বিজ্ঞান স্মৃতি বানাতে পেরেছে, এআই বানাতে পেরেছে, এখনও ভাষা বানাতে পারেনি। মানুষ পাতার মর্মর, জলের কল্লোল, ঝড়ের দাপট, পাখির শিস থেকে ভাষা বানিয়েছে, আমরা যেন তার গভীরতাকে সম্মান করতে পারি। লিখলেন সুবোধ সরকার।
বাংলা ভাষা ‘ধ্রপদী’ হল। তার বেনিফিশিয়ারি হবে কোচবিহার থেকে ক্যালিফোর্নিয়া। যেখানে-যেখানে দুর্গাপুজো আছে, দুব্বো আছে, সেখানে-সেখানে বাংলা ভাষা আছে। সারা পৃথিবীর বাঙালি দুর্গাপুজো করে, আফ্রিকাতেও করে, সীমিত যে দু’-একজন করে না, তাদের কারণ আছে। আমরা যেন ব্যতিক্রমকে সম্মান করতে পারি।
বাংলা ভাষার একজন যৎসামান্য লেখক হিসাবে এই দিনটার জন্য এত দিন টাইগার হিলে দঁাড়িয়েছিলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখব বলে। মুকুন্দপুর বাজারে নিমপাতা আর দুব্বো নিয়ে বসে থাকা ৬৫ বছরের বৃদ্ধের সঙ্গে আমার একটা মারাত্মক মিল আছে– বৃদ্ধ প্রতিদিন সকালে বলেন, ‘আমার দুব্বো আমার নিমপাতা নিয়ে যাও গো’। প্রতিদিন সকালে আমি আমার টেবিল পেতে বসে আছি, যদি আমি একটা দুব্বো লিখতে পারি, যদি একটা নিমপাতা লিখতে পারি। আমাদের দু’জনের বেঁচে থাকার ভাষা– বাংলা। যদি কাল আমাদের মুখ থেকে বাংলা ভাষাকে সরিয়ে নেওয়া হয়, আমরা দু’জনেই মারা যাব।
আমি এবং দুব্বোবিক্রেতা কিন্তু দু’জন নই, আমাদের মাঝখানে যদি একটা ‘হাইফেন’ টানা যায়, তাহলে দেখা যাবে, হাইফেনের উপর সাড়ে নয় কোটি বাঙালি দঁাড়িয়ে আছে– যারা বাংলা ছাড়া আর কোনও ভাষা জানে না। বাঙালির ইংরেজি অনেকটা ওয়াশিং মেশিনের মতো? ক’টা বাড়িতে আছে? ওয়াশিং মেশিন যতই বিজ্ঞাপন করুক, গণেশের মা-কে হারাতে পারবে না। বাংলা ভাষা ক্যানিং লোকালে বেঁচে থাকে, এয়ারপোর্টে বেঁচে থাকে না। রানওয়ে ধরে ছুটন্ত বোয়িং বিমান কোনও বুনিয়াদি বিদ্যালয় নয় যে আপনি বাংলা শেখাবেন। যে-ক’জন প্লেনে উঠতে পারে, যে-ক’জন সিঙ্গল মল্ট খেতে পারে, যে-ক’জন হানিমুনে মরিশাস যেতে পারে, তারা কোনও দিন বাংলা লিখতে না-পারার জন্য দুঃখ পায়নি। তারা ‘সেমিকোলন’। থাকলেই-বা কী, আর না থাকলেই-বা কী? কেননা তাদের একটা অভিজাত আত্মপ্রবঞ্চনা আছে– ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’। আসবে কী করে? আপনি ডেকেছেন? না ডাকলে একজন কানা মেয়েও আপনার জীবনে আসবে না। বাংলা ভাষা কেন আসবে, সে তো চল্লিশ পেরিয়েও রম্ভা।
বাংলা ভাষাকে যারা অসম্মান করে রতিস্নান করে, তাদের কাছে খবরটা সুখের না-ও হতে পারে। তাদের ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ ত্বকে কণ্ডুরোগ হতে পারে। তাদেরই একজন আমাকে বললেন, কী হবে ধ্রুপদী দিয়ে? কোন কাজে আসবে? আমি ক্রোধ সংবরণ করে বললাম, পার্ক স্ট্রিটের সব দোকানে বাংলায় সাইনবোর্ড ঝুলছে, বাবা-মায়েরা ইংলিশ মিডিয়াম ছাড়িয়ে বাংলা মাধ্যম স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে ছেলেমেয়েদের, সব ডাক্তার বাংলায় প্রেসক্রিপশন লিখছে, আইন-আদালত সব বাংলা বলছে। আপনি কি এরকম দুর্দিন চান? আমি চাই না। ইংলিশ মিডিয়াম থাক। আইন-আদালত ইংরেজি বলুক। ডাক্তার ইংরেজিও লিখুক। একশো বছর আগেও তারা লিখেছে, একশো বছর পরেও তারা লিখবে। কিন্তু এতে বাংলা ভাষা মরে যায়নি। ‘ইউনেস্কো’ বাংলা ভাষাকে পঞ্চম ভাষা রূপে ঘোষণা করে দিয়েছে বহু বছর আগে। তাতেও অনেক বাঙালির ক্ষোভ। কী হল আমাদের– পঞ্চম ভাষা হয়ে? এবার একটা ছোট মুখে বড় কথা বলি। সত্যজিৎ রায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট পেয়েছিলেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট প্যারিস থেকে উড়ে এসে আলিপুরের ন্যাশনাল লাইব্রেরির সিঁড়িতে নেমে সত্যজিতের গলায় ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সিভিলিয়ন সম্মান লিজিয়ন দ্য অনার পরিয়ে দিয়েছিলেন। এসব মোহর নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলে, সেসব ঘোষ-বোস, গুহ-মিত্রকে আমি বাঙালি বলে মনে করি না। তারা এক ধরনের গ্লোবাল ভুষিমাল।
