাপিছু অায়ের নিরিখে তুলনামূ্কভাবে পিছিয়ে গিয়েছে। পিছিয়েছে পাঞ্জাবও। পিছিয়ে যাওয়ার কারণ হিসাবে এই রাজ্যগুলিতে শিল্পায়ন ও নগরায়ন যথেষ্ট পরিমাণে না হওয়াকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
এই রাজ্যগুলির জনসংখ্যাবৃদ্ধির হারের দিকটি সম্পর্কে অবশ্য রিপোর্টে নীরব থাকা হয়েছে। মাথাপিছু অায়ের ক্ষেত্রে সেটা একটা বড় ফ্যাক্টর। মহারাষ্ট্র ও গুজরাত তুলনায় তেলেঙ্গানা ও কর্নাটকের থেকে পিছলেও মোটের উপর ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। ২০০০ সালের পর গুজরাট তুলনামূলকভাবে মহারাষ্ট্রের থেকে এগিয়ে গিয়েছে। রিপোর্টে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তুলনা পাঞ্জাব ও হরিয়ানার মধে্য। ছয়ের দশকে অালাদা হওয়ার পর দু’টি রাজে্যর অার্থিক অবস্থা একইরকম ছিল। সাতের দশকে সবুজ বিপ্লবের পরে দু’টি রাজে্যই মাথাপিছু অায় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছিল। সে-সময় জাতীয় অায়েও রাজ্য দু’টির অবদানও একই হারে বাড়ে। কিন্তু ১৯৯১-এর পর এসে পাঞ্জাব ক্রমশ পিছতে থাকে। শিল্পায়ন ও নগরায়নের সুযোগ নিয়ে দ্রুত এগতে থাকে হরিয়ানা। গুরুগ্রামের মতো শহর ও ফরিদাবাদের মতো শিল্পাঞ্চল হরিয়ানার মাথাপিছু অায় ও জাতীয় উৎপাদনে অবদান অনেক বাড়িয়ে দেয়। তুলনায় কৃষিপ্রধান পাঞ্জাব পিছিয়ে যায়। বর্তমানে পাঞ্জাবের জাতীয় অায়ে অবদান ও মাথাপিছু অায়, দুটোই ১৯৯১ সালের তুলনায় কম। অর্থাৎ কৃষিকে অগ্রাধিকারে রেখে পাঞ্জাব যে ক্রমশ পিছচ্ছে, তা রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে।
রাজ্যগুলির তুলনামূলক পারফরম্যান্স সামনে রেখে রিপোর্টে মোদ্দা যে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, তা হল, ১৯৯১ সালের পর দক্ষিণ ভারত ও উপকূলের রাজ্যগুলি দ্রুত অার্থিক দিক থেকে এগিয়ে চলেছে। ১৯৯১-এর পর হরিয়ানার মতো যারা অাগ্রাসী শিল্পনীতি এবং গুরুগ্রামের মতো ঝঁা-চকচকে শহর তৈরির নীতি গ্রহণ করেছে, তারা এগচ্ছে। হায়দরাবাদের অাধুনিকীকরণ ও রাতারাতি সাইবারাবাদ তৈরি করে তেলেঙ্গানাও দ্রুত এগিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি-সহ সার্বিক শিল্পায়নের সুবিধা পুরোমাত্রায় নিয়েছে কর্নাটক ও তামিলনাড়ুও। কিন্তু শিল্পায়ন ও নগরায়নকে একমাত্র অগ্রাধিকারের জায়গায় না রেখে অন্যান্য সামাজিক বিষয়গুলিকে প্রাধান্য দিয়ে যারা চলেছে, তারা ততটা সুবিধা করতে পারেনি। রিপোর্টের এই বার্তা নিয়ে যে বিতর্ক চলবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।