মহাজনের ঋণ মেটাতে ছেলেকে বিক্রি করতে উন্মুখ দীন-দরিদ্র দম্পতি। দেশের ঘুণ-ধরা আর্থিক অবস্থার তলায় আরও কোন দুঃসহ ছবি ঢাকা?
খবরটি ছবি-সহ ছেপে বেরিয়েছে সংবাদপত্রে। সমস্ত দেশের পক্ষে মর্মান্তিক এবং অপরিমেয় লজ্জার খবর। ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে। পড়ার আগে খবরের সঙ্গে ব্যবহৃত ছবিটার দিকে নজর যায়। এক মধ্যবয়সি মানুষ কী অসহায় করুণ অবস্থায় রাস্তায় বসে আছেন তাঁর গলায় হিন্দিতে হাতে লেখা অবিশ্বাস্য তবু সত্য একটি নির্মম ঘোষণা ঝুলিয়ে। ঘোষণাটি এই: তিনি তাঁর ছেলেকে বিক্রি করতে চান। ছবিতে রাস্তার উপরে বসে সেই বালক, যাকে তার বাবা বিক্রি করতে চাইছেন এবং পাশে বালকটির মা, যিনি তাকে বুকে করে বড় করেছেন।
কেন ছেলেটির বাবা-মা তাঁদের এই আদরের ধনকে বিক্রি করতে চাইছেন, বা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন?
উত্তরটি খুবই সংক্ষিপ্ত: পেশায় রিকশাচালক এই বাবা অভাবের যন্ত্রণায় এবং ঋণের দায়ে জর্জরিত। ওই দীন দরিদ্র হতভাগ্য দম্পতি বুঝতে পেরেছেন যদি কোনও সহৃদয় মানুষ তাঁদের ছেলেটিকে কিনে নেন, তবেই তাঁরা জনৈক মহাজনের নিত্যশাসানি, অত্যাচার, অপমান থেকে বাঁচার হয়তো একটা পথ পেলেও পেতে পারেন। এই মহাজনের কাছে তাঁরা একদা কিছু টাকা ধার করেছিলেন সত্য। কিন্তু সেই ধার সুদে-আসলে এবং মহাজনের পেশাদার কারচুপিতে নাকি পৌঁছেছে ছয়-সাত লাখে! সুতরাং নির্যাতিত ওই দরিদ্র স্বামী-স্ত্রী তাঁদের ছেলেকে বিক্রি করে মহাজনের অত্যাচার থেকে বাঁচতে চাইছেন।
এই নিষ্ঠুর বাস্তবের সামনে মাথা কি নত হয়ে যায় না সমস্ত ভারতের? মিথ্যা কি হয়ে যায় না আমাদের দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের রঙিন স্বপ্ন এবং প্রসারিত প্রচার? নিজেদের কি প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে না- পায়ের নিচে সত্যিই কি মাটি রয়েছে আমাদের? প্রতিদিন আমাদের গর্বিত নেতানেত্রীর মুখে যে রঙিন দেশবার্তার রূপকথা শুনি, কতটুকু তার সারবত্তা, সে বিষয়ে ক্রমশই যে ঘনিয়ে উঠছে সংশয়ের কালো মেঘ।
[আরও পড়ুন: শান্তিনিকেতনকে ‘ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে’র স্বীকৃতি আমাদের আশ্বস্ত করে]
কী এসে যায় সেই দেশের নাম ‘ভারত’ না ‘ইন্ডিয়া’, যে দেশে বাবা-মা দারিদ্র ও মহাজনের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ধুলোমাখা পথে বসে সন্তানকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন! কী এসে যায় দেশজুড়ে শহরের রাস্তায়-রাস্তায় ভোগবাদী (শপিং) ‘মল’-মহিমার এই অবাস্তব প্রসারে, যখন দেশের জ্বলন্ত বাস্তব হল অধিকাংশ মানুষের অসহনীয় দারিদ্র, যার চাপে ক্রমশ বাড়ছে আত্মহত্যা, সাংসারিক অশান্তি ও অসহায়তা, সামাজিক চাপ ও বিক্ষোভ?
‘ক্রমাগ্রসরমান’ ভারতের এই ছবি করাল বাস্তব বই তো নয়। আর এই বাস্তব রীতিমতো হাড়হিম করা। বলতে সংকোচ নেই, ভয় হচ্ছে, এই তো সবে শুরু। ভারতের ঘুণ-ধরা আর্থিক অবস্থার তলানিতে আরও দুঃসহ ছবি ঢাকা আছে? থাকলে আর কতটা নিঠুর তা? এর থেকেও বেশি কিছু কি?