কতগুলি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চেয়ার প্রফেসর পদ তৈরি হবে বাংলার নামে, কতগুলো গবেষণা কেন্দ্র হবে, বিদেশে কোথায় কোথায় বাংলা পড়ানো হবে, সেসব তো আছেই, কিন্তু আমার কাছে অনেক বড় ঘটনা হবে– যখন গ্রাম-শহরের ছেলেমেয়েরা গর্ব করে বলবে আমার মাতৃভাষা বাংলা। ছোটবেলা থেকে এই অস্মিতা যদি অলংকার হতে পারে, তাহলে তারা অন্য ভাষাকেও সম্মান করতে পারবে। ইংরেজি কিংবা হিন্দি আমাদের শত্রু নয়। বাংলা ভাষাকে ছড়িয়ে দিতে হলে ইংরেজি-হিন্দি এমনকী চিনা ভাষাকেও পাশে চাই। অত্যাচারীর ভাষা সবচেয়ে তাড়াতাড়ি ছড়ায়। কলোনির মাধ্যমে। অত্যাচারী ইংরেজ যত কলোনি স্থাপন করেছে তত তাদের ভাষা ছড়িয়ে পড়েছে। ত্রিনিদাদ থেকে সজনেখালি তার ইতিহাস ধরে আছে। বাঙালি তো আর কলোনি তৈরি করতে পারে না, তারা রবীন্দ্রনাথের গান শুনিয়ে যতটুকু কলোনি তৈরি করেছে সেটা যে কোনও ডাইন্যাস্টির চেয়ে মননশীল।
নোয়াম চমস্কির একটা অসামান্য কথা আছে– ‘নলেজ অফ ল্যাঙ্গুয়েজেস ইজ দ্য ডোরওয়ে টু উইজডম’। একটা ভাষাকে ভালোবাসতে পারলে সেই দরজার কাছে পৌঁছনো যায়। বিজ্ঞান স্মৃতি বানাতে পেরেছে, এআই বানাতে পেরেছে, এখনও ভাষা বানাতে পারেনি। মানুষ পাতার মর্মর, জলের কল্লোল, ঝড়ের দাপট, পাখির শিস থেকে ভাষা বানিয়েছে, আমরা যেন তার গভীরতাকে সম্মান করতে পারি। ধন্যবাদ বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে, আপনার সরাসরি ভূমিকা না-থাকলে আমরা এই সম্মান পেতাম না। আপনার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলছি– বাঙালি জাতির হয়ে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। এই সম্মান আগে পাইনি, পেতে পারতাম ২০১৪ সালেই যখন ওড়িয়াকে ‘ধ্রুপদী’ করা হয়েছিল। তখন অনেক শিক্ষিত বাঙালি বলেছিল, ওরাও যদি পায় আমাদের আর পেয়ে কী হবে! যখন কেন্দ্রে ‘বন্ধু সরকার’ ছিল, তখনও একটাও ইট পরেনি গাঁথনিতে।
এখন মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে যখন ‘ধ্রুপদী’ স্বীকৃতি এল, তখন সবাই সম্মানের ভাগ পেতে চাইছে। রাজ্যের সমস্ত প্রান্তিক মানুষ, যারা বাংলায় কথা বলে, মধ্যবিত্ত সমাজ যাদের বাংলা ছাড়া কেউ নেই, বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছে যেসব লিটল ম্যাগাজিন, সমস্ত বাংলা মিডিয়া যারা বাংলা ভাষাকেই প্রচার করে চলেছে, সমস্ত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সবাইকে ধন্যবাদ। মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে ও উৎসাহে বাংলা ভাষার নাট্যকার ব্রাত্য বসু যেভাবে ভাষাকেন্দ্রের গবেষকদের নিয়ে ২,২০০ পৃষ্ঠার দলিল তৈরি করেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষক অমিতাভ দাস, স্বাতী গুহদের অভিনন্দন। অবশ্যই আর-একজনের কথা বলব, যিনি অবশ্য বাঙালি নন, তঁার মাতৃভাষা তেলুগু– ড. কে. শ্রীনিবাস রাও, সাহিত্য অকাদেমির সচিব, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সম্মান করে যেভাবে কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন তাতে তঁাকে নেপথ্য নায়ক বললে অন্যায় হয় না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে আজই কিন্তু কার্জন পার্কে মহাষ্টমী হত।
(মতামত নিজস্ব)